সরেজমিন : মিরপুর ও শাহ আলী থানা-'মাইন্ড করলে পুলিশে চাকরি করা যায় না' by রাব্বী রহমান ও মাসুদ রানা

শুক্রবার রাত ১১টা ৪৫ মিনিট। মিরপুর থানার ফটকে পায়চারি করছিলেন এক পুলিশ কনস্টেবল। মূল ভবনের ডান পাশে অভ্যর্থনা কক্ষ। সেখানে পাঁচজন লোক বসে আছেন। সবাই বহিরাগত। ডিউটি অফিসারের কক্ষটি ব্যাংকের ক্যাশ কাউন্টারের মতো কাচ দিয়ে ঘেরা।


সেখানে থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে আসা দুই ব্যক্তির সঙ্গে এক পুলিশ সদস্য উচ্চস্বরে কথা বলছিলেন। সাদা পোশাক পরা পুলিশ সদস্যটি বলছিলেন, 'এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ জিডি এক হাজার টাকার নিচে কী করে হয়?'
জিডি করতে আসা ভদ্রলোক বললেন, 'স্যার। এক হাজার টাকা কাছে নাই। ৫০০ টাকা দিলাম। কিছু মাইন্ড কইরেন না। কাজটা কইরা দিয়েন।' টাকা পকেটে পুরে ওই পুলিশ বললেন, 'আরে না ভাই। মাইন্ড করব ক্যান। মাইন্ড করলে পুলিশে চাকরি করা যায় না। এইডা হইল চা-পানির খরচা। খুশি হইয়া দিছেন, এতেই চলব। কাজ হয়ে যাবে।'
অভ্যর্থনা কক্ষে লুঙ্গি পরা একজনকে বসে থাকতে দেখা যায়। তিনি জানান, তাঁর নাম শহিদ মিয়া। ওই পাশে যিনি পুলিশকে টাকা দিলেন, তিনি তাঁর মামা। মামার নাম দেলোয়ার হোসেন। কাপড় ও রঙের ব্যবসায়ী। সকালে সন্ত্রাসীরা দেলোয়ারের কাছে টেলিফোনে চাঁদা চেয়েছে। এ কারণেই তাঁরা থানায় এসেছেন জিডি করতে। কিন্তু পুলিশ তাঁদের জিডির আবেদনটি ঠিকমতো লেখা হয়নি, ভাষা ঠিক হয়নি, এটা হয়নি, ওটা হয়নি বলে টাকা নিয়ে শেষপর্যন্ত নিজেরাই লিখে দিয়েছে। মামা দেলোয়ার জিডির কপি হাতে বের হয়ে এলে ভাগ্নে শহিদও তাঁর সঙ্গে থানা থেকে বের হয়ে যান।
দেলোয়ার ও শহিদ বের হয়ে যেতেই অভ্যর্থনা কক্ষ থেকে আরো দুজন গিয়ে ঢোকেন ডিউটি অফিসারের কক্ষে। কিছুক্ষণ পর তাঁরাও বের হয়ে আসেন। তাঁদের একজন বললেন, 'ভাই, পারিবারিক সমস্যার কারণে থানায় একটি ডায়েরি করলাম। মেয়েঘটিত পারিবারিক সমস্যা।' যথারীতি এর জন্যও পুলিশকে ৫০০ টাকা দিতে হয়েছে।
রাত সাড়ে ১২টা। অভ্যর্থনা কক্ষে বসে সাদা পোশাকের এক পুলিশ সদস্যকে টেলিফোনে বলতে শোনা গেল, 'না, না, থানায় আনার প্রয়োজন নেই। থানায় আনলে ঝামেলা হতে পারে। বাইরে থেকে ওয়াস করে নিয়ে এসো।...ঠিক আছে, অপেক্ষা করো, আমি আসছি।' এরপর তিনি বের হয়ে গেলেন।
থানার দেয়ালে কয়েকটি স্থানে লেখা ধূমপান নিষেধ। রাত ১টার দিকে চারটি মোটরসাইকেলে করে কয়েকজন যুবক সিগারেট টানতে টানতে থানায় ঢুকলেন। তাঁরা আড্ডা দিলেন ডিউটি অফিসারের সঙ্গে। এরপর চলে গেলেন। জানা যায়, তাঁরা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ক্ষমতাসীন দলে আছেন।
রাত ১২টা ৪০ মিনিট। এক লোক ভেতরে এসে ডিউটি অফিসারের সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। বললেন, তিনি অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছেন। এসেছেন জিডি করতে। কাজ শেষে ওই সাবেক সরকারি কর্মকর্তাও 'ডোন্ট মাইন্ড' বলে ওয়্যারলেস অপারেটরের হাতে ৫০০ টাকা গুজে দিলেন। ভদ্রলোকের নাম দেলোয়ার হোসেন।
থানা থেকে বের হওয়ার পথে দেলোয়ার হোসেন এই প্রতিবেদককে বলেন, তাঁর মেয়ে কমার্স কলেজে পড়ে। শুভ নামের এক ছেলে তাঁর মেয়েকে মোবাইল ফোনে বিরক্ত করে। মেয়ে বিষয়টি তাঁকে জানিয়েছে। শুভ বলেছে, তার ডাকে সাড়া না দিলে সে আত্মহত্যা করবে এবং তাদের ফাঁসিয়ে দেবে। এ কারণেই তিনি জিডি করেছেন।
জিডি করতে পুলিশকে কেন টাকা দিলেন- জানতে চাইলে তিনি বিব্রতবোধ করেন। একপর্যায়ে বলেন, 'এটা অন্য ব্যাপার। প্লিজ। এটা ঘুষ নয়। জাস্ট...।'
রাত ১টা। থানায় ভিড় কমে এসেছে। কাচের ঘরে জিডি করতে টাকা নিচ্ছিলেন একজন পুলিশ সদস্য। তাঁর সঙ্গে আরো দুজন। তাঁরাও পুলিশ সদস্য। কাছে গিয়ে বুকে আটকানো নামফলক দেখে জানা যায় একজনের নাম শফিকুল, আরেকজন মশিউর। অন্যজন সাদা পোশাক পরা। ফলে নামফলক নেই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাঁর নাম বাশার। তিনি ওয়্যারলেস অপারেটর।
অভ্যর্থনা কক্ষ পেরিয়ে একটু এগোলে ডান দিকে ওসির কক্ষ। কক্ষটি তালাবদ্ধ। পাশেরটি ইন্সপেক্টরের (তদন্ত) কক্ষ। কক্ষ খোলা, চেয়ার শূন্য। এই দুই কক্ষের অদূরেই সাব-ইন্সপেক্টর বা এসআইদের বসার জায়গা। অন্য পাশে হাজতখানা। হাজতখানার উল্টোদিকে অস্ত্রাগার ও মালখানা কক্ষ। হাজতখানার সামনে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন হাজতি শুয়ে আছে। দায়িত্বরত কনস্টেবল ফারুক জানালেন, হাজতে সাতজন আসামি আছে।
রাত সোয়া ১টা। মিরপুর থানার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে এক লোক। নাম জানালেন রিংকু সারথী। পেশায় নাট্যকার। ভাড়াটিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে এসেছেন। বললেন, ভাড়াটিয়াকে প্রতিদিন ভোর ৪টায় বাড়ির মেইন গেট খুলে দিতে হয়। এটা অত্যাচার। এ কারণে থানায় জিডি করবেন। জিডি লিখেও নিয়ে এসেছেন তিনি। কিন্তু পুলিশ তাঁর জিডি নেয়নি। বলেছে, জিডি লেখা হয়নি। অনেক ভুল আছে। সকালে আসতে হবে। তারা লিখে দেবে।
রিংকু সারথী ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, 'লেখা যাঁর পেশা, তাঁকে লেখা শিখতে হবে পুলিশের কাছে? জীবনে অন্যের কাহিনী নিয়ে নাটক লিখেছি। এখন নিজের অভিজ্ঞতা নিয়েই দেখছি নাটক লিখতে হবে।'
রাত পৌনে ২টা। থানায় দুই যুবতী ও দুই যুবক এলেন। যুবকের অভিযোগ, তাঁর বোনকে তাঁদের বাড়ির ম্যানেজারের ছেলে বাজে কথা বলেছে। আর এর প্রতিবাদ করায় মারধর করে স্বর্ণালংকার নিয়ে গেছে তারা। ডিউটি অফিসার এসব শুনে ওয়্যারলেসে ডেকে পাঠান একজন সাব-ইন্সপেক্টরকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই থানায় হন্তদন্ত হয়ে ঢোকেন এসআই লতিফ। যুবকদের একজন লতিফকে বলেন, 'আমার নাম বেলাল। টাকা যা লাগে আমি দিব। আপনি আসামি ধরেন। ওরে সাইজ করতে হবে।'
এই কথায় লতিফ উত্তেজিত হয়ে অকথ্য ভাষায় যুবককে গালাগাল করেন। কিছুক্ষণ পর শান্ত হয়ে যুবককে পাশের রুমে নিয়ে যান।
যুবকের সঙ্গে আসা ছোট বোন জ্যোস্না এই প্রতিবেদককে বলেন, উত্ত্যক্তকারী বখাটের নাম পাপ্পু। তাঁদের বাসা মধ্য পাইকপাড়ায়।
এসআই লতিফ বেলাল ও তাঁর বোনসহ অন্যদের নিয়ে থানার বাইরে যান। সেখানে তাঁদের মধ্যে আরেক দফা কথা হয়। কী কথা হয়- তা জানা যায়নি। থানায় ফিরে আসেন তাঁরা। এসআই লতিফকে ক্ষুব্ধ দেখা যায়। তিনি বেলালকে লক্ষ্য করে বলেন, 'এটা সাধারণ ঘটনা। এই ঘটনায় থানায় মামলা হয় না।' বেলাল অনুরোধ করে বলেন, 'মামলা না নিন, অন্তত একটা জিডি নিন স্যার।' কাল আসতে বলে এসআই লতিফ তাঁদের থানা থেকে বের করে দেন। পরে ওয়্যারলেস অপারেটর এবং ডিউটি অফিসারের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন তিনি। ওয়্যারলেস অপারেটরকে বলেন, এসব আজেবাজে কাজে কেন তাঁকে ডাকা হয়। বাইরে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছিলেন তিনি। এ ধরনের কাজে তাঁকে যেন ভবিষ্যতে আর ডাকা না হয়।
থানার অভ্যর্থনা কক্ষে বসেছিলেন এই প্রতিবেদক। এসআই লতিফ জানতে চান, 'এত রাতে থানায় কী চান?' প্রতিবেদক নিজের পরিচয় গোপন করে বলেন, 'আমার ছোট ভাইকে খুঁজে পাচ্ছি না। তাই আপনাদের সহযোগিতা নিতে এসেছি।' একথা শুনে এসআই লতিফ বলেন, 'আর কোনো কাজ খুইজা পাইলেন না। ভাই হারাইছে তো পুলিশ কী করব। আর কোনো কাজ নাই নাকি পুলিশের। এখন চলে যান। কাল আসবেন।'
রাত পৌনে ৩টা। শাহ আলী থানা। ডিউটি অফিসারের কক্ষে পুলিশের তিন সদস্য বসে আছেন। এই প্রতিবেদক ওসি সাহেব আছেন কি না জানতে চাইলে নান্নু নামের এক কনস্টেবল বলেন, 'এত রাতে ওসিরা থানায় থাকে নাকি! থানার ওসি এখন ডিউটি অফিসার। তাঁর কাছে যান।'
থানার অদূরে লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরা এক লোক দাঁড়িয়ে আছেন। কথা হয় তাঁর সঙ্গে। নাম রহিম মিয়া। তিনি বলেন, 'থানায় ওয়াসার পাইপ নষ্ট হইছিল। ঠিক কইরা দিছি। ২০০ ট্যাকা বিল, সেটাও বাকি। সাত দিন হলো, টাকা দিচ্ছে না। ভয়ে কিছু কইতেও পারি না। আবার না মামলায় ফাঁসাইয়া দেয়।'
রাত ৩টা। শাহ আলী থানার সামনে এক ব্যক্তিকে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। ভদ্রলোক জানালেন, তাঁর নাম শহিদ। এই প্রতিবেদকের পরিচয় পেয়ে বললেন, থানার সামনে পুলিশের সহায়তায় ছয়টি দোকান উঠিয়ে সেগুলো ভাড়া দিয়েছেন তিনি। মাসে প্রতি দোকান থেকে দুই হাজার টাকা করে পান। এর এক হাজার ৫০০ টাকা থানার, বাকি ৫০০ টাকা তাঁর। এই থানার পুলিশ স্যাররা খুব ভালো। ওসি স্যারও ভালো মানুষ। তাই এলাকায় কোনো অপরাধ নেই। এলাকার সবাই শান্তিতে আছে।
রাত সোয়া ৪টা। আবার মিরপুর থানা। দেখা গেল ডিউটি অফিসার এসআই শফিকুল দুই পা পাশের চেয়ারে তুলে দিয়ে ঘুমিয়ে আছেন। হাজতখানা থেকে জোরালো কণ্ঠে গান ভেসে আসছিল, 'আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল, সকলি ফুরায়ে যায় মা...।' ঘুম ভেঙে যায় এসআই শফিকের। রেগে যান তিনি। চিৎকার করে ওঠেন, '...বাচ্চা। চিৎকার করবি না। কাল সকালে তোর সাধ মিটাবো নে।'

No comments

Powered by Blogger.