ইস্টার সানডে-পুনরুত্থান রোববার ও একটি আক্ষেপ by ফাদার প্যাট্রিক গমেজ

আজ ৮ এপ্রিল, রোববার। সারা পৃথিবীতে খ্রিষ্টবিশ্বাসীরা আজ মহাসমারোহে পালন করছে প্রভু যিশুর গৌরবময় পুনরুত্থান মহোৎসব পাস্কা বা ইস্টার। সবাই উচ্চকণ্ঠে গেয়ে উঠছে: জয় জয় প্রভুর জয়। ৬ এপ্রিল ছিল গুড ফ্রাইডে বা পুণ্য শুক্রবার—স্মরণ করা হয়েছে যিশুর পরিত্রাণদায়ী মৃত্যু।


মানুষ কৃচ্ছ্রসাধন করে, উপবাস বা রোজা থেকে নিজ পাপের জন্য অনুতপ্ত হয়েছে; নিজ পাপ স্বীকার করে ঈশ্বর ও মানুষের সঙ্গে হয়েছে পুনর্মিলিত। আজ আনন্দের সঙ্গে স্মরণ করা হচ্ছে, পালন করা হচ্ছে প্রভু যিশুর গৌরবময় পুনরুত্থান।
পাস্কা: হিব্রু শব্দ পাস্কা মানেই হলো পার হয়ে যাওয়া। যিশুর পুনরুত্থান পাপের ওপর বিজয় এনেছে। মানুষকে পাপ থেকে মুক্ত করেছে। এই অর্থেই আজকের এই মহোৎসবের নাম পাস্কা। যিশুর পুনরুত্থানে মানুষের জীবনে উষার আলোর উদয় হয়েছে। তাই এই পর্বের নাম ইস্টার।
ইস্টারের বড় মোমবাতি: বস্তুত শনিবার রাত থেকেই এই নবজীবনের মহোৎসব শুরু হয়। শনিবার রাতে নিস্তার জাগরণী উপাসনায় যিশুর পুনরুত্থান ঘোষণা করা হয় এবং সবাই মেতে ওঠে পুনরুত্থানের আনন্দে। জ্বালানো হয় পুনরুত্থানের প্রদীপ, এক বিরাট আকারের মোমবাতি, যা ঘোষণা করে: যিশুর পুনরুত্থান মানুষের জীবনে এনেছে নতুন আলো, নতুন জীবন; যিশুর পুনরুত্থান দূরীভূত করেছে পাপের অন্ধকার; মানুষ মৃত্যুঞ্জয়ী যিশুখ্রিষ্টের সঙ্গে হয়েছে নবীভূত। আজকের এই মহোৎসব আলোর মহোৎসব। এই উৎসব আমাদের সবাইকে আলোকিত মানুষ হয়ে যিশুর সঙ্গে পুনরুত্থিত হয়ে তাঁর আলোতে উদ্ভাসিত হতে আহ্বান জানায়। আজ নতুন সাজে ছোট-বড় সবাই পুনরুত্থানের খ্রিষ্টযাগে তথা উপাসনায় অংশগ্রহণ করে। গির্জাঘর থাকে খ্রিষ্টভক্ত দিয়ে পূর্ণ। উপাসনা বা নামাজের পরেই চলে আপন আপন কৃষ্টিতে ইস্টারের শুভেচ্ছা বিনিময়। ঘরে ঘরে আজ আয়োজন করা হয় দই-চিড়া-মুড়ি-মুড়কির মতো হরেক রকম মুখরোচক আহারসামগ্রী। এতে অংশ নেবে ঘরের সবাই, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই। এই আসরে অনেক সময়ই নিমন্ত্রিত হয় হিন্দু-মুসলিম ভাইবোনেরাও।
একটি আহ্বান: পুনরুত্থিত বা আলোকিত জীবনের দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্যগুলা কী কী হতে পারে: যেখানে বৈষম্য ও দলাদলি থেকে আসে মিলন ও ভ্রাতৃত্ব, যেখানে অশান্তি থেকে আসে শান্তি, যেখানে ঝগড়া-বিবাদ থেকে আসে ক্ষমা, যেখানে জটিলতা ও অস্বাস্থ্যকর জটিলতা-কুটিলতা থেকে আসে সরলতা ও স্বচ্ছতা, যেখানে নেই ধর্ষণ বা মানবনিধন, যেখানে নেই কোনো ধর্মীয় গোড়ামি, যেখানে নেই মিথ্যার ছড়াছড়ি, সেখানেই তো নবজীবন, পুনরুত্থিত জীবন। অপ্রিয় হলেও সত্য যে আমাদের দেশে অনেক উদাহরণ রয়েছে, যেখানে মানুষ ভীষণভাবে নৈতিকতার দিক থেকে অসুস্থ। অনেক মানুষই আজ মিথ্যা, চুরি, মাদকাসক্তি, সন্ত্রাস, হত্যাযজ্ঞ, হানাহানি, খুনাখুনি, পরচর্চা, পরনিন্দা, প্রকাশ্যে কাদা ছুড়াছুড়ি—এমন সব পাপের গহ্বরে পড়ে আছে। এই ইস্টার বা পুনরুত্থান পর্ব এমন অন্ধকারের জীবন থেকে বের হয়ে বাংলার মানুষকে আলোর রাজ্যে আসার আহ্বান জানায়।
বাংলার মানুষের বৈশিষ্ট্য: বাংলাদেশের মানুষ ঐতিহ্যগতভাবেই শান্ত মানুষ; উগ্রতা তার ধর্ম নয়। ঐতিহ্যগতভাবেই আমাদের দেশের মানুষ মিলনের কৃষ্টির মানুষ, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান একত্রে বাস করে আসছে যুগ যুগ ধরেই। বাংলার মানুষের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে যায় বিদেশি বন্ধুরা। অতএব, আমাদের শক্তি আছে এই মূল্যবোধগুলো নিয়ে উল্লিখিত পাপগুলোর ওপর জয়ী হয়ে পুনরুত্থিত মানুষে পরিণত হওয়ার। এ প্রসঙ্গে যিশুর পুনরুত্থান আমাদের প্রত্যেকের জন্য পাপের ওপর বিজয়ী হওয়ার একটি বড় চেতনা ও প্রেরণা।
যিশু সম্পূর্ণ নির্দোষ, নিষ্পাপ, পরম পবিত্র, ঈশ্বরেরই পূর্ণ প্রকাশ—ঈশ্বরপুত্র বলে তাই আখ্যায়িত। এই যিশুই আমাদের পাপের ভার বহন করে, ক্রুশে মৃত্যুবরণ করে আমাদের জন্য স্বর্গের দুয়ার খুলে দিয়েছেন। পুনরুত্থান করে বিজয়ী প্রভুরূপে গৌরবান্বিত প্রভুরূপে দেখা দিয়েছেন। আসুন, আমরা পাপ-পঙ্কিলতা ত্যাগ করে স্বচ্ছ-সুন্দর, পবিত্র জীবন নিয়ে পুনরুত্থিত মানুষে পরিণত হই। এই পাস্কা পর্ব শুধু খ্রিষ্টবিশ্বাসীদেরই নয়, এই মহোৎসবের আবেদন, তাগিদ ও এর আহ্বান সর্বজনীন।
পাস্কা ও বাংলা নববর্ষ: অত্যন্ত মজার দিকটি হলো, এ বছর পয়লা বৈশাখ ১৪ এপ্রিল অর্থাৎ এই পাস্কা বা ইস্টার সানডের একটি সপ্তাহ পরেই। নববর্ষ তো নতুন জীবনই ঘোষণা করে। নতুনকে স্বাগত জানিয়ে সেদিন গেয়ে উঠব: ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।’ একইভাবে আমরা এই পুনরুত্থান উৎসবে নতুন জীবনকে স্বাগত জানাই। আমাদের জীবন ঘোষণা করুক যে আমরা কথায়, কাজে, আচরণে, সম্পর্কে, ধর্মীয়, সামাজিক এমন কি রাজনৈতিক অঙ্গনে আমরা হয়েছি নতুন।
আমাদের এই নতুন জীবনে প্রকাশ পাবে: আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি, প্রকাশ পাবে ভ্রাতৃত্ব-বন্ধুত্ব এবং সহযোগিতা ও সহমর্মিতা। এই পুনরুত্থিত নবজীবনে পরিবারে দেখা যাবে স্বামী-স্ত্রীতে বিশ্বস্ততা, প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা; প্রতিটি কাজে সহযোগিতা। গোটা পরিবারে থাকবে শান্তি ও মিলন। যুবসমাজের মধ্যে থাকবে যুবনৈতিকতা, জীবন গঠনে দৃঢ়তা, বিদ্যাশিক্ষা, নানাবিধ কল্যাণকর যুব উদ্যোগে থাকবে প্রাণের স্বতঃস্ফূর্ততা আর সৃজনশীলতা। এভাবেই প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি পরিবার, প্রতিটি সমাজ, প্রতিটি ধর্মের মানুষ তথা গোটা বাংলাদেশ নতুন হয়ে উঠবে।
বড় আক্ষেপ: ইস্টার তথা যিশুর পুনরুত্থান-রহস্য খ্রিষ্টধর্মের একটি প্রধান ধর্মীয় বিষয়, ধর্মীয় অনুষ্ঠান। খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসের ভিত্তিই হলো যিশুর এই পুনরুত্থান। অন্যান্য ধর্মের যেমন প্রধান প্রধান ধর্মীয় উৎসব (পূজা বা ঈদ) রয়েছে, ইস্টার তেমনই একটি মুখ্য খ্রিষ্টীয় ধর্মীয় মহোৎসব। পরিতাপের বিষয়, দিনটি ছুটির দিন নয়। এই দিনটিতে খ্রিষ্টবিশ্বাসীরা মুক্ত ধারায় মহোৎসবটি পালন করতে পারছে না। এমন কী এই দিনটিতেই ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার তারিখও পড়ে যায়। দেশের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বিষয়টি বিবেচনায় আনবেন, এটা অনুরোধ ও ঐকান্তিক প্রত্যাশা।
হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান—সাবার প্রতি রইল শুভ পাস্কা পর্বের প্রীতিপূর্ণ শুভেচ্ছা।
ফাদার প্যাট্রিক গমেজ: উত্তম মেষপালক ক্যাথলিক চার্চ, ডিঙ্গাডুবা, রাজশাহী।

No comments

Powered by Blogger.