সমাজ-খনার জিভ কিংবা রুমানার চোখ by সায়েমা খাতুন

খনার জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য তার জিভ কেটে নেওয়া হয়েছিল। আর এ যুগের রুমানা মঞ্জুরের দুই চোখ আঙুল দিয়ে অন্ধ করে দেওয়া হলো সেই একই মতাদর্শিক জায়গা থেকে। এ ভায়োলেন্স যে সিস্টেমের ভেতর বারবার সৃষ্টি হতে থাকবে, রুমানার দৃষ্টিহীন দুই চোখ আমাদের সবার সেই চোখ খুলে দিক


কোনো রকম ভূমিকা ছাড়াই শুরু করি_ এই মিথ্যা সুখের সংসার করার প্রয়োজন কেন? প্রশ্নটি দিয়ে, যে প্রশ্নটি এ শহরের রাজপথে, অলিতে-গলিতে, ঘরে-ঘরে, টক-শোতে, বল্গগে ঘুরে ফিরছে। দেশের সবচেয়ে সম্মানিত একটি অবস্থান, ভূমিকা ও দায়িত্বে থাকা একজন বিদুষী নারী রুমানা মঞ্জুরের অন্ধকরণের পর প্রদীপের তলের অন্ধকারকে বুঝে নেওয়ার জন্য এই হলো কেন্দ্রীয় জরুরি জিজ্ঞাসা। আসুন, আমরা আমাদের মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এ প্রশ্নটি নিয়ে ভেবে দেখি। কেননা, রুমানার ওপর এ হামলা থেকে আমাদের এ শিক্ষা নিতে হবে যে, আমাদের মেয়েদের যত শিক্ষাই আমরা দিই না কেন, যত মেধাবী, যত প্রতিভাবানই আমাদের মেয়েরা হোক না কেন, তার সব সাফল্য যদি এই 'সুখের সংসার' করার ওপরই দাঁড়িয়ে থাকে, তবে যে কোনো সময় তা এমনই তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে পারে। মেধা, বিদ্যা, শিক্ষা, চাকরি, রোজগার, নেটওয়ার্ক, বাবার বাড়ি_ কিছুই রুমানাকে রক্ষা করতে পারল না। কেন? 'সাইকিক' স্বামীর অস্বাভাবিক আচরণের কারণে? নাকি আমরা 'সুখের সংসার' করার আবশ্যকতা সৃষ্টি করেছি বলে? রুমানার মতো অবস্থানের নারীর জন্যও যা এতই আবশ্যিক যে, ১০ বছর ধরে নির্যাতন-নিপীড়ন সয়েও এ মিথ্যা মোহের সুখ থেকে মুক্ত হওয়া তার জন্য সম্ভব হয়নি। এভাবে অন্ধত্ব বরণ না করা পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হলো।
রুমানা তা-ও প্রাণে বেঁচে গেছেন। বাঁচতে পারেনি আমাদের অতিপ্রিয় সহকর্মী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক, অভিজাত পরিবারের মেয়ে ও স্ত্রী খন্দকার ফাহমিদা ইসলাম। বিয়ের এক বছর পর পুরোপুরি সংসার শুরু করার মাত্র এক মাসের মধ্যেই সে স্বামীর বাড়িতে ২০০৪ সালে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণে মৃত্যুর শিকার হয়, যার সঠিকভাবে কোনো ময়নাতদন্ত পর্যন্ত করা হয়নি। তার পরিবার কোনো মামলা পরিচালনা করতেও রাজি হয়নি। আমার পরম বন্ধু ফাহমিদার সুখী হওয়ার, সমাজে নিজেকে সুখী স্ত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সর্বাত্মক চেষ্টা আমি দেখেছি এমনই এক সময়ে, যখন সে তার ব্যবসায়ী স্বামী ওয়াসেক বিল্লাহর বাড়িতে এমন পরিস্থিতি অনুভব করেছে যে, প্রাণ সংশয়ের আশঙ্কা করছিল, এমনকি জিডি করে রাখার প্রয়োজনও উঠেছিল। এ অবস্থায়ও ফাহমিদা তার জতুগৃহে প্রবেশ করেছিল সংসারকে ধরে রাখার জন্য। কিন্তু সংসার তো দূরের কথা, সে তার জীবনটাকেই ধরে রাখতে পারেনি।
কোনো প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ইচ্ছা-অভিরুচির বিরুদ্ধে বল প্রয়োগের মাধ্যমে কোনো কিছু করা তাই পারিবারিক পরিসরে কেবল সম্ভবই নয়; নারী, শিশু এবং ক্ষমতার বিচারে দুর্বলের জন্য অতি স্বাভাবিক মনে করা হয়। কোনো ফৌজদারি অপরাধ ঘটার আগ পর্যন্ত তাই এতে সামাজিক, রাষ্ট্রীয় কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি বাধা দিতে এগিয়ে আসতে পারে না। সেসব আচার-বিচারের বাইরেই রয়ে যায়। বল প্রয়োগ, দৈহিক আঘাত এমনকি মৃত্যুর সম্মুখীন হলেও, যা স্রেফ ফৌজদারি দণ্ডবিধির অন্তর্ভুক্ত অপরাধ, সে ক্ষেত্রেও স্বয়ং ভিক্টিমকেই এ অপরাধের পেছনে দাঁড় করিয়ে অপরাধের দায় ও গুরুত্বকে হালকা করার সামজিক চর্চা জোরালো থাকে। মিডিয়া এর সঙ্গী হয়ে কাজ করে। এবং নৈতিক দিক থেকে দায়দায়িত্বের ভাগ ভিক্টিমের ওপর বর্তে দেওয়া হয়।
একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। একটি টিভি চ্যানেলে মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক মেহতাব খানম দর্শকদের বিভিন্ন সমস্যার জবাব দেওয়ার জন্য অতিথি বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে পরামর্শ আহ্বান করেন। সেখানে একজন নারী স্বামীর মারধর করার অভ্যাস কীভাবে মোকাবেলা করবেন, তার জবাবে অত্যন্ত সহানভূতির সঙ্গে একজন পুরুষ বিশেষজ্ঞ বলছিলেন তাকে ভেবে দেখতে, যাতে তিনি এমন কিছু না বলেন যা তার স্বামীকে মারধর করতে উদ্দীপনা দেয়। তাহলে কী দাঁড়াল? যেসব ডিসর্কোসের মধ্যে বড় হয়ে পুরুষ তার স্ত্রীর ওপর বল প্রয়োগ করতে পারাকে স্বামীত্বের অধিকার, পৌরুষ প্রতিষ্ঠার স্বাভাবিক আচরণ মনে করে এবং যে সমাজে সে বাস করে, সেখানে আশকারা ও সহযোগিতা পায়, সেসব এমনই শক্তিশালী যে, অবস্থাটা হলো_ সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা?
আধুনিক পরিবার গঠনের আগে কুমারী, বিধবা, স্বামীহীন নারীদের এমনটা একা হতে হতো না এ জন্য যে, তিন-চার প্রজন্মের বহু রকম আত্মীয়স্বজনের বিরাট গৃহস্থালিতে বৃক্ষের শাখা-প্রশাখার মতোই এমন কিছু মানুষের জায়গা হয়ে যেত। পুঁজিবাদী সমাজে বাজারে শ্রমশক্তি পুনরুৎপাদনের কেন্দ্র হিসেবে আধুনিক একক পরিবার উদ্ভবের ফলে এই আঁটোসাঁটো দম আটকানো ঘর-গেরস্থালির বাইরে কোনো বৈধ নৈতিক পরিসর রইল না, যেখানে নারীর (এমনকি পুরুষও) কোনো সৃষ্টিশীল আনন্দময় জীবন সম্ভব হতে পারে। স্বামী, সন্তান, সংসার ঘিরে যে এসেনশিয়াল সুখের জীবন উপন্যাস-গল্প-কবিতার সাহিত্য ও মিডিয়া পুনঃপুন উৎপাদন করে যাচ্ছে, এতে সংসার ও গেরস্থালির বাইরে বেঁচে থাকা মর্যাদাসহকারে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এর বাইরে জীবনের সুখ, আনন্দ, পরিতৃপ্তি, সমৃদ্ধি ও মর্যাদা বজায় রাখার দরজা-জানালা সব বন্ধ। রুমানা এবং আমার মেয়ের, আমাদের সবার মেয়েদের জন্য জীবনের সে পথগুলো না খুঁজে আমরা কি তাদের সুখের নামে, সংসারের নামে এভাবে হতাহত হওয়ার পথ খোলা রাখব?
মধ্যযুগের জ্যোতির্বিজ্ঞানী খনার জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য তার জিভ কেটে নেওয়া হয়েছিল। আর এ যুগের রুমানা মঞ্জুরের দুই চোখ আঙুল দিয়ে অন্ধ করে দেওয়া হলো সেই একই মতাদর্শিক জায়গা থেকে। নারীর বিদ্যা-জ্ঞান-প্রজ্ঞার চর্চা, তার সামাজিক নেটওয়ার্কের বিস্তার পুরুষকে ইনসিকিউর করে; তার ক্ষমতার ব্যবস্থাকে বিকল করে দেয়। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন এক সাইকিক স্বামীর পাশবিক অনুভূতি থেকে নয়। এ ভায়োলেন্স যে সিস্টেমের ভেতর বারবার সৃষ্টি হতে থাকবে, রুমানার দৃষ্টিহীন দুই চোখ আমাদের সবার সেই চোখ খুলে দিক।

সায়েমা খাতুন :শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
 

No comments

Powered by Blogger.