খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও অন্যান্য প্রশ্ন by এ এম এম শওকত আলী

বিশ্ব খাদ্য সংস্থার মহাপরিচালক সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরকালে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। জনসংখ্যার ভিত্তিতে অঙ্ক কষে মাথাপিছু খাদ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ করে অবশ্যই এ ধরনের মন্তব্য করা স্বাভাবিক। কিন্তু এর পরও অনেক প্রশ্ন থেকে যায়।


বিশ্ব খাদ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী খাদ্যনিরাপত্তার অর্থ সব মানুষ যেন সব সময় নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ করার সুযোগ পায়। খাদ্যনিরাপত্তা ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা সমার্থক নয়। বাংলাদেশের কৃষি ও খাদ্য খাতের উন্নয়ন পরিকল্পনায় বহু দিন ধরেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার লক্ষ্য অর্জনই ছিল প্রধান বিষয়। ধরে নেওয়া হয় যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন হলেই খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এ ধারণা সঠিক নয়। কারণ যে খাদ্যসামগ্রী বাজারজাত করা হবে, তা সহনীয় মূল্যে বিপণন না হলে এ খাদ্য দরিদ্ররা কিনে খেতে পারবে না। আর বিপণন হওয়া খাদ্য নিরাপদ না হলে সে খাদ্য এ ধরনের মানুষদের ভোগান্তি বাড়াবে। কারণ তাদের চিকিৎসা-ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। এ ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে তাদের ক্রয়ক্ষমতাও হ্রাস পাবে। অন্যদিকে এ ব্যয় বৃদ্ধি না পেলে তাদের ক্রয়ক্ষমতাও বাড়বে। খাদ্যসহ জীবনযাপনের জন্য অন্যান্য খরচ মেটাতে তারা সক্ষম হবে।
দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলে এ কারণে গরিবদের জন্য সহনীয় বা বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য আমাদের স্বাস্থ্য উন্নয়ন নীতিতে এ কারণেই গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। তবে সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে এ লক্ষ্য এখনো অর্জন করা সম্ভব হয়নি। তবে চেষ্টা করা হচ্ছে। যেমন- প্রাথমিক নগর স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্পের আওতায় ১৯৯৮ সাল থেকেই এ প্রকল্প চালু আছে। সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ পর্যন্ত প্রায় ৩৫ মিলিয়ন শহরের দরিদ্র জনমানুষ এ সেবা বিনা মূল্যে বা ক্ষেত্রবিশেষে সহনীয় মূল্যে পেয়েছে। এর মধ্যে ৮ দশমিক ৯ মিলিয়ন হলো ২০১১ সালে। এ প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রা ছিল, প্রকল্প এলাকায় অন্তত ৩০ শতাংশ দরিদ্র লোককে বিনা মূল্যে সেবা প্রদান করা হবে। প্রকল্প মূল্যায়নে দেখা যায় যে ২০১০ সালে প্রায় ৩২ শতাংশ দরিদ্র জনমানুষকে এ সেবা প্রদান সম্ভব হয়েছে। এসব লোককে চিহ্নিত করে তাদের লাল কার্ড দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা সেবাকেন্দ্রে এসে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে পারে।
স্বাস্থ্য খাতের প্রসঙ্গটি উল্লেখ করার কারণ হলো, খাদ্যনিরাপত্তা একটি বহুমাত্রিক ও জটিল বিষয়। একমাত্র খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেই এ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে অন্যান্য প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রও রয়েছে। ১৯৯৮-৯৯ সালে প্রলয়ঙ্করী বন্যার পর খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু ওই সময় এ অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ অনেকেই করেছিলেন। যুক্তি ছিল, স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পরও কেন খাদ্য আমদানি করা হচ্ছে। এর যুক্তিসংগত কারণ ছিল। ওই সময় এশীয় অঞ্চলের কিছু দেশ এ দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারমূল্যের চেয়ে কম মূল্যে রপ্তানি করতে সক্ষম ছিল। দেশের চালের কেজিপ্রতি বাজারমূল্য ছিল ১০ থেকে ১২ টাকা। রপ্তানিমূল্য ছিল প্রতিকেজি ৯ টাকা। এ কারণেই আমদানি মূলত বেসরকারি খাতে বন্ধ হয়নি। তবে পরবর্তী বছর থেকে এ বছর পর্যন্ত প্রতিবছরই সরকারি ও বেসরকারি খাতে খাদ্য আমদানি করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এ বছর সর্বমোট ২০ লাখ টন খাদ্য আমদানি করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি খাতে চার লাখ ৬৪ হাজার টন গম আমদানি করা হয়। বেসরকারি খাতে চাল আমদানি খুব একটা হয়নি- মাত্র ৬৭ হাজার টন। এ খাতে গম আমদানি করা হয়েছে ৯ লাখ চার হাজার টন। সরকারি প্রথা অনুযায়ী চাল, গম ও ভুট্টার দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ এবং নির্ধারিত হারে যেমন- ১৬ আউন্স খাদ্য গ্রহণের মাত্রার ভিত্তিতে আমদানি করার প্রয়োজন আছে কি না তা ঠিক করা হয়। তবে এর মধ্যে বেসরকারি খাত কত আমদানি করবে, তা ধরে নেওয়া হয়। সরকারি খাতে আমদানি করার দায়িত্ব সরকার এড়াতে পারে না। কারণ খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারেরই মূল দায়িত্ব। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে আপৎকালীন মজুদ (Buffer Stock) রাখা খাদ্যনীতির একটি প্রধান লক্ষ্য। এর লক্ষ্যমাত্রা বর্তমানে ১ দশমিক ১ মিলিয়ন অর্থাৎ ১১ লাখ টন। এ মজুদ সারা বছরই রাখতে হবে।
আশির দশকের শেষার্ধ থেকেই দাতাগোষ্ঠী একে অপচয়ের শামিল বলে যুক্তি প্রদর্শন করত। কিন্তু কোনো সরকারই তাদের এ যুক্তি গ্রহণ করেনি। সরকার ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে। কারণ মানবিক ও রাজনৈতিক। বছর চারেক আগে এক সমীক্ষায় এর জোরালো যুক্তিও পাওয়া যায়। দেখা যায়, সরকারি মজুদের প্রায় ৭৪ শতাংশ খাদ্যভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বিতরণ করতে হয়।
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের বিষয়ে আরো একটি প্রশ্ন রয়েছে, তা হলো অভ্যন্তরীণ চাহিদা। বিষয়টি জনসংখ্যার সঙ্গে যুক্ত। এ ক্ষেত্রে আরেকটি প্রাসঙ্গিক বিষয় হলো খাদ্যাভ্যাস। অর্থাৎ দৈনন্দিন খাদ্য তালিকা। এ তালিকায় চালের আধিক্যই অধিকতর বা সর্বাধিক বলা যায়। তবে এ তালিকায় মাছ, মাংস, সবজিও রয়েছে। একমাত্র খাদ্যশস্য তথা চাল, গম ও ভুট্টা উৎপাদনের পরিমাণ দিয়েই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের বিষয় নির্ধারণ করা সঠিক হবে না। শাকসবজি, মাছ, মাংস ও ডিমের মূল্য অধিক হওয়ার কারণে দরিদ্ররা এসব খাদ্যসামগ্রী কিনতে পারে না। এ কারণে তারা অপুষ্টির শিকার হয়। স্বভাবতই প্রশ্ন করা হয়, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পরও সেই অপুষ্টির আধিক্য। কারণ ওই একটাই- খাদ্যশস্যে অর্থাৎ চাল, গম ও ভুট্টার উৎপাদনের আধিক্যের জন্য যদি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দাবি করা হয়, তবে তাও সঠিক হবে না। কারণ চাল ছাড়া অন্য দুই খাদ্যশস্যের উৎপাদন আশাব্যঞ্জক নয়।
গমের দেশজ চাহিদা নিরূপণের বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত। ভুট্টাও তাই। তবে খাদ্য হিসেবে ভুট্টা খুব একটা ব্যবহৃত হয় না। খাদ্যের ব্যবহারের মাত্রা মুরগি উৎপাদন ক্ষেত্রেই বেশি। এক অসমর্থিত হিসাব অনুযায়ী, গমের দেশজ চাহিদা প্রায় চার মিলিয়ন বা ৪০ লাখ টন। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি খাতে এ পর্যন্ত আমদানি করা হয়েছে মোট ১৩ লাখ টন। এর মধ্যে সরকারি খাতে আমদানি হয়েছে চার লাখ ৬৭ হাজার টন। বেসরকারি খাতে আমদানি হয়েছে ৯ লাখ চার হাজার টন। বিদেশি খাদ্য সহায়তা কর্মসূচির আওতায় লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই লাখ টন। এ পর্যন্ত এ খাতের সহায়তার মাত্রা মাত্র ৪৮ হাজার টন। বিদেশি খাদ্য সহায়তার বিষয়ে একটি তথ্য প্রণিধানযোগ্য। তা হলো, সহায়তার পরিমাণ প্রতিবছর হ্রাস পাচ্ছে। অতীতে দুই থেকে এক মিলিয়ন ছিল এ সহায়তার মাত্রা। সহায়তার মাত্রা হ্রাস পাওয়ার দুইটি প্রধান কারণ-
এক. উন্নত যে কয়টি দেশের সহায়তা বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির আওতায় আগে পাওয়া সম্ভব ছিল, সে দৃশ্যপট এখন নেই। দুই. চালের দেশজ উৎপাদন আগের তুলনায় অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আশাব্যঞ্জক। তবে ২০০৮ সালের পর থেকেই উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধির সুফল দরিদ্র জনমানুষ পায়নি। কারণ কৃষকের উৎপাদন ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। উৎপাদন ব্যয় হ্রাসের জন্য সরকার অধিক হারে ভর্তুকি দেওয়া সত্ত্বেও চালের বাজারদর হ্রাস পায়নি। এ কারণেই বারবার মোট দেশজ খাদ্যশস্য উৎপাদনের বিষয়টি অনেকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থা ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্ব খাদ্য সামিট বা শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এ সম্মেলনে বিশ্বের প্রায় সব দেশেরই রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান অথবা তাঁদের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেছিলেন। এর মধ্যে বাংলাদেশও ছিল। ওই সম্মেলনে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী সারা বিশ্বের প্রায় ৮০০ মিলিয়ন বা ৮০ কোটি মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীন ছিল। লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয় ২০১৫ সালের মধ্যে, এদের জন্য খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পরবর্তী ২০০১ সালের পর নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পরিমাণ মূল্যায়নও করা হয়। মূল্যায়নে দেখা যায়, অর্জন আশানুরূপ হয়নি। সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এখনো প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ব্যক্তির (শিশুসহ) জন্য খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। এ অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণিত হয়, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি একটি প্রক্রিয়া মাত্র। কোন বছর বিশ্বে কত খাদ্য উৎপাদিত হবে, তা অনুমান করা সম্ভব হলেও উৎপাদনের মাত্রা কমবেশি হবেই। কারণ কৃষি উৎপাদন মানুষের আয়ত্তবহির্ভূত অন্যান্য বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। এর প্রধান বিষয় হলো, অনুকূল আবহাওয়া। সাম্প্রতিককালে বিশ্বের সব দেশই, বিশেষ করে অনুন্নত দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাবের বিষয়ে আতঙ্কিত।
বিশেষজ্ঞরা এ কারণে কৃষি খাতসহ অন্যান্য খাতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন। বিষয়টি উন্নত ও টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবনের সঙ্গে যুক্ত। উন্নত ও টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন সময়সাপেক্ষ। তবে বাংলাদেশে এ চেষ্টা শুরু হয়েছে। চেষ্টা ফলপ্রসূ হলে অধিক খাদ্য উৎপাদনের বিষয়টি হয়তো বা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
সার্বিকভাবে বলা যায়, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার একটি উপায় মাত্র। লক্ষ্য হবে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। যে বিষয়টির সঙ্গে আরো অনেক ক্ষেত্র যুক্ত। একটি প্রধান ক্ষেত্র হলো, দরিদ্র জনমানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। এর সঙ্গে রয়েছে নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টিও। খাদ্য তালিকা সুষম করাও হবে অন্য একটি ক্ষেত্র।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক
উপদেষ্টা ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.