অতিরিক্ত ভর্তি ফি ফেরত দেয়নি কেউ by অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য

ভর্তির জন্য নেওয়া বাড়তি টাকা ফেরত দেয়নি স্কুলগুলো। উল্টো টাকা ফেরত না দেওয়ার 'আবদার' করেছেন স্কুলগুলোর কর্তারা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাঁদের আবদার নাকচ করে দিয়ে বলেছে, টাকা ফেরত দিতে হবে নতুবা বেতনের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয় অনড়।


দ্বিতীয় দফায় স্কুলগুলোকে বাড়তি টাকা ফেরত দেওয়ার আদেশ দিয়েছে তারা। গত ১৫ মার্চ এ আদেশ দেওয়া হয়।
গত জানুয়ারিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথম দফায় স্কুলগুলোকে ভর্তির জন্য নেওয়া অতিরিক্ত টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বলে। শুধু ভর্তি ফি নয়, অনেক স্কুল উন্নয়নের নামে মোটা অঙ্কের অনুদানও নিয়েছে। এ টাকাও ফেরত দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল তখন। এ ছাড়া রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে অবৈধ ভর্তির বিষয়ে তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করেছে মন্ত্রণালয়।
এ ব্যাপারে অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবীর দুলু কালের কণ্ঠকে বলেন, 'স্কুলগুলো কারো কোনো কথা শোনে না। এরা অবাধ্য। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও তারা নিজেদের শক্তিশালী মনে করে।'
শিক্ষাসচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'স্কুলগুলো বাড়তি টাকা ফেরত দেয়নি মর্মে কোনো অভিযোগ আসেনি। অভিযোগ এলে আমরা ব্যবস্থা নেব। এ ছাড়া বাড়তি টাকা ফেরত দেওয়ার বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে একটি আদেশ দেওয়া হয়েছে। সেই আদেশ প্রতিপালিত হয় কি না আমরা এখন মনিটর করব।'
বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী, ভর্তির ক্ষেত্রে এমপিওভুক্ত কোনো স্কুল পাঁচ হাজার টাকার বেশি নিতে পারবে না। আংশিক এমপিওভুক্ত স্কুল ভর্তি ও উন্নয়ন বাবদ আট হাজার টাকার বেশি নিতে পারবে না। কোনো প্রতিষ্ঠান এর বেশি টাকা নিলে তা মাসিক বেতনের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে অথবা ফেরত দিতে হবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নীতিমালা অনুযায়ী কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভর্তির টাকা নেয়নি। এমনকি কোনো প্রতিষ্ঠান বাড়তি টাকা ফেরত দেয়নি বা সমন্বয় করেনি। উল্টো গত ফেব্রুয়ারি মাসে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং গত ডিসেম্বর মাসে মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়ে জানায়, স্কুলের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া বাড়তি টাকা ফেরত দেওয়া হবে না। ভর্তিবাবদ মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ২৪ হাজার ৮০০ এবং ভিকারুননিসা নূন স্কুল ইংরেজি মাধ্যমের জন্য ১৩ হাজার ৩০০ ও বাংলা মাধ্যমের জন্য ১১ হাজার ৬০০ টাকা নিয়েছে।
গত ১৫ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল দুটোর চিঠির জবাব দেয়। মনিপুর স্কুলের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের জবাব- 'নতুন শিক্ষার্থীদের ভর্তির ক্ষেত্রে উন্নয়ন ফি বাবদ ১৫/২০ হাজার টাকা এবং পুরান শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত দুই হাজার টাকা পর্যন্ত আদায়ের প্রস্তাব বাতিল করা হলো।' বাড়তি টাকা ফেরত অথবা সমন্বয় করে ভর্তির নীতিমালা অনুসরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে স্কুলটিকে।
মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. ফরহাদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বাড়তি টাকা ফেরত দেওয়া-সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের কোনো চিঠি পাইনি। পত্রিকা থেকে জেনেছি।' তারপরও এ বিষয়ে স্কুল পরিচালনা পর্ষদ সিদ্ধান্ত নেবে বলে তিনি জানান।
মো. ফরহাদ বলেন, বেশি টাকা নেওয়ার কারণ বারবার বলা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের ৬৫০ জন শিক্ষক-কর্মচারীর মধ্যে এমপিওভুক্ত ১০১ জন। অন্যদের বেতন, বিশুদ্ধ পানি, লিফট, মেডিক্যাল সেন্টার, যাতায়াত, অভিভাবকদের বসার ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হচ্ছে বাড়তি টাকায়। ইব্রাহিমপুর ও শেওড়াপাড়ায় দুটি শাখা খোলার জন্য ঋণ নিতে হয়েছে। ফলে টাকা নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ বাড়তি ফি ফেরত দেওয়া থেকে অব্যাহতি চেয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। মন্ত্রণালয় তাদের এ 'আবদার' নাকচ করে দিয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) মঞ্জু আরা বেগম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বাড়তি টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের চিঠি পেয়েছি। দেখি কী করা যায়। যতটুকু জানি, এখন পর্যন্ত কেউ বাড়তি টাকা ফেরত দেয়নি। আমরা টাকা ফেরত দেওয়া থেকে অব্যাহতি চেয়ে আবার মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখব।'
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে মুগদা শাখা অনুদান বাবদ দুই লাখ ১১ হাজার ৯০০ এবং মেধা তালিকায় ভর্তি বাবদ ৩১ হাজার ৯০০ টাকা, মতিঝিল শাখা (ইংরেজি মাধ্যম) ১৭ হাজার ৯০০ ও (বাংলা মাধ্যম) ১১ হাজার ৯০০ টাকা পর্যন্ত নিয়েছে। এ ছাড়া গত ১১ মার্চ এ প্রতিষ্ঠানে অবৈধভাবে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয়। এ ভর্তির ক্ষেত্রে মুগদা শাখায় নেওয়া হয় (ইংরেজি মাধ্যম) ২০ হাজার ৪৫০ ও (বাংলা মাধ্যম) ১৩ হাজার ৭০০ টাকা এবং মতিঝিল মূল শাখায় (বাংলা মাধ্যম) নেওয়া হয় ৩৩ হাজার ৭০০ টাকা।
প্রতিষ্ঠানের এই অবৈধ ভর্তির ব্যাপারে অভিভাবক ঐক্য ফোরাম শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নোমান উর রশীদকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
অধ্যাপক নোমান উর রশীদ বলেন, 'কমিটি গঠনের চিঠি আজই (বুধবার) পেলাম। শিগগির তদন্ত শুরু করব।'
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক মোজাম্মেল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, বেসরকারি স্কুলে ভর্তির কাজ পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে করা হয়। ভর্তিতে বেশি টাকা নেওয়া হয়ে থাকলে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নিয়েই করা হয়েছে। বেশি টাকা ফেরত দেওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমি জানি না, পরিচালনা পর্ষদ বলতে পারবে।'
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, স্কুলগুলোর বিরুদ্ধে এ বছর শুধু টাকা ফেরত দেওয়া বা সমন্বয়ের আদেশ দেওয়া হয়েছে। আগামী বছর ভর্তির ক্ষেত্রে বেশি টাকা নেওয়া হলে সংশ্লিষ্ট স্কুলের এমপিও বাতিল, অনুদান ও একাডেমিক স্বীকৃতি বাতিল এবং প্রয়োজনে পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ বন্ধ করে দেওয়া হবে।
ভর্তি নীতিমালার আলোকে কোন স্কুল কত টাকা নিয়েছিল তা তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক মো. নোমান উর রশীদকে প্রধান করে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তদন্ত শেষে প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে কমিটি।
তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর ৩২টি স্কুলে ভর্তিবাবদ বেশি টাকা নেওয়ার বিষয়ে তদন্ত করা হয়। ২৪টি স্কুল বেশি টাকা নিয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, বিএএফ শাহীন কলেজ, মাইলস্টোন কলেজ, শহীদ বীর উত্তম লে. আনোয়ার গার্লস কলেজ, মিরপুর বাংলা হাই স্কুল, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল, বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ওয়াইডাবি্লউসিএ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও উত্তরা হাই স্কুল।

No comments

Powered by Blogger.