রঙ্গব্যঙ্গ-আক্কেল আলী ঘোর বিপদে by মোস্তফা কামাল

উচ্চ মাধ্যমিকে পাস জোটেনি আক্কেল আলীর কপালে। সেই লজ্জায় মুখ দেখাতে না পেরে গ্রাম ছাড়ে সে। খালি হাতে চলে আসে ঢাকা শহরে। কাজ নেয় মুদি দোকানে। অনেক দিন কাজ করার পর সে ভাবে, 'পরের দোকানে আর কত গতর খাটব। নিজেই যদি কিছু একটা করতে পারতাম! কী করব! দোকানদারি ছাড়া তো কিছুই জানি না।


একটা মুদি দোকান দিতে পারলে মন্দ হয় না। কিন্তু পুঁজি কোথায়!'
আক্কেল আলী তার চেনাজানা কারওয়ান বাজারের এক আড়তদারের কাছে গিয়ে নিজের আকাঙ্ক্ষার কথা জানাল। আড়তদার দেখলেন, ছেলেটা ভালো। ছেলেটাকে তিনি সহায়তার আশ্বাস দিলেন। তাঁর সহায়তায়ই আক্কেল আলী আজিমপুরে একটি মুদি দোকান দিল।
ব্যবসায় আক্কেল আলীর কপাল ভালো। ব্যবসা শুরুর পর থেকে তার আয়রোজগার বাড়তে লাগল। অন্যরা তাকে রীতিমতো ঈর্ষা করত। তবে তার ব্যবসা পরিচালনা করতে গিয়ে শরীরের ওপর দিয়ে বেশ ধকল যায়। তার পরও তার কোনো ক্লান্তি নেই। তার ধ্যান-জ্ঞান ও স্বপ্ন হলো ব্যবসা। কোনো দুই নম্বর চিন্তা তার মাথায় নেই। লোক ঠকিয়ে আয়রোজগার করার কথাও সে ভাবে না। তার কথা, সৎ পথের আয় যা-ই হোক তা দিয়েই ছেলেমেয়েদের মুখে অন্ন দেব। সে জন্যই হয়তো বিধাতা তার দিকে তাকিয়েছেন। আক্কেল আলী মনে মনে ভাবে, 'খালি হাতে ঢাকায় আসছি। এখন পরিবার-পরিজন নিয়ে ঢাকা শহরে মাথা গোঁজার ঠাঁই তো হলো!'
হঠাৎ একদিন আক্কেল আলী বুকে ব্যথা অনুভব করল। পরিবারের লোকজন ভাবল কী না কী! তারা তাকে ডাক্তার দেখাতে বলল। কিন্তু আক্কেল আলী পাত্তা দেয় না। আক্কেল আলীর স্ত্রী দেখল, তাকে হাসপাতালে না নিয়ে গেলে সে কোনো দিনও যাবে না। বলতে গেলে জোর করেই তাকে শহরের নামকরা একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। হাসপাতালে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে নিয়ে নানা বাহানা শুরু করলেন। ডাক্তার সাহেব প্রথমেই আক্কেল আলীর মনে ভয় ঢুকিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, 'এ কী! এত রোগ নিয়ে আপনি ঘুমান কী করে?'
ডাক্তারের কথা শুনে আক্কেল আলীর স্ত্রী মর্জিনা বেগমের মন খারাপ। তিনি শুকনো মুখে বললেন, 'ডাক্তার সাহেব, সমস্যা কী!'
ডাক্তার সাহেব বললেন, 'অনেক সমস্যা। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। হাসপাতালে ভর্তি করান। তারপর দেখা যাক।'
আক্কেল আলী কিছুতেই হাসপাতালে ভর্তি হবে না। সে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করাবে না। সে বার বারই বলছে, 'ডাক্তার সাহেব, আমার তো মনে হচ্ছে, আমি ঠিক আছি, আমার কোনো সমস্যা নাই।'
ডাক্তার সাহেব উদ্বেগের সঙ্গে বললেন, 'না না, আপনি ঠিক নাই। যেকোনো মুহূর্তে পড়ে যেতে পারেন।'
আক্কেল আলীর স্ত্রী মর্জিনা বেগম বললেন, 'ডাক্তার সাহেব এত করে বলছেন, পরীক্ষা করিয়ে দেখি না!'
আক্কেল আলী বিরক্তির সঙ্গে বলল, 'আমি বলছি আমার কিছু হয়নি। তার পরও কেন পরীক্ষা করাব।'
তারপর ডাক্তার সাহেব বললেন, 'ঠিক আছে। আপনার ভর্তি হওয়ার দরকার নেই। আপনি পরীক্ষাগুলো করান।'
কী আর করা। আক্কেল আলী বাধ্য হয়ে পরীক্ষাগুলো করাল। তারপর সেগুলো নিয়ে আবার ডাক্তারের কাছে এলো। ডাক্তার সাহেব রিপোর্ট দেখে বললেন, 'আপনার হার্টে সমস্যা আছে। প্রেশারটা বেশ ওঠানামা করছে। আপনার শ্বাস-প্রশ্বাসেও সমস্যা আছে মনে হয়।'
ডাক্তার সাহেবের কথা শুনে আক্কেল আলীর মাথায় হাত। সে বলে, 'ডাক্তার সাহেব, আমি ঠিক আছি। আমার কোনো সমস্যা নাই। সত্যি বলছি। আমি বরং যাই। আমার রাজ্যের কাজ পড়ে আছে।'
'না না, আপনি কোথায় যাবেন? আপনাকে ইনটেনসিভ কেয়ারে রাখতে হবে। অক্সিজেন দেওয়া লাগতে পারে। কয়েকজন ডাক্তারকে নিয়ে টিম গঠন করে আপনাকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। আপনি চিন্তা করবেন না। আমি সব ব্যবস্থা করছি।'
আক্কেল আলী কী করবে কিছুই বুঝতে পারে না। সে মনে মনে ভাবে, 'এ আমি কোথায় এলাম! এত দেখছি মহাবিপদ! শুধু টাকা খসানোর ধান্ধা! ইতিমধ্যেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে ১০-১২ হাজার টাকা খসিয়েছে। এবার ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ঢুকিয়ে বড় অঙ্কের টাকা খসাবে। না না, আমার ওসবের দরকার নেই। মারা গেলে যাব। কিন্তু শুধু শুধু টাকা খরচের কোনো মানে নেই। আমার রক্ত পানি করা টাকা!'
তারপর আক্কেল আলী স্ত্রীকে ডাকে। 'মর্জিনা, এই মর্জিনা! চলো তো, বাড়ি চলো। আমার কিছু হয় নাই। আমি ভালো আছি।'
এবার ডাক্তার সাহেব বেশ ধমকের সুরেই বললেন, 'কে বলল আপনার কিছু হয় নাই? আপনার কঠিন রোগ হয়েছে। আর আপনি যখন হাসপাতালে এসে পড়েছেন, তখন তো আমরা জেনেশুনে রোগীকে ছেড়ে দিতে পারি না! আপনাকে বাঁচানোর দায়িত্ব আমাদের। এই! কে আছিস?'
ডাক্তার সাহেবের চিৎকার শুনে তিন-চারজন লোক তাঁর কক্ষে হাজির হয়ে গেল। তাদের দেখে তিনি বললেন, 'একে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে নিয়ে যাও। আমি আসছি।'
অবস্থা বেগতিক দেখে আক্কেল আলী মনে মনে বলে, 'হে আল্লাহ, আমি মস্তবড় বিপদে পড়েছি। আমাকে তুমি উদ্ধার করো! এখন আমি কী করি? এখান থেকে তো যেকোনো উপায়ে বের হওয়া দরকার। তা না হলে আমার কাছ থেকে লাখ টাকা খসাবে। আমার ব্যবসা উঠবে লাটে! কিন্তু এখান থেকে বের হওয়ার উপায় কী!'
অনেক চিন্তাভাবনার পর আক্কেল আলী বলল, 'ডাক্তার সাহেব, আমার কাছে এখন টাকা-পয়সা নেই। বাসা থেকে টাকা নিয়ে আসি। তারপর ভর্তি হই?'
ডাক্তার সাহেব বললেন, 'আপনি যেতে পারবেন না। আপনার স্ত্রীকে পাঠান।'
'না না ডাক্তার সাহেব! তাকে পাঠালে হবে না। আমাকেই যেতে হবে।'
ডাক্তার সাহেব বললেন, 'আপনাকে তো ছাড়া যাবে না। রাস্তায় যদি কিছু হয়ে যায়! যেভাবেই হোক, টাকার ব্যবস্থা আপনার স্ত্রী করবেন। আপনি আসুন আমার সঙ্গে।'
আক্কেল আলী কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সে এক দৃষ্টিতে ডাক্তার সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.