শেকড়ের ডাক-স্বাস্থ্যসেবা 'ব্যবসা'র কাছে মানুষ বড় অসহায় by ফরহাদ মাহমুদ

'প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ, শিল্পী, গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. মৃদুল কান্তি চক্রবর্তী আর নেই।' ছোট একটি খবর, কিন্তু বিশাল এর ব্যাপ্তি। কারণ বহু গুণে গুণান্বিত এই মানুষটির বিশেষণের কোনো অভাব ছিল না। খবরের একটি বাক্যে যে বিশেষণগুলো উল্লেখ করা হয়েছে, তার সঙ্গে আরো দুটি বিশেষণ যোগ না করলেই নয়।


তিনি ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং একজন সুলেখক। সুরের স্বরূপ অন্বেষণে নিবেদিতপ্রাণ এই মানুষটির প্রয়াণের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের সংগীতচর্চায় একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। এর মাত্র দুই দিন আগে সড়ক দুর্ঘটনায় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ এবং এ দেশে টিভি সাংবাদিকতায় নতুন মাত্রা যোগ করার ক্ষেত্রে পথিকৃৎ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষক মিশুক মুনীর চলে গেলেন। আর তাঁদের সমাহিত করার আগেই চলে গেলেন উপমহাদেশের সংগীতজগতের আরেক দিকপাল ড. মৃদুল কান্তি চক্রবর্তী। আমাদের দেশে সংস্কৃতির অঙ্গনটি খুব বড় নয়। এত বড় শোক সইবার ক্ষমতা কি সেই অঙ্গনের আছে? তাঁদের শূন্যতা পূরণের তো প্রশ্নই ওঠে না।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের তথ্য অনুযায়ী, ড. মৃদুল কান্তি চক্রবর্তী ছিলেন আমার চেয়ে দুই বছরের ছোট, কিন্তু গুণে ও মেধায় ছিলেন আমার চেয়ে অনেক অনেক বড়। দেশপ্রেমেও তাঁর তুলনা হয় না। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের শিবিরে শিবিরে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি ও তাঁর বড় বোন রত্না চক্রবর্তী। গান শুনিয়ে শরণার্থীদের সান্ত্বনা দিয়েছেন, উজ্জীবিত রাখার চেষ্টা করেছেন। পথে পথে গান গেয়ে তহবিল সংগ্রহ করেছেন। পাশাপাশি 'বাংলাদেশ বুলেটিন' বিক্রি করেও সেই অর্থ মুক্তিযুদ্ধ তহবিলে জমা দিয়েছেন। ১৯৭২ সাল থেকেই তিনি বেতার ও টেলিভিশনে নিয়মিত শিল্পী হিসেবে সংগীত পরিবেশন করে আসছেন। ১৯৭৭ সালে তিনি সর্বভারতীয় যুব উৎসবে যোগ দিয়ে লোকগীতিতে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। রবীন্দ্রসংগীতের ওপর বিশ্বভারতী থেকে তিনি পিএইচডি করেছেন। তাঁর গবেষণাধর্মী গ্রন্থ 'হাছন রাজা, তাঁর গানের তরী' বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯২ সালে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী থেকে ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর আরেকটি গবেষণা গ্রন্থ_'বাংলা গানের ধারা'। ১৯৯৪ সালে তাঁর নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিভাগের যাত্রা শুরু হয়। সে কারণেই বহু গুণে গুণান্বিত এই মানুষটির অকালযাত্রাকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। আগের দুটি মৃত্যু হৃদয়ে যে ক্ষত তৈরি করেছিল, এবার সেই ক্ষতটি আরো বিশাল হয়েছে, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে। বেদনায় হৃদয়কে দলিত-মথিত করছে। সে বেদনা আরো বহু গুণে বেড়ে গেল যখন দেখলাম, ব্যবসার কাছে এত বড় একজন গুণী ব্যক্তিও কতটা অসহায়! খবরটিতে বলা হয়েছে, তিনি গুরুতর ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে স্বজনরা তাঁকে নিয়ে যান ল্যাবএইড নামের রাজধানীর নামকরা একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানে ভর্তির বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায়ই প্রায় একটি ঘণ্টা কেটে যায়। ইতিমধ্যে স্বজনরা রোগীর দেহে জরুরি ভিত্তিতে স্যালাইন প্রদানের জন্য বারবার অনুরোধ জানালেও হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকরা তাতে কোনো কর্ণপাতই করেননি। ফলে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে যায়। এরপর তাঁকে সিসিইউতে নেওয়া হলেও তা আর কোনো কাজে আসেনি। কেবল হাসপাতালের বিলের অঙ্কটাই স্ফীত হয়েছে। ড. মৃদুলের ভাগ্নে ডা. নির্ঝর ভট্টাচার্য নিজেও একজন চিকিৎসক। তিনি ল্যাবএইড হাসপাতালের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ এনে উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, হাসপাতালে আনার সঙ্গে সঙ্গে স্যালাইন চালু করা হলে ড. মৃদুলের এই অকালমৃত্যু রোধ করা যেত। আমরাও হয়তো ড. মৃদুলের মতো একজন গুণী মানুষকে এত তাড়াতাড়ি হারাতাম না। কিন্তু ব্যবসার কাছে মানবিকতার যে কোনো মূল্য নেই, ড. মৃদুলের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আবারও তা প্রমাণিত হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকসহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনেকেই চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ এনে এর বিচার দাবি করেছেন। তাঁর প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও এই ঘটনার বিচার দাবি করে সভা-শোভাযাত্রা করেছে। দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে হাইকোর্ট ল্যাবএইড হাসপাতালের চেয়ারম্যান, পরিচালক ও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে ২৩ আগস্ট সশরীরে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আরেকটি ঘটনায় ইবনে সিনা হাসপাতালের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদেরও একই দিনে আদালতে হাজির হতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে হাইকোর্ট বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে দ্রুত স্বাস্থ্যসেবা ও সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সে জন্য একটি নির্দেশনা (গাইডলাইন) তৈরি করতেও সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন। এ জন্য ১৪ দিনের মধ্যে ১০ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটিও করতে বলা হয়েছে।
দেশে নানা ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যের অনেক প্রসার ঘটেছে। চারদিকে কোটিপতির ছড়াছড়ি। শত শত কিংবা হাজার হাজার কোটি টাকার মালিকও অনেক। শুধু ব্যবসা নয়, শিল্প, কল-কারখানার আরো বিকাশ ঘটুক, আমরা তা চাইও। কিন্তু বাংলাদেশে ব্যবসার প্রসার ঘটছে ঠিকই, সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা থেকে নীতি-নৈতিকতা সব কিছুু যেভাবে দূরে সরে যাচ্ছে, সেটা আমাদের কাম্য নয়। ব্যবসার নামে এক শ্রেণীর বিবেকহীন মানুষের কারণে দ্রব্যমূল্য লাগামহীন, আমরা ভেজাল ও বিষযুক্ত খাবার হজম করে যাচ্ছি, শিক্ষা-ব্যবসার নামে শিক্ষার অধঃপতন ঘটিয়ে সার্টিফিকেট বিক্রি হচ্ছে, আরো কত কী! স্বাস্থ্যসেবা তথা মানুষের জীবন নিয়ে যে ব্যবসা, সেখানে যে কত অমানবিক কাজকর্ম চলছে, তা বলে শেষ করা যাবে না। অথচ রাষ্ট্র উদ্বেগহীন, নির্বিকার। তাই আমরা মনে করি, হাইকোর্টের এই নির্দেশগুলো অত্যন্ত সময়োপযোগী। এগুলো প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল।
এক ল্যাবএইড হাসপাতালের বিরুদ্ধেই এ ধরনের বহু অভিযোগ রয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে অন্তত জনা পাঁচেককে হাসপাতালটির বিরুদ্ধে একই অভিযোগ করতে শুনেছি। এ ছাড়া পত্রপত্রিকায় এসব নিয়ে অনেক খবরও বেরিয়েছে। আর সারা দেশে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বিরুদ্ধে অভিযোগের যেন কোনো শেষ নেই। অনেক ক্লিনিকে তো রীতিমতো অচিকিৎসকরাই রোগীদের চিকিৎসা করে যাচ্ছেন। অথচ সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বড় বড় কর্মকর্তা যেন 'নাকে তেল দিয়ে' ঘুমাচ্ছেন।
দেশের ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর অবস্থা তো আরো ভয়াবহ। রোগ পরীক্ষার নামে এদের বেশির ভাগই মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে, রোগীদের হত্যা করছে। আচ্ছা, ভাবুন তো দেখি, একজন বাবা তাঁর একমাত্র সন্তানকে বাঁচাতে সহায়-সম্বল বিক্রি করে ঢাকায় এলেন। চিকিৎসক কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিলেন। কিন্তু পরীক্ষা ঠিকমতো না হওয়ায় চিকিৎসা সঠিক হলো না। ছেলেটি মারা গেল। এরপর সেই বাবা কী করবেন? পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী যে বোঝা, অর্থাৎ ছেলের লাশ কাঁধে নিয়ে বাবা বাড়ি ফিরবেন। এ রকম হৃদয়বিদারক ঘটনা অহরহ ঘটছে। কারণ বেশির ভাগ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্রশিক্ষিত লোকজন বা টেকনিশিয়ান নেই বললেই চলে। পরীক্ষায় যেসব উপাদান (ইনগ্রেডিয়্যান্ট) ব্যবহার করা প্রয়োজন, তা করা হয় না। আবার অনেকে খরচ কমাতে মেয়াদোত্তীর্ণ উপাদান ব্যবহার করে। এসব সেন্টারে আগে থেকে প্যাথলজির একজন অধ্যাপকের সই করা রেজাল্ট শিট থাকে; সেগুলোতে যা খুশি লিখে রোগীর স্বজনদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। বিভিন্ন সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের হাতেও এ রকম বহু ঘটনা ধরা পড়েছে। এর আগে মালিবাগের পদ্মা ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ তিনটি নামকরা প্রতিষ্ঠানে ২১ ধরনের মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ পাওয়া গিয়েছিল, যার মধ্যে একটি ওষুধের মেয়াদ শেষ হয়েছিল ১৩ বছর আগে। এ ছাড়া ৭, ৮, ১০ বছর আগে মেয়াদোত্তীর্ণ কিছু ওষুধও পাওয়া গিয়েছিল। এগুলো ব্যবহার করে কি রোগ পরীক্ষার সঠিক ফল পাওয়া যাবে?
আমরা জানি না, আর কত নিচে নামব? নীতি-নৈতিকতাহীন ব্যবসার কাছে মানুষ আর কতকাল অসহায় হয়ে থাকবে? আর কত নিষ্ঠুরতা আমাদের দেখতে হবে? রাষ্ট্রের কাছে আমরা এর প্রতিকার চাই। মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো নিয়ে যেন ব্যবসার নামে লাগামহীন কর্মকাণ্ড না চলে, তার নিশ্চয়তা চাই। ড. মৃদুল কান্তি চক্রবর্তীর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। একই সঙ্গে শোকসাগরে নিমজ্জমান তাঁর পরিবার, স্বজন ও গুণগ্রাহীদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি।

লেখক : সাংবাদিক
fmahmud53@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.