ধর্ম-প্রিয়জনকে বই উপহার দিন by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

ইসলাম মানবজাতিকে কল্যাণকর পথের দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। সঠিক পথ অনুসরণ করতে পারলে নিশ্চিত হয় শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ জীবন। এ জন্য বিদ্যাশিক্ষা মানুষের একান্ত আবশ্যক বিষয়। প্রকৃত শিক্ষার অভাবে ইসলামের সার্থকতা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়। তাই বিজ্ঞজনেরা শিক্ষাহীন মানুষকে অন্ধের সঙ্গে তুলনা করেছেন।


যারা স্বাভাবিক জ্ঞানকে শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে সম্প্রসারিত করে প্রতিটি বিষয়ের তাৎপর্য বোঝার, নিজের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টায় লিপ্ত, তারা কখনোই অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিতদের সমান হতে পারে না। জগতে ভালো-মন্দের পার্থক্য নির্ণয় করার ক্ষেত্রে জ্ঞানার্জনের বিকল্প নেই। মহান সৃষ্টিকর্তা মুসলমানদের অনুসৃত প্রধান ঐশী ধর্মগ্রন্থের প্রারম্ভিক বাণীতেই পড়ার তাগিদ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনের সর্বপ্রথম নাজিলকৃত পাঁচটি আয়াতের চারটি আয়াতই পড়াশোনা শিক্ষা-বিষয়ক। ইরশাদ হয়েছে, ‘পাঠ করো! তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষকে জমাট রক্ত থেকে সৃষ্টি করেছেন। পাঠ করো! আর তোমার প্রতিপালক মহিমান্বিত। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না।’ (সূরা আল-আলাক, আয়াত-১-৫)
পৃথিবীর সব জ্ঞানের ভান্ডার হলো বই। এতে রয়েছে মানবজাতির ইতিকথা ও জ্ঞানের পথপ্রদর্শন। বই মানবজীবনের এক পরমহিতৈষী বন্ধু এবং জীবনসঙ্গী। বই ধর্মভীরু মানুষকে সৎপথ দেখায়, জীবনকে উন্নতির উচ্চশিখরে পৌঁছে দেয়।
পৃথিবীর উন্নতি সাধনে, আধুনিক জগতের প্রচার-প্রসারে এবং মানুষের মরণব্যাধির প্রতিরোধে, জীবন দানের ব্যাপারে ওষুধপত্রাদি আবিষ্কারের বাহন হচ্ছে মহামূল্যবান বই। দুনিয়ায় যাঁরা মরেও অমর হয়ে আছেন, সেই সব মহামানব, ধর্মীয় নেতা, জ্ঞানী-গুণীজন, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বৈজ্ঞানিক—সবাইকে এ বইয়ের মাধ্যমে আয়নাস্বরূপ দেখা যায়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা মানুষকে মহৎপ্রাণ করে তোলে, চিত্তকে মুক্তি দেয় এবং মানবাত্মাকে জীবনবোধে বিকশিত করে। বিভিন্ন বিষয়ে সুশৃঙ্খল ও পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানার্জন এবং পরিপূর্ণ মানসিক প্রশান্তি লাভ করতে হলে অবশ্যই বই পড়া দরকার। আবার প্রকৃত জ্ঞানের স্ব্বাভাবিক বিকাশ সাধনের জন্যও বই পড়া একান্ত প্রয়োজন। একজন পাঠক নিজস্ব পছন্দ ও রুচি অনুযায়ী বই নির্বাচন করে অগাধ জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশ করতে পারেন। একদিকে স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টিকে জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন; অপর দিকে বিদ্যার্জনের নির্দেশ প্রদান করেছেন। আল-কোরআনের শিক্ষার আলোকে ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) জ্ঞানার্জনের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, ‘বিদ্যা অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর ওপর ফরজ।’ (বায়হাকি)
মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান, ধর্ম-দর্শন, অনুরাগ-বিরাগ, আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং অন্তরের সত্য ও স্বপ্ন—সবকিছুর সমন্ব্বয়েই বিভিন্ন সাহিত্যের জন্ম। বই পড়া ছাড়া শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চার অন্য কোনো উপায় নেই। বই পড়ার নির্মল আনন্দ মানুষের মনে পুষ্টি জোগায়, তার ভেতরকার সুকুমার বৃত্তিগুলোকে প্রস্ফুটিত করে তোলে। মানুষের জন্য অকল্যাণকর বিষয় বর্জনের জন্য পবিত্র কোরআন ও হাদিসে একাধিবার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। সেই শিক্ষাই মানুষের জন্য অত্যাবশ্যক, যা তাদের প্রকৃত সত্যের আলো দেখায়, সরল-সঠিক পথে পরিচালিত করে এবং মানবতার কল্যাণ সাধন করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করে, তখন তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়; কিন্তু তিনটি আমলের সওয়াব জারি থাকে। ১. সাদকায়ে জারিয়া, ২. এমন বিদ্যা, যা থেকে লাভবান হওয়া যায় এবং ৩. সুসন্তান, যে তার জন্য দোয়া করে।’ (মুসলিম)
জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা-সংস্কৃতি ও শিল্প-সাহিত্য চর্চা শিক্ষার অন্যতম প্রধান অঙ্গ। যে জাতি মনের দিক দিয়ে বড় নয়, সেই জাতি জ্ঞানেও বড় নয়। সাহিত্য চর্চা ছাড়া কোনো ধর্মপ্রাণ জাতির সুস্থ মানসিকতা ও কল্যাণকর মনোভাব গড়ে উঠতে পারে না। তাই আদর্শ শিক্ষকসমাজ ছাত্রদের মনে জ্ঞানের কৌতূহল সৃষ্টি এবং বুদ্ধিবৃত্তিক প্রজ্ঞাকে সদাজাগ্রত রাখতে পারেন, তাঁর আত্মাকে উদ্বোধিত করে জ্ঞান পিপাসায় উন্মত্ত করতে পারেন; একে নিবৃত্ত করতে হলে পাঠ্যাভ্যাসের বিকল্প নেই। মানুষের মনে আনন্দ সঞ্চার করার জন্য সুশীল সাহিত্যের অনুশীলন প্রয়োজন। আনন্দে মানুষের আত্মা সতেজ হয়, জীবনীশক্তি বৃদ্ধি পায়। আসমানি কিতাব বা ঐশী গ্রন্থের মাধ্যমে যেভাবে মানবজাতি আল্লাহর পরিচয় ও দিকনির্দেশনা পায়, প্রয়োজনে মানুষ পার্থিব বইয়েও জাগতিক বিভিন্ন বৈষয়িক জ্ঞান অর্জন করতে পারে। মহাগ্রন্থ আল-কোরআন সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘এটি সেই গ্রন্থ; এতে কোনো সন্দেহ নেই, মুত্তাকিদের জন্য এটা পথপ্রদর্শক।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-২)
রুচিশীল সাহিত্যের বিস্তৃত পরিসরে বিচরণের মাধ্যমেই আল্লাহভীরু মানুষের চরিত্রের মহৎ গুণাবলি ও সামাজিক মূল্যবোধ অর্জিত হয়ে থাকে। এমন মহৎপ্রাণ ব্যক্তিরা তাঁদের উন্নত চিন্তা-চেতনা এবং মেধা-মননশীলতাকে কাজে লাগিয়ে দেশ ও জাতির অনেক বৃহত্তর কল্যাণ সাধন করতে পারেন। নির্জীব জাতির মনে সজীবতা দান করতে হলে অধ্যাত্ম চেতনা প্রয়োজন। তাই ধর্মীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ঢাকার বাংলা একাডেমীতে মাসব্যাপী একুশের গ্রন্থমেলা চলে। এ ছাড়া বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে পবিত্র কোরআন, হাদিসসহ ইসলামি বই ক্রয়-বিক্রয়ের মনোরম দোকান বসে। লেখক ও প্রকাশকেরা প্রতিবছর নিত্যনতুন জ্ঞানভিত্তিক সৃজনশীল বই প্রকাশের মাধ্যমে গ্রন্থ ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করছেন। একটি আলোকিত সুশীল সমাজ গঠনের লক্ষ্যে জনগণের মধ্যে পাঠ্যাভ্যাস বাড়ানোর আন্দোলন গড়ে তোলা বাঞ্ছনীয়। দেশের জাতীয় পত্র-পত্রিকা, বেতার-টিভি চ্যানেলসহ সব মিডিয়ায় অমর একুশের ভাষাশহীদদের সুমহান আত্মত্যাগের স্মরণে বই কেনা-পড়া ও সংগ্রহ করার উৎসাহ প্রদানের ব্যাপক প্রচারাভিযানের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তাই আসুন, প্রাত্যহিক জীবনে অযথা খরচ বা অহেতুক অর্থ অপচয় বর্জন করে গ্রন্থমেলা থেকে নিজেদের পছন্দমতো বই-পুস্তক ক্রয় করি; দেশের নারী-পুরুষ, তরুণ-যুবক, শিশু-কিশোরদের বই কেনা, প্রিয়জনকে বই উপহার দেওয়া ও বই সংগ্রহের জন্য উৎসাহিত করি, যাতে সব বাংলা ভাষাভাষী কোটি কোটি জনগোষ্ঠীর বই পড়ার মানসিকতা তৈরি হয়।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ অ্যান্ড দাওয়াহ, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.