অহংবোধে ধাক্কা এবং ব্রিটিশ সমাজে গর্বিত অভিবাসীরা by ফারুক যোশী

বলতে গেলে ব্রিটিশ সমাজে একটা চিড় ধরেছে। তাদের সভ্যতায়, তাদের অহংবোধে ধাক্কা লেগেছে। ৬, ৭, ৮ ও ৯ আগস্টের দাঙ্গা এবং লুটপাটে তাদের মূল্যবোধে ঘা লেগেছে। ব্রিটিশ সমাজব্যবস্থার একটা অহংকার ছিল। সভ্যতার ধ্বজা উড়িয়ে বিশ্বময় তারা নিজেদের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে যুগ যুগ ধরে। কিন্তু রাজনৈতিক নীতিহীনতায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে খবরদারি করতে গিয়ে মিলিয়ন-ট্রিলিয়ন পাউন্ডের ব্যয়ভার যেন সহ্য করতে পারছে না ব্রিটেন।


বিশ্বমন্দার প্রভাব ব্রিটেনকে করেছে কাবু। এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর পৌনঃপুনিক ব্যয় সংকোচনে যেন হাঁপিয়ে উঠেছে ব্রিটেনের জনগণ। সত্যি বলতে কি, বিশেষ করে শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গ একটা গোষ্ঠী বলতে গেলে আছে দারিদ্র্যসীমার প্রান্তে। এদের কাজ নেই। বাধ্যতামূলক শিক্ষার জন্য এই গোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ব্রিটেনের মতো একটা আধুনিক সমাজে এরা বেড়ে উঠতে পারছে না সুশিক্ষার আলো নিয়ে। তাই তো এরা জড়িয়ে পড়ছে অপরাধপ্রবণতায়। এই অপরাধপ্রবণতা ব্রিটিশ সমাজটাকেই যে কিভাবে প্রভাবিত করছে, তার প্রমাণ আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের লুটপাট এবং রায়ট বা দাঙ্গা।
এই দাঙ্গায় একটা ব্যাপার পরিষ্কারভাবে আবারও ফুটে উঠেছে। আর তা হলো, কিভাবে অভিবাসী সমাজ নিজেদের গুটিয়ে রাখছে। কিভাবে এই অভিবাসী, বিশেষ করে এশিয়ান এবং মুসলিম জনসাধারণ নিজেদের ছেলেমেয়েদের একটা বন্ধনের মধ্যে ধরে রাখতে পেরেছে। যখন দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে সারা লন্ডনে, লুট হতে থাকে একের পর এক বিশ্বের নামিদামি দোকানগুলো। লন্ডন থেকে শুরু করে বার্মিংহাম, লিভারপুল, ম্যানচেস্টার, ব্রিস্টল প্রভৃতি শহরে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী ভাঙছিল একের পর এক সুসজ্জিত ঝলমলে সুপারস্টোরগুলো। সারা বিশ্বের মানুষ দেখেছে, সেখানে এশিয়ান কিংবা মুসলিম তরুণ-তরুণীর কেউই এই দাঙ্গায় জড়ায়নি। বরং লন্ডনের বাঙালি এমপি রুশনারা আলী কিংবা টাওয়ার হ্যামলেটস বারের নির্বাহী মেয়র লুৎফুর রহমান তাঁদের এলাকার এই দাঙ্গা মোকাবিলার চেষ্টা করেছেন, কমিউনিটির সঙ্গে থেকেছেন। অভিভাবকরা পালন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। দাঙ্গার সুযোগ নিয়ে চরমপন্থীরা ইস্ট লন্ডন মসজিদকে দাঙ্গার আগুনে পোড়ানোর পাঁয়তারা চালালেও কমিউনিটির মানববন্ধন তা হতে দেয়নি। এই সমাজে বিচ্ছিন্নভাবে অনেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে, কমিউনিটির সঙ্গে একাত্ম হয়ে দাঙ্গাবাজদের রুখতে চেয়েছে। কেউ পেরেছে, কেউ পারেনি। কিন্তু এশিয়ানরাই পেরেছে। শিখ কমিউনিটি তাদের ঐতিহ্যের তলোয়ার নিয়ে নিজ কমিউনিটিতে পাহারা বসিয়েছে, নিরাপদ রেখেছে। বার্মিংহামে পাকিস্তানি জনগোষ্ঠীর তিন যুবক পর্যন্ত প্রাণ দিয়েছে ব্রিটিশ সমাজব্যবস্থার মূল্যবোধকে টিকিয়ে রাখতে। যেখানে শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গ কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা চুরি-ডাকাতি ও ভাঙচুর চালিয়েছে, মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ডের মালামাল লুণ্ঠন করেছে, সেখানে আমাদের এই বয়সী তরুণরা মানবঢাল তৈরি করেছে, জীবন দিয়েছে। একজন অভিবাসী এশিয়ান কিংবা মুসলিম হয়ে ব্রিটিশ সমাজে একজন দেশপ্রেমিক ব্রিটিশ হিসেবে টিকে থাকার এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর কী হতে পারে? কারণ, এখন পর্যন্ত উল্লেখ করার মতো একজন এশিয়ানকেও কাঠগড়ায় তুলতে পারেনি ব্রিটিশ পুলিশ। বরং ব্রিটিশ সমাজকে রক্ষা করতে গিয়ে আছে বিসর্জনের জ্বলন্ত উদাহরণ, যা মূল ধারার গণমাধ্যমে এখন এক উচ্চারিত সত্য এবং গর্বের বিষয়।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, কমিউনিটির কথা বলে ব্রিটেনের বাংলা টিভি চ্যানেলগুলো তাদের ব্যবসার পসার বাড়ালেও ব্রিটেনের এই আতঙ্কে তারা যেন ছিল নীরব। সারা ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে চলছে লুটেরাদের রাজত্ব। টাওয়ার হ্যামলেটসের মানুষ ছিল আতঙ্কিত। প্রতিক্রিয়াশীল দাঙ্গাবাজরা সুযোগ নিতে চাইছে। ইস্ট লন্ডনে তারা এসেছে। আগুন লাগাতে চাইছে। অথচ আমাদের বাংলা টিভি চ্যানেলগুলো (দু-একটি চ্যানেল ছাড়া) কোনো ব্রেকিং নিউজ পর্যন্ত প্রচার করেনি। তারা মেতে রয়েছে সেই উন্মাদনায়, চাঁদা তোলায়। যেসব চ্যানেল কথায় কথায় টকশো করে, জ্ঞান দেয় কমিউনিটিকে, সেগুলো কমিউনিটির এই আতঙ্কজনক সময়ে কোনোই উদ্যোগ নেয়নি টকশোর। উদ্যোগ নেয়নি যথাযথভাবে কমিউনিটির সহযাত্রী হওয়ার। নিঃসন্দেহে বলতে হয়, চ্যানেলগুলোর এ এক ব্যর্থতা।
২. সম্প্রতি ব্রিটেন এমন কিছু ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে, যা এর আগে তাদের ফেইস করতে হয়নি। যেমন_লন্ডনের ছাত্র বিক্ষোভ ব্রিটেনের রাজনীতিতে আনে এক নতুন মাত্রা। ছাত্রদের দাবি আদায়ের ঘটনায় এমন ভাঙচুর গেল অর্ধশতাধিক বছরেও প্রত্যক্ষ করেনি ব্রিটিশ জনগণ। নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ডের ফোন হ্যাকিংয়ের ঘটনা ব্রিটিশ সমাজকে কাঁপিয়ে তুলেছে, যে কাঁপন এখনো শেষ হয়নি। আর অতি সম্প্রতি ব্রিটেন প্রত্যক্ষ করল এমন এক ভয়ঙ্কর অবস্থা, যা এ জাতি ইতিপূর্বে দেখেনি। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনও বলেছেন একই কথা। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীসহ সবাই বলেছেন, ব্রিটেন লুটপাটকারীদের বিচার চায়। কিন্তু আশঙ্কা তো পিছু ছাড়ছে না। কারণ, এখন পর্যন্ত আটক হওয়া ১২ শতাধিক ব্যক্তির মধ্যে অনেকেই কিশোর-কিশোরী। তাদের বিচার কী হবে। কারণ, আইন তো তাদের জেলে পাঠায় না। বরং তাদের পাঠিয়ে দেয় পুনর্বাসন সেন্টারে। সেখানে তারা আদরের সঙ্গেই থাকে। যদিও ডেভিড ক্যামেরন বলেছেন, যারা এ রকম অপরাধ সংঘটিত করার মতো প্রাপ্ত বয়স হয়েছে, তারা বিচারের মুখোমুখি হওয়ার জন্যও প্রাপ্ত বয়স্ক (অর্থাৎ, বয়স নয়, অপরাধটাকেই চিহ্নিত করেছেন তিনি)। কাউকে যেন ছাড় দেওয়া না হয়, এ আহ্বানই রেখেছেন ডেভিড ক্যামেরন। এর বিচার হওয়া প্রয়োজন। কারণ, এ আতঙ্ক সংক্রমিত হয়েছে। দেশের যেকোনো একটা ইস্যুকে কেন্দ্র করে যেকোনো সময়ই এ রকম জ্বলে উঠতে পারে ব্রিটেন। তাই তো গুরুতর অপরাধ প্রবণতায় জড়িত কিশোর-কিশোরীদের ব্যাপারে প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়নের চিন্তা-ভাবনা করতে হবে হয়তো ব্রিটেনকে। উল্লেখ করা যেতে পারে, আইনের যথাযথ প্রয়োগেই ইংল্যান্ডে এখন নাইফ-ক্রাইম (চাকু-চুরির অপরাধ) কিছুটা হলেও হ্রাস পেয়েছে।
৩. যেভাবেই দেখা হোক না কেন, ব্রিটেনের সাম্প্রতিক এই লুটপাট দেখিয়ে দিল, কী ঠুনকো এক আবরণে ব্রিটেনের সমাজব্যবস্থা এতদিন টিকে ছিল। কিভাবেই বা বেড়ে উঠছে একটি শ্রেণী, যারা এমনকি শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। যারা লুট করেছে, মনে হয়েছে, তারা বঞ্চিত। উন্নত সমাজব্যবস্থা, এখানে আছে সবকিছুর একটা জৌলুস। আর এই জৌলুসের কাছে ওই_অ্যাংরি বলি আর লোভী বলি কিংবা দুর্বৃত্তই বলি না কেন, মনে হয়েছে_তারা যেন কোথায় এক বঞ্চনার শিকার। এই বঞ্চনা কি ক্ষোভ সৃষ্টি করেছিল? এই বঞ্চনা তাদের প্রতিবাদী হতে শেখায়নি কিংবা এ দেশের প্রচলিত পুঁজিবাদী সমাজ বা রাজনীতি তাদের প্রতিবাদী করে তুলতে পারেনি। তারা তাদের অধিকারের কথা বলতে শেখেনি, বরং তারা হয়েছে অপরাধী। তাই তো একজন অপরাধীকে গুলি করে হত্যার পরও সভ্য সমাজে অপরাধীরাই লুটপাট চালিয়েছে, চালিয়েছে তাণ্ডব। সারা দেশময়। ওরা চুরি শিখেছে। তাই তো তারা টার্গেট করেছে ডিজাইন, কম্পিউটার গেমস, ল্যাপটপ, ভালো ব্র্যান্ডের কাপড় প্রভৃতির দোকান।
আমরা জানি, বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই হবে অপরাধীদের। ব্রিটেন কিংবা সরকার এতে ছাড় দেবে না। কারণ তারা চাইবে না, ব্রিটেনে তা ঘটুক বার বার। কিন্তু এই দাঙ্গা ব্রিটেনকে যা জানিয়ে দিয়ে গেল, তা কি ব্রিটেন ভেবে দেখবে? মনে রাখতে হবে, ব্রিটেনের ৭৫ শতাংশেরও বেশি লোক মনে করে, এটা দাঙ্গা বা রায়ট নয়, এ এক লুটপাট। রায়ট বা দাঙ্গা মূলত ব্রিটেনে যা হয়েছে বিভিন্ন সময়, তা ছিল কমিউনিটির একটি নির্দিষ্ট ইস্যু কিংবা টিকে থাকার জন্য সংঘবদ্ধ সংগ্রাম। আর গত সপ্তাহে যা ঘটেছে, তা মূলত ব্রিটেনের গ্যাং কালচারের একটি অংশ মাত্র। এই গ্যাং সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দারিদ্র্যের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর জীবনমান বৃদ্ধিতেই সরকারকে আরো বেশি মনোযোগী হতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে তথাকথিত সন্ত্রাস প্রতিরোধের জয়গান গেয়ে মিলিয়ন-ট্রিলিয়ন পাউন্ডের ব্যয়ভার নিয়ে ব্রিটেন এখন চাকরি-সঙ্কটের দেশ হয়ে যাচ্ছে। আর এই শূন্যতায় ব্রিটেন এখন তার ঘর সামলাতেই যেন হিমশিম খাচ্ছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে ব্রিটেনকে।
লেখক : লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক, Faruk.joshi@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.