সময়ের প্রতিধ্বনি-নিদারুণ কষ্টে সাধারণ মানুষ by মোস্তফা কামাল

এ বছর মূল্যস্ফীতির হার সর্বোচ্চ। মূল্যস্ফীতির সারমর্ম বোঝা হয়তো সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে এটা স্পষ্ট, লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম। কখন কোন জিনিসের দাম বাড়বে তা কেউ জানে না। হঠাৎ হঠাৎ এক একটা জিনিসের দাম বেড়ে যায়।
আর এতে কষ্ট বাড়ে সাধারণ মানুষের। স্বল্প ও সীমিত আয়ের মানুষের সংসার যেন আর চলছে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে পারছে না তারা। মাস ফুরোনোর আগেই পকেট হয়ে যায় গড়ের মাঠ! অর্ধেক মাস হয়তো কোনোমতে চলে। বাকি অর্ধেক ধারকর্জ করে চালাতে হয়। কারো কারো বাড়ে ঋণের বোঝা! কী আর করা! বাড়ি ভাড়া, খাওয়াদাওয়া, ছেলেমেয়ের পড়ার খরচ! দুশ্চিন্তায় ঘুম আসে না গৃহকর্তার। ভোর হলেই স্ত্রী বাজারের ফর্দ হাতে তুলে দেবেন। কিন্তু বাজার করার পয়সা কোথায়!
সরকার দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানতে পারছে না। অথচ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে এক নম্বর প্রতিশ্রুতি ছিল দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। অর্থাৎ জিনিসপত্রের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা। একই সঙ্গে প্রতিটি পরিবারের অন্তত একজন সদস্যের চাকরির ব্যবস্থা করবে বলেও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। অথচ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতি আস্থাশীল হয়ে মহা উৎসাহে দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা ভোট দিয়েছিল। এখন যদি মানুষ বলে, জনগণকে আওয়ামী লীগ মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তাহলে কি জবাব দেবেন নেতারা? যাঁরা গ্রামে যান তাঁরা নিশ্চয়ই জনগণের দুঃখকষ্ট টের পান।
উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কোনো জিনিসের দাম পাঁচ পয়সাও যদি বাড়ানো হয় তাহলে অনেক আগে থেকেই বিষয়টি জনগণকে মিডিয়ার মাধ্যমে জানানো হয়। বারবার জনগণের কাছে তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয় এবং দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এসবের তোয়াক্কা কেউ করেন? যাদের ভোটে নেতারা মসনদে বসেন ক্ষমতার মোহে তাঁরা তাদের কথা বেমালুম ভুলে যান।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর আমরা দেখলাম, বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দ্রব্যমূল্য যাচাই-বাছাই করলেন। ফোন নম্বর দিয়ে এলেন। কিন্তু সেই নম্বরে ফোন করে কেউ কোনো দিন তাঁকে পায়নি। পুরো ব্যাপারটাই ছিল লোক দেখানো এবং হাস্যকর। তারপর দেখলাম, ফারুক খান ব্যবসায়ীদের ডেকে হুমকি-ধমকি দিয়ে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করলেন। তিনি ব্যবসায়ীদের বললেন, 'আপনারা কি মগের মুল্লুক পেয়েছেন, যা খুশি তা করবেন?' আর এতে ফল হলো উল্টো। ব্যবসায়ীরা খেপে গেলেন। তাঁরা নানা কারসাজি করে জিনিসপত্রের দাম আরো বাড়িয়ে দেন। বাজার হয়ে ওঠে বেসামাল। কিন্তু সামাল দেওয়ার যেন কেউ নেই। মন্ত্রী বনাম ব্যবসায়ীদের দ্বন্দ্বের শিকার হলো সাধারণ মানুষ।
এটাও ঠিক, আমাদের ব্যবসায়ীরা শুধু মওকা খোঁজেন। কোনো একটা ছুতা পেলেই জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেন। এটা অতি মুনাফাখোরী প্রবণতা। আমাদের ব্যবসায়ীরা যে মুনাফাখোর এ কথা বেশ জোর দিয়েই বলেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বড় ব্যবসায়ী সবাই চোখের পলকে বড়লোক হয়ে যেতে চান। একজন পান দোকানদারও কোটি টাকার মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। হ্যাঁ, যেকোনো মানুষেরই স্বপ্ন দেখার অধিকার আছে। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু সব কিছুই বাস্তবতার নিরিখে বিবেচনা করতে হবে। সেই বিবেচনাবোধ কি আমাদের ব্যবসায়ীদের আছে? তাঁরা এ দেশের আলো-বাতাসে বড় হন, এ দেশে থাকেন এবং এ দেশের খাবার খান আর নিজেদের স্বার্থ দেখেন। তাঁদের অভিধানে দেশের স্বার্থ বলে কোনো শব্দ নেই।
এ রকম মুনাফাখোরী ব্যবসায়ীকে একের পর এক অতি মুনাফা হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে সরকার। এ ক্ষেত্রে সাম্প্রতিককালের কিছু বিষয় উপস্থাপন করা যেতে পারে। সরকার প্রথমে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব সরাসরি বাজারে না পড়লেও সাধারণ মানুষের ওপর অতিরিক্ত বিলের বোঝা চেপেছে। বিদ্যুৎ খাতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা। কিন্তু এ খাতে আশানুরূপ উন্নতি এখনো আসেনি। অথচ দাম বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুতের সংযোগ চেয়ে লাখ লাখ গ্রাহক আবেদন করে অপেক্ষায় আছে। সংযোগ পাচ্ছে না। শিল্পায়নের জন্য বিদ্যুৎ দেওয়া যাচ্ছে না। অথচ দাম বাড়িয়ে গ্রাহকদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। এর কিছুদিন পর জ্বালানি তেল ও সিএনজির দাম বাড়ানো হয়েছে। তেলের দাম তো রয়েসয়ে, সিএনজির দাম বাড়ানো হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এতে শুধু যে প্রাইভেট গাড়ির মালিকদের অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হচ্ছে তা নয়, এর প্রভাব পড়েছে বাজারে। গণপরিবহনের অবস্থা তো যাচ্ছেতাই।
মুটেমজুর থেকে বিত্তশালী সবাইকেই যানবাহনে চড়তে হয়। সেটা পাবলিক বাস হোক আর সিএনজি অটোরিকশা হোক। এখন ভাড়ার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। যে যেভাবে পারছে ভাড়া আদায় করছে। জোরপূর্বক ভাড়া আদায়ের কারণে যাত্রী ও বাস কন্ডাকটরদের মধ্যে মারামারি, ধস্তাধস্তি পর্যন্ত হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যাত্রীরা হয়রানির শিকার হচ্ছে। কিন্তু এগুলো দেখার কেউ নেই। মানুষের ভোগান্তির বিষয়টি পরীক্ষার জন্য একজন প্রতিমন্ত্রী যাত্রীবেশে বাসের টিকিট কেটেছিলেন। ভাড়া বাড়ানোর ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে এ ধরনের লোক দেখানো যাত্রী হওয়ার কি কোনো দরকার ছিল? সরকার সিএনজির দাম বাড়াতেই পারে। এ ক্ষেত্রে সরকারের উচিত ছিল আগে থেকে বাসমালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে ভাড়া নির্ধারণ করা। পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া সিএনজির দাম বাড়িয়ে পরিবহন খাতকে পুরোপুরি অস্থিতিশীলতার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এক ধরনের অরাজক অবস্থা চলছে। বাসমালিকরা নিজেদের খেয়ালখুশি মতো ভাড়া বাড়িয়ে চলেছেন।
এখন শোনা যায়, কোনো কোনো মন্ত্রী বেনামে পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাঁদের কারণেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী অসহায় হয়ে পড়েছেন। বাসমালিকদের ওপর কোনো ধরনের চাপ সৃষ্টি করতে পারছেন না। এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে অরাজক অবস্থা তো হবেই।
প্রসঙ্গক্রমে পাকিস্তানের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল। রিপোর্টিংয়ের কাজে আমি তখন পাকিস্তানে ছিলাম। জেনারেল পারভেজ মোশাররফ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। বিভিন্ন দলের মৌসুমি নেতাদের নিয়ে গঠিত তাঁর মন্ত্রিসভার বেশির ভাগ সদস্যই ছিলেন ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত। হঠাৎ পাকিস্তানে আটার দাম বেড়ে গেল। আটা পাকিস্তানের প্রধান খাদ্যদ্রব্য। আটার দাম বাড়লে সব মানুষই আক্রান্ত হয়। সংগত কারণেই দেশটির গণমাধ্যম সক্রিয় হয়ে উঠল। পরে সাংবাদিকরা অনুসন্ধান করে বের করলেন, সে দেশের খাদ্যমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার আরো কয়েকজন সদস্যের ২৫টি আটার মিল রয়েছে। তাঁরা কারসাজি করে আটার ঘাটতি দেখিয়ে দাম বাড়িয়েছেন। কিন্তু মোশাররফ সরকার কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। এর ফলে মোশাররফ সরকার বেশ সমালোচনার মুখে পড়েছিল।
আমাদের দেশে কোনো মন্ত্রী যদি সত্যি সত্যি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকেন তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। মন্ত্রিসভার একজন সদস্যও যদি অন্যায়, অনৈতিক কাজ করেন তাহলে তাঁর সব দায় চাপে পুরো সরকারের ওপর। এ জন্য সরকারকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। কখনো কখনো চরম মূল্যও দিতে হয়। কারণ এই বিষয়গুলো খুবই স্পর্শকাতর। সাধারণ মানুষ যদি টের পায়, তাদের ইস্যুগুলো নিয়ে সরকার হেলাফেলা কিংবা ছলচাতুরির আশ্রয় নিচ্ছে তাহলে তারা সুযোগমতো মুখ ফিরিয়ে নেবে। আর একবার মুখ ফেরালে কিন্তু দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসা কঠিন হয়ে যাবে।
গত সোমবার কালের কণ্ঠের প্রধান শিরোনাম ছিল, 'সয়াবিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর পাঁয়তারা'_খবরটি পড়ে নিশ্চয়ই প্রত্যেক পাঠক নড়েচড়ে বসেছেন অথবা বিস্মিত হয়েছেন। এটাও কি সম্ভব? হ্যাঁ, ভোজ্য তেলের মিল মালিকরা এ রকম একটি প্রস্তাব সরকারের কাছে দেবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। দাম বাড়ানো ইস্যুতে ব্যবসায়ীরা মোটামুটি এক জোট। এখানে কোনো দল নেই। তাদের মূলমন্ত্র হচ্ছে অতি মুনাফা। সরকারের কী সমালোচনা হলো কিংবা বিপদে পড়ল সেদিকে তাঁদের ভ্রূক্ষেপ নেই। এসব নিয়ে তাঁরা চিন্তাও করেন না। তাঁদের দ্রুত বিত্তবৈভবের মালিক হওয়া দরকার। সেটা যে কৌশলেই হোক তাঁরা করবেন। যত চাপ আমজনতার ওপর। এই আমজনতাকে শুধু ভোটের সময় দরকার হয়। বাকি সময় তাদের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। তাই তারা পাঁচ বছর কেবল অপেক্ষায় থাকে। তারা মনে মনে শুধু বলে, সময় নিশ্চয়ই ফুরোবে। তখন আমজনতার কাঠগড়ায় শাসকদলকে দাঁড়াতেই হবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
calumniamkamalbd@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.