মানবাধিকার-বঞ্চনা, যন্ত্রণা ও অভিশাপ by স্বপন কুমার দেব

স্বাধীন দেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা স্থান পেলেও বাস্তবে সংখ্যালঘুদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি। কুখ্যাত শত্রু সম্পত্তি আইন বিলুপ্ত না হয়ে নাম বদলে হয়ে যায় অর্পিত সম্পত্তি/অনাগরিক বা ভিপি আইন এবং দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে অর্পিত সম্পত্তির তালিকা শাসককুল যে সময় যারাই ক্ষমতায় থাকেন তারা একবাক্যে বলে থাকেন_ এ দেশে সংখ্যালঘুরা শান্তিতে বসবাস করছেন ও ধর্মকর্ম পালন করছেন। কোনো সাম্প্রদায়িকতা ও ঝুট-ঝামেলা নেই।
বাস্তবে সংখ্যালঘুদের মনের কথা সরকারি বক্তব্যের অনেকটাই বিপরীত। এ দেশে মূলত ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু নির্ধারণ করা হয়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বড় অংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তারপর বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান। এ ছাড়া জাতিগত দিক থেকেও সংখ্যালঘু নির্ধারিত হয়ে থাকে। আদিবাসী জনগোষ্ঠী যথা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে বসবাসকারী পাহাড়ি জনগোষ্ঠী এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলে, বিশেষ করে ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলের খাসিয়া, গারো, হাজং ইত্যাদি জনগোষ্ঠী এবং উত্তরাঞ্চলের সাঁওতালসহ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কয়েকটি গোষ্ঠী এ দেশে বসবাস করছে। এসব আদিবাসী বা বর্তমান সরকারের ভাষায় ক্ষুদ্র নৃতাত্তি্বক জনগোষ্ঠী বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এ ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে দুই ভাগে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। যেমন মুসলমান জনগোষ্ঠীর বিপরীতে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান জনগোষ্ঠী। আবার বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিপরীতে আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃতাত্তি্বক জনগোষ্ঠী। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ছিল সাত থেকে সাড়ে সাত কোটি। তবে মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবার মিলিত অংশগ্রহণে। দেশ স্বাধীন হলে বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম মূল ভিত্তি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। স্বাধীন দেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা স্থান পেলেও বাস্তবে সংখ্যালঘুদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি। কুখ্যাত শত্রু সম্পত্তি আইন বিলুপ্ত না হয়ে নাম বদলে হয়ে যায় অর্পিত সম্পত্তি/অনাগরিক বা ভিপি আইন এবং দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে অর্পিত সম্পত্তির তালিকা। সংখ্যালঘুরা নতুনভাবে কৃষিজমি, ভিটেমাটি হারান স্বাধীন বাংলাদেশে। এ কালো আইন বিলুপ্ত হওয়া এখন স্বপ্নেরও অতীত। সরকার ইতিমধ্যে নতুন জরিপে সব শত্রু/অর্পিত সম্পত্তি সরকারের খাস নামে রেকর্ড করিয়ে নিচ্ছে। এমনকি এ ক্ষেত্রে আদালতের ডিক্রিরও কোনো তোয়াক্কাই তারা করেন না। ভিপি আইন অদল-বদলে সরকার আদৌ আন্তরিক নন। ইতিমধ্যে প্রস্তাবিত নতুন আইন হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ প্রত্যাখ্যান করেছে। '৭৫-পরবর্তী পটপরিবর্তনের পর সংবিধান থেকে উঠে যায় ধর্মনিরপেক্ষতা। যা এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকারও যথাযথভাবে পুনঃস্থাপন করতে সাহসী কিংবা আন্তরিক নন। '৭৫-পরবর্তী সংখ্যালঘুরা ক্রমে ক্রমে অধিক দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হন। চাকরি-বাকরি, উচ্চশিক্ষা, অধিকার এবং মর্যাদার ক্ষেত্রে তারা নানাভাবে অবহেলিত, নির্যাতিত এবং বঞ্চিত হতে থাকেন। বিভিন্ন চাকরির ও শিক্ষার ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা এখন মেধা অনুযায়ী সুযোগ পাওয়ার পরিধি বেড়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে কোটা নির্দিষ্ট রাখলে মঙ্গলজনক হবে। দেশ রক্ষা তথা সামরিক বাহিনীতে সংখ্যালঘু অফিসার ও সৈনিকদের সংখ্যা হাতে গোনা যাবে। যে কোনোভাবেই হোক তারা বাদ পড়ে যান। কর্তৃপক্ষ যথাযথ দৃষ্টি দিলে অবশ্যই সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের এড়িয়ে যাওয়া হয়। তেমনি অবস্থা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও। ধরে নেওয়া হয় সংখ্যালঘু মানে আওয়ামী লীগ। কথাটি সত্য। ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীগের খাঁটি সমর্থক। বাহ্যিকভাবে আওয়ামী লীগের নীতি সংখ্যালঘুদের প্রতি সহানুভূতিশীল। বিএনপি পণ করে বসে আছে সংখ্যালঘুদের এড়িয়ে চলবে এবং মাঝে মধ্যেই সংখ্যালঘুদের সেন্টিমেন্ট আহত হয় এমন কথা বলবে। এটি একটি ভুল ধারণা। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু সবার ভোটই বিপুল পরিমাণ পেয়েছে। নির্বাচনে দ্রব্যমূল্য, দুর্নীতি, বেকারত্ব, প্রকৃত উন্নয়ন ইত্যাদি জয়-পরাজয়ের মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিএনপি নীতি পরিবর্তন করে সংখ্যালঘুদের প্রতি উদারনীতি গ্রহণ করলে সংখ্যালঘুরা অবশ্যই তাতে সাড়া দেবেন। তারা বিকল্প চিন্তার সুযোগ পাবেন।
সংখ্যালঘুদের যেসব ফোরাম আছে তারাও সময় উপযোগী নেতৃত্ব দিতে পারছে না। সংখ্যালঘুরা যেমন নিজেদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হতে হবে তেমনি সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীকে এতে শামিল হতে হবে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংখ্যালঘুরা অধিক নিরাশ হয়েছেন। রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলগুলোর উদার চিন্তার বিকাশ না ঘটলে সমস্যা আরও জটিল হবে। ভোট পাওয়ার হিসেবে সবকিছু সাজানো উচিত নয়। সংখ্যালঘুদের মাঝে সুবাতাস বইয়ে দেওয়ার দায়িত্ব সবার।

স্বপন কুমার দেব : আইনজীবী

No comments

Powered by Blogger.