কাল রঙ্গ-'তুঁই' বেড়াল না 'মুঁই' বেড়াল! by হিলাল ফয়েজী

একালের ভাষায় ছড়াটি 'ফাটাফাটি'। গেল বছর যখন বরিশালের ছাওয়াল প্রবীণ 'গণ-গাওয়াল' (গণ-গাইয়ে) প্রতুল মুখোপাধ্যায় প্রায় ষাট বছর পর নিজভূমে 'ভিনদেশী' হয়ে এলেও তাঁর কণ্ঠে ছড়াটি নিল ভিন্নমাত্রা! 'তুঁই' বেড়াল না 'মুঁই' বেড়াল।


ওবামা বিশ্বরাজ বয়সে হাফ সেঞ্চুরি না করতেই এমন ক্ষমতার অধীশ্বর হবেন ভাবতে পারেননি নিশ্চয়ই। তিনি ক্ষমতায় আসার আগে আভিধানিক অর্থে তাঁর দেশে জঙ্গল (বুশ) রাজত্ব চলছিল। তরুণেরা মেতে উঠল আমেরিকায়, উন্মাতাল, দশ-বিশ ডলার করে চাঁদায় চাঁদায় মিলিয়ন মিলিয়ন তহবিল গড়ে দিলেন তরুণ ওবামার নির্বাচনী ভাণ্ডারে। তারুণ্যের জয়। বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামের জয়। রসিকতা করে একজন বললেন, 'ওবামা' শব্দের ভেতর 'বাম' রয়েছে। তিনি বাম হাতে লেখেন। মার্কিনি হুল্লোড়ে বিধি বাম হলো হিলারি ম্যাডাম আর রিপাবলিকানদের।
বুশ রাজত্বের সময় কোনো এক ১১ সেপ্টেম্বর সকালে 'অভাবনী' শব্দটি পূর্ণব্যঞ্জনা পেল, যখন মার্কিন সভ্যতার আইকন যমজ টাওয়ারে দুটি যাত্রী বহনকারী বিমান নির্বিকার প্রবেশ করে গেল বিশ্বসন্ত্রাস কাণ্ডের সবচেয়ে অভাবনীয় 'উদ্ভাবন' ঘটিয়ে। আল-কায়েদার বীভৎস সন্ত্রাসী কায়দা একই সময়ে মার্কিন প্রতিরক্ষার প্রধান দপ্তরটিকেও বিধ্বস্ত করে দিল। মার্কিন দম্ভ চূর্ণ করা এমন সন্ত্রাসী অভিযানটি পরিচালনা করেছেন মার্কিনিদের মিল্ক-ব্যানানা-স্ট্রবেরি জুস দিয়ে পোপ কালসাপ লাদেনপুত্র ওসামা। আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সেনাদের ঠ্যাঙানি দিয়ে লেজ গুটিয়ে পালানোর পরিস্থিতি সৃষ্টিতে যে ওসামা টনিক দারুণ কাজে এসেছিল, তা যে এমন বিষাক্ত-জারক রসে পরিণত হবে সে কথা রিগান-বড় বুশ-ছোট বুশ কেউই ভাবতে পেরেছিলেন কি!
তারপর এলেন সব বদলে দেওয়ার কৃষ্ণ-শ্বেত মিশ্রণের নবনায়ক ওবামা হোসেন ব্যারাক। তিনি আফগান ও ইরাক-ব্যারাক থেকে বিপন্ন মার্কিনি সেনাদের ফিরিয়ে আনবেন কথা দিলেন। কিউবা থেকে দখল করা গুয়ানতানামো দ্বীপের নির্যাতন কারাগারটি বন্ধ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। বোধ করি রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, মানুষ প্রতিজ্ঞা করে তা ভাঙার জন্য। ছাত্ররা রুটিন করে তা না মানার জন্য। নির্বাচনী সনদ হয়, তা বাস্তবায়নে দৃঢ় পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্য।
চার বছরের আমলের অর্ধেক না পেরোতে মার্কিন মুল্লুকে সিনেট কংগ্রেসের মধ্যবর্তী নির্বাচনে দেখা গেল, ওবামা-জাদুকরে মোহিত মার্কিনিদের অনেকের আশা বেলুনই ফুঁস চুপসে গেছে। নির্বাচনে গর্দভ-মার্কা ডেমোক্র্যাটরা হাতি হারা হেরে গেল। দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফিরে আসছেন না ওবামা, এমনটাই ধরে নিল সবাই।
তারপর দেখুন এক মহাথ্রিলার অ্যাকশন ছবি। একেবারে মহাবাস্তব। বসে আছেন ওবামা-হিলারিসহ মার্কিনি ক্ষমতা-মহারথীরা, বিশ্ব-ক্ষমতামন্দির শ্বেত-ভবনের বিশেষ একটি কক্ষে। হেলিকপ্টার যাচ্ছে। নামছে। কমান্ডোরা বেরোচ্ছে। ব্রাশফায়ারের গোলায় ফায়ার আর আগুন। সব বাধা ডিঙিয়ে মিলে গেল এক নম্বর টার্গেট। এক সেকেন্ডেই খতম।
ওবামা এর কয়েক ঘণ্টা পর হোয়াইট হাউসের কক্ষ থেকে বেরিয়ে নির্দিষ্ট ভাষণ মঞ্চে এসে জানালেন, মার্কিনিরা ভোলে না। ১০ বছর আগে যমজ ভবনে ওরা আঘাত হেনেছিল। আমরা আজ প্রধান দুশমনকে ফিনিশ করে বদলা নিলাম। পাকিস্তানের সামরিক এলাকায় নিরাপদ ভবনে ছয় বছর ধরে বসবাসরত ওই ব্যক্তিকে আমরা বধ করে ওর লাশ বাজেয়াপ্ত করে এনেছি। জয়ঢাক বাজল মার্কিনি সামরিক আক্রমণ প্রযুক্তির।
এবার ঘোষিত হলো ওই লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে সমুদ্রে। বীভৎস লাশের ছবি দেখানো হবে না 'মানবিক' কারণে। বিজয়ের 'অমানবিক' উল্লাসে মেতে উঠল মার্কিনি লাখ লাখ মানব। এর পরই শুরু হলো সেই 'তুঁই' বেড়াল না 'মুঁই' বেড়াল'-এর কাণ্ড।
কয় বছর ধরে মার্কিনিদের প্রধান দুশমন ওসামা নিরাপদে বসবাস করছেন পাকিস্তানি সেনা শহর অ্যাবোটাবাদে, অথচ পাকিস্তানের সরকার ও সেনানেতৃত্ব তা জানে না_এটা হতেই পারে না। এমন মহাযুক্তি নিয়ে মার্কিনিরা ঝাঁপিয়ে পড়ল অভিযোগের ব্রহ্মাস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানি শাসকদের ওপর। মার্কিনি সিনেট কংগ্রেসের অনেকেই বেঁকে বসলেন। পাকিস্তানকে আর সাহায্য দেওয়া যাবে না। পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী আইএসআই ছয় বছর ধরে ওসামার 'নিরাপদ অবস্থান' সম্পর্কে কিছুই না জানার ভাণকে মার্কিন কর্তারা খান খান করে দিলেন তীক্ষ্ন বচনে বারবার। আইএসআইকে তারা 'অবিশ্বস্ত' মনে করে বলেই তাদের না জানিয়েই এই 'অ্যাবোটাবাদ থ্রিলার' অ্যাকশন ছবির জন্ম দিয়েছে।
মার্কিন অভিযোগের অমন তীব্রতায় পাকিস্তানি সিভিল-মিলিটারি সব কর্তাই প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও পরে নিজেদের 'মেরুদণ্ড' হঠাৎ খুঁজে পেয়ে 'পেয়েছি পেয়েছি' বলে চিলি্লয়ে উঠলেন। পাকিস্তানের সংবিধানে লেখা 'সার্বভৌমত্ব' শব্দটি সশব্দে জেগে উঠল হঠাৎ। পাকিস্তনের জাতীয় সংসদ দীর্ঘ ১০ ঘণ্টার অধিবেশন শেষে প্রস্তাব-মূষিক প্রসব করে বলল, যা হওয়ার তা হয়ে গেছে, যা গেছে তা যাক, কিন্তু হুঁম্ম্ম্! ভবিষ্যতে এমন ধরনের সার্বভৌমত্ববিরোধী আক্রমণ-আগ্রাসন সহ্য করা হবে না ইত্যাদি।
এর ফাঁকে মোক্ষম একখান বাণী উপহার দিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জিলানি। বললেন, ওসামা অ্যাবোটাবাদে এতকাল ছিলেন, ওটা না হয় আমরা না জানতে পারি, পৃথিবীর এত বড় বড় জাঁদরেল গোয়েন্দা সংস্থারা তা কেন জানতে পেল না?
হুঁম্ম্ম্! এটিও খাঁটি কথা, দুর্দান্ত যুক্তি কী! সবাই জানে আফগানিস্তানের তোরাবোরা পাহাড়ে কিংবা দুর্গম পাক-আফগান সীমান্তে ওসামা বিন লাদেন আছেন লুকিয়ে। আইএসআই জানে না, ওদের মহাগুরু সিআইএ জানে না, ওদিকে ওসামা এক নয়, দুই নয়, তিন-তিনটি জেলানা বিবি নিয়ে পাকিস্তানি সামরিক দুর্গ ছুঁয়ে ছয়-ছয়টি বছর বসবাস করছেন আধুনিক প্রযুক্তিতে সজ্জিত হয়ে।
এবার পাঁকি গোঁয়েন্দা বেঁড়ালটি কঁয়: ওঁটি ছিল সোনার হাঁস। ওঁকে লুঁকিয়ে রাঁখলে ওঁকে খোঁজার নাঁমে কাঁড়ি কাঁড়ি মাঁর্কিনি মাঁল মিলবে। সে জন্যই তো ওঁকে লুঁকিয়ে রেখেছি।
উত্তরে একান্তে মাঁর্কিন গোঁয়েন্দা বেঁড়ালটি কয় : সেঁ খঁবরটি কঁী আঁমরা বুঁঝিনি ভ্রাঁত:? আঁমরাও চেয়েছি অঁই দুঁশমনটি অঁমন ভাঁবেই নিরাপদে আমাদের নঁজরে থাঁকুক। তাঁরপর আঁমাদের সময়মতো ওঁর শিঁর কুঁচাল করে দেঁব তোঁমাদের না জাঁনিয়েই।
পাঁকি-বেঁড়াল: তাঁ এঁ সময় ওঁকে বধিলেন কেঁন?
মাঁর্কি-বেঁড়াল: বুঁঝিস না। আঁমাদের প্রেঁসিডেন্টের দ্বিঁতীয় মেঁয়াদে প্রেঁসিডেন্ট হঁবার ইঁচ্ছা হঁয়েছে। এঁমন এঁকখান মোক্ষম-কাণ্ড নাঁ কঁরিলে যে ভাঁব ও মূঁর্তি উঁজ্জ্বল হয় না!
পাঁকি-বেড়াল: এঁতে কী কাঁজ্য সিদ্ধ হইবে?
মার্কি-বেড়াল: তাঁহা জানেন ভাঁগ্য দেবতা, গড, বঁড় বুঁশ ইঁরাক যুদ্ধে জিঁতিলেন। পঁরে নিঁর্বাচনে কিঁ্লনটনের কাঁছে হাঁতি-হারা হাঁরিলেন। এই বেঁলায় কঁী হঁইবে কেঁ জাঁনে। তঁবে ওবামা বিন লাদেনের-ঠিকানা তুঁই বেড়ালও জানতি, মুঁই বেড়ালও জানতাম। শুঁধু বেয়াকুব জগৎবাসী তাঁহা জাঁনিত না।
লেখক : রম্য লেখক

No comments

Powered by Blogger.