শ্রদ্ধাঞ্জলি-দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় : অসাধারণ এক বাকশিল্পীর প্রয়াণ by ড. মোহাম্মদ আশকার ইবনে শাইখ

২ জুন ২০১১ দিবাগত রাতে দক্ষিণ কলকাতার নিজ বাসভবনে ৭৬ বছর বয়সে আকাশবাণীর একসময়ের জনপ্রিয় সংবাদপাঠক, আবৃত্তিকার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান ঘটে। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তা নানা কারণেই ছিল তুঙ্গে।


আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে অবসর নেওয়ার পর তাঁর শারীরিক অবস্থা কখনোই ভালো যাচ্ছিল না। হৃদরোগের পাশাপাশি নানা জটিল সমস্যা তাঁকে পিষে মারছিল। শেষ পর্যন্ত স্মৃতিভ্রংশও ঘটেছিল। যে মানুষটি সারা জীবন ছিলেন প্রাণবন্ত, শেষ পর্যন্ত দীর্ঘদিন তিনি কাটিয়ে গেলেন প্রায় নির্বাক হয়ে। তাঁর সহধর্মিণী রুবি বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি ছিলেন তাঁর অনেক কিছুর প্রেরণাদাত্রী, তিনিও প্রয়াত হন প্রায় দুই বছর আগে। তারপর থেকেই তাঁকে গ্রাস করে একাকিত্ব। এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় অনেকের কাছেই ছিলেন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। অনেকেরই হয়তো মনে আছে, ষাটের দশকের শেষে আকাশবাণীতে প্রচারিত তাঁর সংবাদ ভাষ্যের কথা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রণবেশ সেনের লেখা 'সংবাদ পরিক্রমা' যখন তাঁর ভাবগম্ভীর কণ্ঠে প্রচারিত হতো, তখন এপার বাংলা ওপার বাংলার অসংখ্য শ্রোতা গভীর মনোযোগ দিয়ে তা শুনতেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের প্রয়াত দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠস্বর সাংঘাতিক অনুপ্রেরণা জোগাত। মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন আমাদের হয়ে লড়াকু একজন শব্দসৈনিক। স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে সে কারণেই সংবর্ধনাও জানিয়েছিলেন। ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করে। ২ জুন রাতে কলকাতার কেওড়াতলা মহাশ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় আজ শারীরিকভাবে নেই বটে; কিন্তু সচেতন প্রগতিবাদী বাঙালি হৃদয়ে তাঁর রয়েছে অনেক বড় স্থান। এখান থেকে কেউ তাঁকে বিচ্যুত করতে পারবেন না। আবৃত্তি যে বাচিক শিল্প, তা তাঁর কাছ থেকেই অনেকে জেনেছেন। খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব গৌরী ঘোষও তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে এ মন্তব্যই করেছেন। তাঁর শূন্যতা কখনোই পূরণ হওয়ার নয়। তাঁর বাচনভঙ্গি ও কণ্ঠস্বরের কারণে তিনি বাঙালিদের কাছে কিংবদন্তি সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার ও ঘোষক হয়ে উঠেছিলেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পূর্ণ অন্যভাবে বাঙালি সমাজে পরিচিত হয়ে ওঠেন। যদি নির্দিষ্ট করে বলতে হয়, তাঁর সেরা কাজ কোনটি, তাহলে নিশ্চয়ই বলতে হবে 'সংবাদ পরিক্রমা' অনুষ্ঠানটি। বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত কয়েকটি বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায় তাঁর প্রয়াণ সংবাদটি খুব গুরুত্বের সঙ্গে সংগত কারণেই প্রকাশিত হয়েছে। গভীর শ্রদ্ধায় দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্মরণ করি এবং বাংলাদেশ সরকারের কাছে দাবি জানাই, জাতীয় সংসদের চলতি অধিবেশনে একটি শোক প্রস্তাব গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হোক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমির ওপর কলকাতায় নির্মিত 'জয় বাংলা' ছবিতে একজন বাংলাদেশি কবির ভূমিকায় অভিনয় করে তিনি ঈর্ষণীয় প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। তাঁকে প্রণতি জানাই।
ড. মোহাম্মদ আশকার ইবনে শাইখ

No comments

Powered by Blogger.