সিলেটের শিক্ষার সামগ্রিক চিত্র ও করণীয় by ড. নিয়াজ আহম্মেদ

বাংলাদেশের সংবিধানে শিক্ষাকে দেশের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে বিবেচিত হওয়া এবং তা অর্জনে সরকার ও দাতা সংগঠনগুলো কর্তৃক নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা সত্ত্বেও অদ্যাবধি এ বিষয়ে সর্বাত্মক সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়নি।


আর্থিক বিচারে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় সচ্ছল হলেও বিভিন্ন পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সিলেট অঞ্চল শিক্ষাক্ষেত্রে অনগ্রসর। প্রচলিত ধারণা মতে, ক্রমাগত বিদেশ গমন প্রবণতা বৃদ্ধির কারণে সিলেটে শিক্ষা গ্রহণের হারকে ক্রমাগত পিছিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি জনসংখ্যার অনুপাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অপর্যাপ্ততা ও ভৌগোলিক বৈচিত্র্য এ অঞ্চলে শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে গৃহীত নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও সিলেট অঞ্চলে শিক্ষার হারের বৃদ্ধি অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক কম। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে এ ক্ষেত্রে একটা ভারসাম্যমূলক অবস্থা সৃষ্টির তাগিদ ব্যাপকভাবে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায় থেকে অনুভূত হচ্ছে এবং এর উপায় নির্ধারণে অনুসন্ধানকার্য এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। একজন নাগরিকের সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য যেসব উপাদান অপরিহার্য বলে বিবেচিত, এর মধ্যে শিক্ষা অন্যতম। সময়ের সঙ্গে শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রেই নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, এমনকি কোনো কোনো দেশে শিক্ষার অধিকার বাস্তবায়নে সরকারি পর্যায়ে আইন প্রণয়নও করা হয়েছে। আজকের আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্ব সমাজে শিক্ষার অগ্রগতির সঙ্গে একটি দেশ বা জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়ন প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল। যেকোনো দেশের প্রকৃত উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে শিক্ষার কোনো বিকল্প তৈরি হয়নি, তবে এ অধিকার জাতি, ধর্ম, বর্ণ, অঞ্চল ও লিঙ্গভেদে সমানভাবে প্রয়োগ করা না হলে সামগ্রিক অগ্রগতি সম্ভব নয়।
দারিদ্র্য ও প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা সমস্যাজর্জরিত এ দেশে শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা উদ্যোগ থাকার পরও শিক্ষার সুযোগ সবার জন্য প্রসারিত করা সম্ভব হচ্ছে না। একদিকে শিক্ষার হার যেমন অনেক কম, তেমনি অঞ্চল ও লিঙ্গভেদে শিক্ষার হারের তারতম্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বাংলাদেশের অন্যতম একটি বিভাগ হলো সিলেট। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের কারণে এ বিভাগের চারটি জেলার যোগাযোগ, আবাস এবং জীবনযাত্রা ভিন্ন এবং অঞ্চলবিশেষে দুর্গমও বটে। এসব কারণে এ বিভাগে সাম্প্রতিককালে শিক্ষার সার্বিক চিত্র দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় সন্তোষজনক নয়। বিশেষ করে পাহাড়ি ও হাওরাঞ্চলে শিক্ষার সার্বিক চিত্র ও ব্যবস্থাপনায় অনেক দুর্বলতা বিদ্যমান।
ভৌগোলিক অবস্থান এবং প্রাকৃতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক কারণে সিলেট বিভাগের চার জেলার শিক্ষার হারও ভিন্ন। সিলেট বিভাগের শিক্ষার হার অনুযায়ী সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে সিলেট জেলা এবং সবচেয়ে কম শিক্ষার হার সুনামগঞ্জ জেলায়। আর সুনামগঞ্জের শিক্ষার হার কম হওয়ার কারণ হিসেবে অনেকেই এর ভৌগোলিক অবস্থাকে দায়ী করেন। সিলেট বিভাগের সার্বিক শিক্ষাচিত্র দেশের অন্যান্য বিভাগের তুলনায় ভালো নয়, যদিও অতীতে এই অঞ্চল শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেক ভালো অবস্থানে ছিল। তবে কয়েক দশক ধরে সে অবস্থার নেতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ করা হয়েছে। সিলেট বিভাগভিত্তিক পর্যাপ্ত শিক্ষাবিষয়ক তথ্য-উপাত্ত না থাকায় এ বিষয়ে সঠিক বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করা বেশ কঠিন (উৎস : সাক্ষরতা বুলেটিন, অক্টোবর ২০০৯)।
চা বাগান এলাকায় বসবাসরত জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগই আধুনিক জীবন প্রণালি তথা সমাজব্যবস্থা, জ্ঞান ও ধ্যান-ধারণা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এক বিশেষ জগতে বসবাস করে। চা বাগানের কায়িক শ্রম ও সংগ্রামী জীবনের সঙ্গে অভ্যস্ত এসব জনগোষ্ঠীর অনেক আচরণ, মনোভাব ও কার্যাবলি নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে তাদের মধ্যে প্রচলিত নানা কুসংস্কার ও ভ্রান্ত বিশ্বাসের মাধ্যমে। তাদের এ ভ্রান্ত বিশ্বাস ও কুসংস্কার দূরীকরণের জন্য নেই কোনো উদ্যোগ। বিশেষ এ জগতের সহজ-সরল মানুষগুলোর মধ্যে শিক্ষাগ্রহণ অনেকটাই বিলাসিতার শামিল। যে ক্ষুদ্রতম অংশ বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনের সহযোগিতায় তাদের সন্তানদের প্রাথমিক উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে পারে নিজ আবাসস্থল চা বাগানের মধ্যে, সাধারণত তা কেবল ওই পর্যায়ে রয়ে যায়, চা বাগানের গণ্ডি পেরিয়ে মূল স্রোতধারা যেখানে নিম্নমাধ্যমিক থেকে উচ্চতর শিক্ষালাভের সুযোগ রয়েছে, সেখানে গিয়ে শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ ঘটে খুব কমসংখ্যক ছেলেমেয়ের ভাগ্যে। গ্রামীণ এলাকায় এমন অনেক অভিভাবক আছেন, যাঁরা তাঁদের সন্তানদের শিক্ষার বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ও সচেষ্ট থাকেন না।
পাহাড়ি ও হাওরাঞ্চলগুলোতে ভৌগোলিক অবস্থার কারণে শিক্ষার্থীরা নানা রকম প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়, যা তাদের শিক্ষাজীবন বিপর্যস্ত করে দেয়। দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা, দূরবর্তী বিদ্যালয়, শিক্ষা উপকরণ সংগ্রহে সমস্যা, নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি কারণে অনেক শিক্ষার্থী একপর্যায়ে বিদ্যালয় ছেড়ে দেয়, আর এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কন্যাশিশুরা, যদি সরকার ও বেসরকারি সংস্থা ওই ধরনের অঞ্চলে পরিবেশ ও পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রয়োজনীয়সংখ্যক বিদ্যালয় স্থাপন, নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করা এবং শিক্ষা উপকরণ সহজলভ্য করতে পারে, তাহলে হয়তো অনেক শিক্ষার্থী অকালে ঝরে পড়া থেকে রক্ষা পেত, আর এর ফলে উপকৃত হবে কন্যাশিশুরা। আমাদের দেশে গ্রামীণ বিদ্যালয়গুলোতে সাধারণত বিকেল পর্যন্ত ক্লাস চলে। শিশুরা সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বিদ্যালয়ে প্রায়ই কিছু না খেয়ে থাকে, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য অন্তরায়। এভাবে একসময় কোমলমতি শিশুরা শিক্ষাগ্রহণের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। পাশাপাশি আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার বিদ্যালয়গুলোতে তাদের ভাষাভাষী শিক্ষক নিয়োগদানের মাধ্যমে শিক্ষার ক্ষেত্রে ভাষাগত সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। আবার দুর্গম ও দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোতে শিক্ষকদের যাতায়াত, আবাসনসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে ওই ধরনের এলাকায় বিদ্যমান বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকস্বল্পতার সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে। ব্যক্তির সামর্থ্য বৃদ্ধি ও আত্মরক্ষার ক্ষমতা অর্জনে শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম। শিক্ষা মানুষকে তার নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে সাহায্য করে এবং তা অর্জন ও সুসংহতকরণে সামর্থ্যবান করে তোলে। এ সত্যটি উপলব্ধি করে সরকারি পর্যায়ে গৃহীত হয়েছে নানা উদ্যোগ। সরকারের একার পক্ষে এ বিশাল দায়িত্ব যথাযথ সম্পাদন করা কষ্টকর।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
neayahmed_2002@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.