চারুশিল্প-মুখর নৈঃসঙ্গ্য যাপন by নন্দিনী মুখার্জি

ইতিহাস-দর্শন-রাজনীতি, সর্বোপরি সমাজের সকল স্তরকেই অনুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণের ভেতরে রাখার শৈল্পিক সত্তায় বসবাস শিল্পী রুহুল আমিন কাজলের। যাপনের সব অভিজ্ঞতাকে তিনি মুদ্রিত করেন চিত্রভাষায়। সভ্যতার ক্ষতগুলো সারিয়ে তুলতে অবিরাম চিহ্নিত করে চলেন তাঁর অবক্ষয় এবং সম্ভাবনাগুলো। বাংলায় ‘জাতশিল্পী’ বলে একটা কথা আছে।


শিল্পী কাজলের বেলায় এ অভিধাটি যথার্থই মানিয়ে যায়। তাঁর ভাবনা জীবনযাপন অঙ্কনে এর প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে। ‘জীবন দর্শন’ শিরোনামে ধানমন্ডির বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টসে শুরু হয়েছে শিল্পী রুহুল আমিন কাজলের রেট্রোস্পেকটিভ প্রদর্শনী। প্রদর্শনীতে তাঁর চিন্তাপাঠের পুস্তক উন্মুক্ত থাকছে শিল্পানুরাগী এবং বিরাগী দর্শকের জন্য।
১৯৮৪ সালে ‘কলোনী’ শিরোনামে তাঁর প্রথম প্রদর্শনীতে মানব সভ্যতার গতি-প্রকৃতির ইতিহাস নিয়ে তিনি কাজ করেছেন। ‘কলোনী’ নামকরণের মাঝেই তিনি অনেক প্রতিষ্ঠিত ভাবনাকে পুনর্বিবেচনার কথা বলেন। কলোনাইজেশনের কারণ এবং আমাদের মানসিক গড়নে তার প্রভাব চিহ্নিত করেন। আমাদের এই উপমহাদেশের প্রথম মানবিক সভ্যতা, বৈদিক বিভেদের পূর্ববর্তী অবস্থাকে আদর্শ মেনে তিনি দ্রাবিড় সভ্যতাকেই তাঁর শিকড় হিসেবে দেখিয়েছেন এ সিরিজে। দ্রাবিড় সভ্যতার দর্শনকে তাঁর শিল্পের মূল স্তম্ভ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। এই সভ্যতার একটি ভাস্কর্য তাঁকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করেছিল, যার ভেতরে তিনি খুঁজে পান একই সঙ্গে রাজা, পুরোহিত এবং দাসের চরিত্র। সিন্ধু সভ্যতার সেই ভাস্কর্য তাঁকে নতুন এক বিশ্বাসে উপনীত করে। তিনি বিশ্বাস করেন, একজন মানুষের মধ্যে তিনটি অস্তিত্ব বিদ্যমান। কিং, প্রিস্ট এবং স্লেভ—এ তিনটি স্তর ক্রমান্বয়ে মানবজীবনে প্রভাব রেখে যায়। ইতিহাস আমাদের এমনই এক সামাজিকতার ইশারা দেয় তৎকালীন সময়ে, যেখানে হয়তো রাজা-প্রজা-পুরোহিতের বিভাজনটা ছিল শুধুই কর্মবিভাজন, শ্রেণীবিভাজন নয়।
প্রথম সিরিজেই নিজের জাত চিনিয়েছিলেন শিল্পী রুহুল আমিন কাজল। ১৯৮৪-৮৬ সালের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি ‘সমাজ’ (সোসাইটি) শিরোনামে এঁকেছেন নতুন সিরিজ। এ সিরিজে তিনি প্রবেশ করেছেন আমাদের মনোজগতের অন্দরমহলে। পুরুষের মানসিক গড়নে পরিবেশের অবিচ্ছিন্ন প্রভাব রয়েছে। সমষ্টিক হওয়ার চেয়ে আমরা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রে বিশ্বাসী হই। নারীদের ভেতরবাড়িতে দেখতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। এ সিরিজে তিনি প্রকাশ করেছেন মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিচ্ছিন্ন বিন্যাস লিনিয়ার পদ্ধতিতে। ফিগারে ভলিউম তৈরি এ সিরিজের প্রধানতম বিষয় ছিল। জৈন বিশ্বাসের মগ্নতা ছিল এর অন্যতম প্রধান প্রতিপাদ্য। তাই এ সিরিজে লাইনের ব্যবহার অত্যন্ত উৎকৃষ্ট এবং বিশ্বাসই ছিল এর প্রধান চালিকাশক্তি।
এভাবেই শিল্পী কাজল এগিয়েছেন তাঁর শিল্পভুবনে, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সামাজিক মনোগঠন সম্পর্কে নিবিড় অনুধ্যানের মাধ্যমে, দৃঢ় ও সচেতন পদক্ষেপে। বিষয় আর ভাবনার বৈচিত্র্যে তিনি শিল্পকর্মে নতুনত্ব সৃষ্টিতে সফল হয়েছেন। তাঁর পরবর্তী সিরিজ ছিল ‘ভালোবাসা’ (লাভ) শিরোনামে। প্রেমকে তিনি প্রকৃতির অংশ হিসেবে দেখেছেন। মানুষের মধ্যে শাশ্বত এই প্রেমের অভ্যুদয় প্রকৃতিকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে উপলব্ধির প্রয়োজনে। তা ছাড়া এই রেট্রোস্পেকটিভ প্রদর্শনীতে রয়েছে ‘পোয়েটিক সুররিয়ালিজম’, ‘ইমব্যালান্স ওয়ার্ল্ড’, ‘ভায়োলেন্স’, ‘ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ’, ‘সংস অব লোনলিনেস’, ‘কোল্ড ফায়ার’ সিরিজের অনেক শিল্পকর্ম। শিল্পী কাজলের ১৯৯৯ সালের একটি প্রদর্শনীর শিরোনাম ছিল ‘ডেমোক্রেজি’। শব্দের চমকে দর্শক কিছুটা ভড়কে গিয়েছিল নিঃসন্দেহে। এরপর তিনি ‘কিলিজিয়ন’ এবং ‘ইভিলাইজেশন’ সিরিজের মাধ্যমে ট্রিলজি পূর্ণ করেন।
তাঁর ভাষায় ট্রাই-এক্সিবিশন। এই ত্রিদর্শনীর নামকরণই আসলে সবকিছু বলে দেয়। নামকরণে এমন বুদ্ধিমত্তা এবং মেধার পরিচয় বিশ্বশিল্পেই বিরল। এখানে তাঁর ভাবনার গভীরতা সহজেই অন্যকে স্পর্শ করে যায়। স্বদেশ, স্বজাতি এবং নিজেদের বসবাসের এই একমাত্র গ্রহকে উত্তরোত্তর মানবিকতায় সমৃদ্ধ করে তোলার পেছনে শিল্পী রুহুল আমিন কাজলের মতো অনেক সচেতন শিল্পীর নিবেদন রয়েছে। তাঁর রেট্রোস্পেকটিভ প্রদর্শনীতে দর্শক সহজেই খুঁজে পাবেন সত্য ও সুন্দরের সন্ধান।
প্রদর্শনী চলবে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।

No comments

Powered by Blogger.