ভূমিকম্প-টেকসই ভবন নির্মাণে যা করণীয় by মো. আলী আকবর মল্লিক

ইদানীং বাংলাদেশে ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতা বাড়ছে। সর্বশেষ গত ১৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ছয়টা ৪০ মিনিটে সিকিমে ঘটা রিখটার স্কেলে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের ফলে বাংলাদেশ যে তীব্রতায় কেঁপেছে, তাতে খুব কম লোকই বাড়ির বাইরে বের হয়নি।


কম্পনের সময় দৌড়ঝাঁপ করে ভবন থেকে বের হতে গেলে ওপর থেকে ছিটকে পড়া বস্তু দ্বারা মাথায় ও শরীরে আঘাত লাগতে পারে বলে তা নিরাপদ নয়। কম্পনের সময় ক্রমানুসারে (ক) বাড়ির সদর দরজাটি খুলে দিতে হবে, যেন কম্পনের পর বাইরে বের হতে বাধা না থাকে, (খ) গ্যাসের চুলা ও বিদ্যুতের মেইন সুইচ অফ করতে হবে এবং (গ) বিম-কলামের কাছাকাছি বা খাবার টেবিলের নিচে আশ্রয় নিতে হবে। কম্পনের পর প্যানিক সৃষ্টি না করে সিঁড়ি দিয়ে বের হতে হবে। প্যানিক সৃষ্টি করা বা দৌড়ঝাঁপের পরিণতি পদদলিত হয়ে মৃত্যুও হতে পারে। দৌড়ঝাঁপের প্রয়োজন নেই, কারণ প্রথম ঘটা ভূমিকম্পের পরে যেগুলো ঘটে (আফটার শক), তা কিছুটা পরে ঘটে এবং এর মাত্রা সাধারণত কম হয়। যেমন, ১৮ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয়বার ঘটেছে সন্ধ্যা সাতটা ১২ মিনিটে ৪ দশমিক ৮ মাত্রার এবং তৃতীয়বার ঘটেছে সাতটা ৫৪ মিনিটে ৪ দশমিক ৬ মাত্রার। এই আফটার শক দুটির তীব্রতা ঢাকাবাসী টেরই পায়নি।
হরহামেশা কম্পনের অনভিজ্ঞ ব্যক্তি কম্পনের মুহূর্তে নির্ভয়ে ভবনের ভেতরে থাকার সম্ভাবনা কম। এর মূল কারণ অনভ্যস্ততা এবং ভবনটির ওপর আস্থার অভাব। কেমন ভবন নির্মিত হলে আস্থা থাকবে? একটি ভবন ভূমিকম্প সহনশীল হতে হলে (১) নকশা সুষম হতে হবে; (২) ভবনের উল্লম্ব দিকের বিন্যাস সুষম হতে হবে; (৩) বিম, কলাম, স্লাব, ওয়ালগুলোর পর্যাপ্ত নমনীয় শক্তি থাকতে হবে; (৪) ভবন নির্মাণে ব্যবহূত মালমসলা যেমন—সিমেন্ট, খোয়া, বালু ও রডের মান সঠিক হতে হবে এবং (৫) স্থপতির করা নকশা ও কাঠামো-প্রকৌশলীর করা ডিজাইন অনুসারে নির্মাণকাজ হতে হবে।
উল্লিখিত পাঁচটি বিষয় নির্ভর করে ভবনমালিকের সদিচ্ছা, যোগ্য স্থপতি ও কাঠামো-প্রকৌশলীর ওপর। মালিককে বুঝতে হবে, তিনি একটি ভূমিকম্পে টেকসই ভবন নির্মাণ করবেন। সে জন্য তিনি যোগ্য স্থপতি ও কাঠামো-প্রকৌশলী দ্বারা নকশা ও ডিজাইন করাবেন এবং ভবনটি নির্মাণে যে মূল্য নিরূপিত হয়, তার শতকরা অন্তত ৩ থেকে ৫ ভাগ স্থপতি ও কাঠামো-প্রকৌশলীর পারিশ্রমিক বাবদ ব্যয় করবেন। তাঁকে বুঝতে হবে, এই ব্যয়ের সুফল তিনি কয়েক গুণ বেশি ফেরত পাবেন সঠিক নকশা ও কাঠামো থেকে। খরচ কমাতে শুধু রাজমিস্ত্রির হাতযশের ওপর নির্ভর করলে পরিণাম কখনো ভালো হয় না। কোন অসুখের কী অষুধ, তা অষুধের দোকানিও বলে থাকেন, কিন্তু ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
উল্লিখিত (১)-এর কাজটি করবেন স্থপতি, তবে কাঠামো-প্রকৌশলীরও পরামর্শ নেবেন। সুষম নকশাটি করার সময় মানবদেহের মতো একটি সুষম কাঠামোর কথা মাথায় থাকা ভালো। সুষম নকশা ইংরেজি আই, এইচ এবং ও-এর আদলে হবে। এল, ই, এফ-এর আদল এড়িয়ে চলা ভালো। জমির গঠন যদি এমনই হয়, তবে নকশায় বিভক্তির কৌশল নিতে হবে। যেমন—জমির গঠন এল আকারের হলে এলকে দুই ভাগে ভাগ করে দুটি আই-এর আদলে নকশা হবে। নকশার লম্বালম্বি বা আড়াআড়ি দিকে কলাম থেকে কলামের দূরত্ব পারতপক্ষে সমান রাখতে পারলে কাঠামোর বিন্যাস সুষম হয়। কলামের সাইজ যদি বর্গাকার না হয়ে আয়তাকার হয়, তবে বড় বাহুটি নকশার ছোট বাহুর দিকে হলে ভবন ভূমিকম্পে বেশি সহনশীল হয়। একই কারণে চার কোনার কলামের মাপ ভেতরেরগুলোর সমান হলে ভালো হয়, তাহলে রড কম দেওয়া যেতে পারে। এসব বিবেচনায় নিয়ে কাঠামো-প্রকৌশলী নকশাটি সুষম হয়েছে কি না, তার প্রাথমিক যাচাই করবেন।
এরপর কাঠামো-প্রকৌশলী দেশের বিল্ডিং কোড মেনে (২) ও (৩)-এর ডিজাইন করবেন। কাঠামোর মূল উপাদান বিম, কলাম, স্লাব, ওয়ালগুলো ডিজাইনের সঙ্গে (১)-এর নকশা এবং (২)-এর উল্লম্ব দিকের বিন্যাস সুষম হয়েছে কি না, তা হিসাব-নিকাশের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত হবেন। সুষমের এই বিষয় দুটি বাংলাদেশে তেমন আমলে নেওয়া হয় না। যেমন—অনেক ক্ষেত্রে এল বা এমন জটিল আদলের নকশা করা হয়, যা সুষম নয়। আবার একটি সুষম আয়তাকার প্লটের ভবনে প্রতি তলায় দুটি বা চারটি ফ্ল্যাট না করে তিনটি বা পাঁচটি ফ্ল্যাট করে নকশা জটিল করে ফেলা হয়। আবাসিক ভবনের কার পার্কিংয়ের তলায় শুধুই কলাম থাকলে ওই তলাটি উল্লম্ব দিকের বিন্যাসকে সুষম হতে ব্যাহত করে। তাই কলামের সঙ্গে ব্রেস বা শিয়ার ওয়াল না থাকলে কার পার্কিংয়ের তলাটির কারণে ভবন ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। আবার ফ্ল্যাট প্লেট দ্বারা নির্মিত ভবন প্রতিটি তলাকে অধিক ভারী করে বলে ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ। সনাতনী ইটের ব্যবহারও ভবনকে অধিক ভারী করে বলে ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ। তা ছাড়া ইটের সঙ্গে রড ব্যবহারের সুযোগ নেই। অপেক্ষাকৃত হালকা গভীর ব্লক ব্যবহার করলে খাড়াভাবে রড ব্যবহার করা যায়, যা ওয়ালের নমনীয় শক্তি বৃদ্ধি করে।
ড. মো. আলী আকবর মল্লিক: কাঠামো-প্রকৌশলী, ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ এবং সাবেক মহাসচিব, বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটি।
drmollickmaa@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.