আলোর ইশারা-নদীমাতৃক দেশেও চাই নদীর পুনরুজ্জীবন by আইনুন নিশাত

প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার উদযাপিত হয় বিশ্ব নদী দিবস। এ উদযাপনটি শুরু হয় ১৯৮০ সালে কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশে। তখন নাম ছিল ব্রিটিশ কলাম্বিয়া নদী দিবস। কয়েক বছরের মধ্যে এটি কানাডার নদী দিবসে পরিণত হয়। ২০০৫ সাল থেকে উদযাপিত হতে থাকে বিশ্বব্যাপী।


প্রকৃতপক্ষে জাতিসংঘ ২০০৫-২০১৫ সালকে 'জীবনের জন্য পানি' দশক হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তার অংশ হিসেবে জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব নদী দিবস পালনে অগ্রণী ভূমিকা নেয়। প্রসঙ্গত আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারিও এভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে পরিণত হয়েছে।
এই দিবসটির ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ নয়। কোনো একটি দিবস নির্ধারণ ও তা উদযাপনের লক্ষ্য হচ্ছে, যে বিষয়কে কেন্দ্র করে আয়োজন, তার কিছু এলিমেন্টের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ কিংবা একটি বিশেষ সমস্যার মাত্রা তুলে ধরা ও তার সমাধানের লক্ষ্যে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করা। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া যেতে পারে, বিশ্ব নদী দিবস উদযাপনের লক্ষ্য হচ্ছে জনজীবনে ও জনপদের জন্য নদীর ভূমিকাকে সমুন্নত করা। আমরা জানি, বিশ্বের জনসংখ্যা বাড়ার কারণে চাপ পড়ছে প্রকৃতির ওপর। হারিয়ে যাচ্ছে বনভূমি, প্লাবন ভূমি, জলাভূমি এবং চারণভূমি। চাপ পড়ছে নদীর ওপরও। পানি তুলে নদী শুকিয়ে ফেলা হচ্ছে, নদী ভরাট হচ্ছে, আড়িবাঁধ দিয়ে বহতা নদীকে ডোবায় পরিণত করা হচ্ছে। তাৎক্ষণিক হিসেবে এসব কর্মকাণ্ড যারা ঘটাচ্ছে, তাদের কিছু লাভ হলেও দীর্ঘমেয়াদে এ ধরনের কোনো কাজই টেকসই উন্নয়নের ধারার অংশ হতে পারে না। কাজেই উন্নয়নের ধারা সমুন্নত রাখার প্রক্রিয়ায় একটি নদীকে কোনো অবস্থাতেই চাপের মধ্যে ফেলা বাঞ্ছনীয় হবে না। বাংলাদেশের জন্য এসব বিবেচনা তো অত্যন্ত জরুরি।
আমরা বলে থাকি, বাংলাদেশ 'নদীমাতৃক'। কিন্তু আমরা জানি না, আমাদের দেশে কতগুলো নদী আছে। ৩০০টি, না ৭০০টি? বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, খাবারের দোকানের সাধারণ কর্মী ক্রেতার সঙ্গে রসিকতা করেন নদ-নদীর সংখ্যা নিয়ে। আমরা বিশেষ করে নগরবাসী, নদ-নদীর গতিবিধি, এর প্রবাহের বিশেষত্ব কিংবা নদীর মধ্যে যে জীবন আছে, তা সম্পর্কে কতটুকু জানি?
এই লেখার আগে, আমি কৌতূহল নিয়ে ইন্টারনেটে ঢুকেছিলাম। আগ্রহ ছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নদী দিবসে কী ধরনের কর্মকাণ্ড হচ্ছে বা বিভিন্ন দেশবাসী কীভাবে দিবসটি উদযাপন করছে। ওয়েবসাইটেই আবিষ্কার করলাম, বাংলাদেশে 'রিভারাইন পিপল' নামে একটি সংগঠন দিবসটি উদযাপনের আয়োজন করেছে। গত বছর তারা প্রথমবারের মতো এ দেশে বিশ্ব নদী দিবস পালন এবং এখানকার জন্য প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে। এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- 'অভিন্ন নদীতে অভিন্ন অধিকার। পাশপাশি এবার তারা নদী ও জীবনকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে এবং বড়াল নদীকে কেন্দ্র করে একটি অনুষ্ঠানের চিন্তাভাবনা করছে।
তখন আমার মনে পড়ল, সংগঠনটি বড়াল নদী নিয়ে একটি একাডেমিক ডকুমেন্টেশন করছে এবং সে বিষয়ে কথা বলার জন্য সংগঠনটির পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ূয়া কয়েকজন তরুণ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। মনে পড়ল, তাদের বলেছিলাম, বড়াল নদীকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ওই তরুণরা বলেছিল, রিভারাইন পিপল নদী-হত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে। দেশের প্রধান একটি বাংলা ও ইংরেজি সংবাদপত্র এবং একটি টেলিভিশন চ্যানেল কয়েক বছর ধরেই আন্দোলন চালাচ্ছে 'নদী বাঁচাও, ঢাকা বাঁচাও'। এই স্লোগানকে টেনে আমরা বলছি, 'নদী বাঁচাও, দেশ বাঁচাও'। প্রকৃতপক্ষে কাজ হচ্ছে প্রথমত নদী নিধন বন্ধ করা। প্রকৃতপক্ষে নদী তো পুরোপুরি মরে না, তাকে আধমরা করা হয়। অর্থাৎ এগুলোর পুনরুজ্জীবন সম্ভব। তাহলে এখনই কাজ শুরু করতে হবে। পুনরুজ্জীবনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমি আশাবাদ পোষণ করতে চাই। আমরা লক্ষ্য করছি, যত ধীরগতিতেই হোক না কেন, সরকার নদী পুনরুদ্ধারে পদক্ষেপ নিচ্ছে। অর্থাৎ চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে নদীর ভৌত পরিবেশ, আয়তন-আকৃতি ইত্যাদি নিয়ে। এ বিষয়ে সাফল্য পাওয়া গেলে নদীকে জীবিত করার কাজ অবশ্যই সম্ভব হবে।
নদীরও জীবন আছে এবং নদীর ভেতরেও জীবন আছে। নদীর নিজস্ব চাহিদা আছে। চাহিদাটি হচ্ছে, যে প্রবাহ নদীটি বহন করবে তার সঙ্গে পলিমাটি বহনের সাযুজ্য আনা। প্রাকৃতিকভাবেই নদীতে সারা বছর সমপরিমাণ পানি প্রবাহিত হয় না। বর্ষায় এর দু'কূল উপচে কিংবা কানায় কানায় প্রবাহিত হলেও শুকনো মৌসুমে প্রবাহ অত্যন্ত ক্ষীণধারায় নেমে আসে। সেই ক্ষীণধারার প্রায় সবটুকু তুলে ফেলে আমরা সেচকাজে ব্যবহার করি। আমরা বলতে থাকি, নদীগুলো শুকিয়ে গেছে। কিন্তু অনুধাবন করি না, আমরা নদীকে শুকিয়ে ফেলে তাকে মৃত্যুর রাস্তায় ঠেলে দিচ্ছি। প্রাকৃতিকভাবে বর্ষায় আবার হয়তো কানায় কানায় ভর্তি হয়; কিন্তু নদীকেন্দ্রিক প্রতিবেশের ক্ষেত্রে মৃত্যুঘণ্টা বেজেই চলে। নদীপ্রবাহের বাড়া-কমা সম্পর্কে আমরা কতটা জানি। যেসব নদীকে আমরা 'ফ্ল্যাশি রিভার' বলি যেমন_ তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার সেগুলোতে একদিনে বেশ কয়েক ফুট পানি বেড়ে যাওয়া মোটেই আশ্চর্যজনক ব্যাপার নয়। আর যেগুলোকে পাহাড়ি নদী বলি সেগুলো সকালবেলা গোড়ালি সমান পানি, আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তা তীব্র স্রোতসম্পন্ন প্রমত্ত নদীতে পরিণত হতে পারে।
বিশ্বের অন্য দেশগুলোয় কীভাবে বিশ্ব নদী দিবস উদযাপিত হচ্ছে? এর মূল ওয়েবসাইটে দেখলাম, প্রায় সব দেশেই নদীর সঙ্গে প্রাকৃতিক সম্পর্ক নিয়ে বিভিন্ন ধরনের আলাপ-আলোচনা বা প্রদর্শনীর ব্যবস্থা রয়েছে। কানাডার টরন্টোর কাছে ছোট একটি শহরে মানুষের ঢল নামবে নদীর পাড়ে স্যামন মাছের উজানযাত্রা দেখার জন্য। প্রজননের জন্য স্যামন উজানে অগভীর পানিতে পেঁৗছে যায় এবং তার জীবনচক্র সম্পন্ন করে। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের বদৌলতে এ বিষয়ে প্রায় সবাই অবগত আছি। কিন্তু আমরা ক'জন রুই কিংবা আইড় কিংবা বোয়াল কিংবা পুঁটিমাছ নিয়ে মাথা ঘামাই? এরা যেখানে ধরা পড়ে, সেখানেই কি জন্মে? যারা মৎস্য বিশেষজ্ঞ, তারা জানবেন বটে কিন্তু সাধারণ নাগরিকের কি কৌতূহল নেই? অবশ্যই আছে। কিন্তু তাদের কাছে তা সঠিকভাবে পরিবেশন করা হয়নি বলেই স্যামনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
হালদা নদীতে মা-মাছ যখন ডিম ছাড়ে তখন ওই মাছ রক্ষার জন্য অতি সম্প্রতি কিছু উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে খবরের কাগজে প্রতিবেদন নজরে পড়ছে। এ উদ্যোগ প্রথম কখন নেওয়া হয়েছে তা জানা নেই। তবে ২০০৮-০৯ সালে উপদেষ্টা ড. সিএস করিম এ ব্যাপারে সোচ্চার ছিলেন বলে জানি। বাংলাদেশের নদীতে মেছোকুমির বা ঘড়িয়াল নেই কেন কিংবা শুশুক কেন ধরা হয় এবং পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়_ তা নিয়ে তো প্রশ্ন দেখছি না। নদীতে বাঘাড় নেই কেন, টাকি মাছ কেন দুর্লভ হয়ে গেছে_ এগুলো নিয়ে ভাবার সময় এসেছে।
প্রায় সব দেশেই বিভিন্ন শহরে দেখছি নদীকে দূষণমুক্ত করা এবং নদী থেকে আবর্জনা উদ্ধার করে বিশ্ব নদী দিবস উদযাপনের কর্মকাণ্ডে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। কানাডার একটি ছোট শহরে বলা হচ্ছে, তাদের নদীর পানি এক সময় পুরোপুরি বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল। তারা এর সমাধান করতে পেরেছে। নদীদূষণ বন্ধ হয়েছে। নদীর প্রাকৃতিক পরিবেশ ফিরে এসেছে। বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও জলজ জীবন পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। তাদের এ সাফল্য হচ্ছে বিশ্ব নদী দিবস উদযাপনের কেন্দ্রবিন্দু। ইউরোপের অনেক শহরে দেখছি, নদীতে আনন্দবিহারের আয়োজন করার। এক শহর থেকে আরেক শহরে যাওয়ার আনন্দও এর মধ্যে রয়েছে। কিছু কিছু শহরে দলগত নৌকাবাইচ কিংবা একক নৌকা চালনার উৎসব হচ্ছে। আর নদীর পাড়ে আলোকচিত্র প্রদর্শনীসহ বিভিন্ন ধরনের উৎসবের ব্যবস্থা থাকছে। ১৯৮০ সালে যে শহরে প্রথম নদী দিবস উদযাপিত হয়েছিল সেখানে তারা কবিদের ডেকে নিয়ে এসেছে নদীকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানে লক্ষাধিক লোককে অনুপ্রাণিত করার জন্য। পরে জানলাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও রিভারাইন পিপলের সঙ্গে যুক্ত তরুণরা নদী দিবসে কবিতা পাঠের আসর বসাবে। সব দেশেরই উদযাপনে যে যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছি, সেটি হচ্ছে নদী রক্ষা করা, নদী পুনরুদ্ধার করে মূল অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং নদীকেন্দ্রিক আনন্দ আয়োজন করা।
নদীর জীবন ফিরিয়ে দিতে সরকারি উদ্যোগের বিকল্প নেই। বাংলাদেশের নদীর মালিক সরকার তথা ভূমি মন্ত্রণালয়। সরকারের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া নাগরিক অংশগ্রহণ থেকে কেবল দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে। আমাদের দেশে নদীরক্ষা ও নদী পুনরুজ্জীবনে সরকারের আগ্রহ লক্ষ্য করলেও সক্রিয় কর্মকাণ্ড দেখছি না। নদী পুনর্খননের কাজ হাতে নেওয়া হচ্ছে। নদী পুনর্খননের জন্য ড্রেজিংয়ের কথা বলা হচ্ছে। এ কাজটি নদী পুনরুজ্জীবনের একটি ধাপ মাত্র। আমাদের আশা থাকল, সরকার ও নাগরিক সমাজের যৌথ প্রচেষ্টায় নদীমাতৃক দেশের নদী পুনরুজ্জীবিত হবে। পশ্চিমা বিশ্ব পারলে আমরাও পারব।

অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত :পরিবেশ বিশেষজ্ঞ
 

No comments

Powered by Blogger.