তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভাগ্য-জাতীয় সংসদেই তা নির্ধারিত হোক

সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে অবৈধ ঘোষিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা না রাখার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত সংসদীয় বিশেষ কমিটি। তবে এ বিষয়ে প্রধান বিরোধী দল কোনো প্রস্তাব দিলে তা বিবেচনা করা হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারি দল নিজে থেকে কোনো দায় নিতে চাইছে না।


সে ক্ষেত্রে তারা নির্বাচন কমিশনকে আরো স্বাধীন ও শক্তিশালী করা হবে বলে জানিয়েছে। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সংসদীয় বিশেষ কমিটির বৈঠকে কিংবা সংসদে কোনো প্রস্তাব না রাখলেও বিভিন্ন সময় দলীয় নেতা-নেত্রীরা বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হলে তাঁরা আন্দোলনে যাবেন এবং কোনো দলীয় সরকারের অধীনে তাঁরা নির্বাচনে যাবেন না। সরকারি দল ও বিরোধী দলের এই অনমনীয় মনোভাবের কারণে দেশের সচেতন জনগোষ্ঠী পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে এখন থেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
এটা ঠিক, যে উদ্দেশ্য ও প্রত্যাশা নিয়ে ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তা আগের তাৎপর্য হারিয়েছে। অনেক ঘটনার পর বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে মানুষের ধারণায়ও অনেক পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে বিগত জোট সরকারের আমলে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও পরবর্তী সময়ে ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তিন মাসের বদলে দুই বছর দেশ শাসন করার পর থেকে মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাকে ভিন্ন চোখে দেখতে শুরু করে। তদুপরি ১৯৯৯ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে গণতান্ত্রিক চেতনা ও সংবিধান পরিপন্থী দাবি করে তিন আইনজীবীর করা রিট মামলার আপিল শুনানি শেষে গত ১০ মে সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে রায় দেন।
ইতিপূর্বে সুপ্রিম কোর্ট সামরিক শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করে সে সময়ে সংবিধানে যেসব সংশোধনী আনা হয়েছিল, তার অধিকাংশ বাতিল ঘোষণা করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধনের জরুরি প্রয়োজন দেখা দেওয়ায় সংবিধান সংশোধন-সংক্রান্ত সংসদীয় বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়। তাতে বিরোধী দলের সদস্যদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু বিরোধী দলের কোনো সদস্যই এ পর্যন্ত কমিটির কোনো বৈঠকে যোগ দেননি অথবা কমিটিতে তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরেননি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কমিটি সংসদে উপস্থাপনের জন্য সংবিধান সংশোধনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে, যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা না রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আমরাও মনে করি, একটি গণতান্ত্রিক দেশে সংবিধান তো বটেই, জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয় বা বিরোধের মীমাংসা হওয়া উচিত জাতীয় সংসদে। কোনো গণতান্ত্রিক দেশেই নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয় না। কারণ, সেসব দেশে নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট স্বাধীন ও শক্তিশালী। আমাদের দেশে নির্বাচন কমিশনের ওপর দলীয় সরকার প্রভাব বিস্তার করে বলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়। তাই প্রধান বিরোধী দল ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল যথার্থ স্বাধীন ও শক্তিশালী একটি নির্বাচন কমিশন দাবি করতে পারে এবং জাতীয় সংসদে তার রূপরেখাও তুলে ধরতে পারে। বিরোধী দলের দাবি যদি যথার্থ হয়, তবে তা সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা উপেক্ষা করলেও দেশবাসী তাতে সমর্থন জানাবে। কিন্তু তা করতে হবে জাতীয় সংসদে উপস্থিত হয়ে। তা না করে কেবল হরতাল, অবরোধ কিংবা এ জাতীয় কর্মসূচি দিলে তা দেশের জন্যই অকল্যাণকর হবে এবং এতে দেশবাসীর দুর্ভোগই শুধু বাড়বে।

No comments

Powered by Blogger.