বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩১৬ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মোহাম্মদ হাফিজ, বীর প্রতীক সংকটে-সংগ্রামে অবিচল যোদ্ধা সহযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে মোহাম্মদ হাফিজ নিঃশব্দে পৌঁছালেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের কাছে। সময় গড়াতে থাকল। রাত ক্রমশ শেষ হয়ে আসছে।


হঠাৎ পাকিস্তান সেনাবাহিনী আক্রমণ করল। মুক্তিযোদ্ধারা কিছুটা হকচকিত ও বিপর্যস্ত। মোহাম্মদ হাফিজ সংকটে মনোবল হারালেন না। সহযোদ্ধাদের দ্রুত সংগঠিত করলেন। তাঁর সাহসী প্রচেষ্টায় সহযোদ্ধাদের মনোবল বেড়ে গেল। তাঁরা বীরত্বের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকলেন। এ ঘটনা গোয়াইনঘাটে। ১৯৭১ সালের ২৪ অক্টোবর।
গোয়াইনঘাট সিলেট জেলার অন্তর্গত। ১৯৭১ সালে সেখানে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্ত এক প্রতিরক্ষা অবস্থান। এই প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণ করার জন্য নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ২৩ অক্টোবর রাতে সেখানে সমবেত হয়। নদীর পূর্বপাড়ে আক্রমণের দায়িত্ব ছিল আলফা কোম্পানির। এই দলে ছিলেন মোহাম্মদ হাফিজ। নেতৃত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট মঞ্জুর আহমেদ (বীর প্রতীক পরে মেজর)। হাফিজ একটি প্লাটুনের নেতৃত্ব দেন।
লেংগুরা গ্রামের দক্ষিণে ব্রিজহেড তৈরির মাধ্যমে সুরমা নদী অতিক্রম করে তাঁরা সেখানে পৌঁছান। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁদের উপস্থিতি টের পেয়ে যায়। তারা ভোররাতে (তখন ঘড়ির কাঁটা অনুসারে ২৪ অক্টোবর) তাঁদের আকস্মিক আক্রমণ করে। এ সময় মোহাম্মদ হাফিজ সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন। তুমুল যুদ্ধ চলতে থাকে। দুপুরের পর হেলিকপ্টারযোগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নতুন দল এসে শক্তি বৃদ্ধি করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ফায়ার পাওয়ার ছিল অত্যন্ত বেশি। চরম প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে মোহাম্মদ হাফিজ তাঁর দল নিয়ে সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ চলে। গোটা এলাকা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। কোনো কোনো স্থানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতাহাতি যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ২২ জন শহীদ ও ৩০ জন আহত হন।
মোহাম্মদ হাফিজ এক লেখায় (স্মৃতিচারণ) লিখেছেন: ‘...দুপুর ১২টার দিকে শত্রুরা আমাদের তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। এ সময় অসংখ্য পাকিস্তানি সেনা আচমকা পেছন দিক থেকে এসে ‘হ্যান্ডসআপ’ বলে চিৎকার করে ওঠে। আমি বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে তাৎক্ষণিক শত্রুর দিকে এলোপাথারি ব্রাশফায়ার করি। আমার সঙ্গে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের ত্রিমুখী আক্রমণ খুবই সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করেন। আমরা সবাই শত্রুর বেষ্টনী থেকে বের হয়ে আসতে সক্ষম হই। সে দিনের ঘটনাটি ছিল আমার মুক্তিযুদ্ধ জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা।’
মোহাম্মদ হাফিজ চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ১৯৭১ সালে রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল সৈয়দপুর সেনানিবাসে। তিনি ছিলেন আলফা কোম্পানিতে। তখন তাঁর পদবি ছিল নায়েব সুবেদার। মার্চ মাসে তাঁরা ছিলেন দিনাজপুরের পার্বতীপুরে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে যুদ্ধ করেন জেড ফোর্সের অধীনে।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মোহাম্মদ হাফিজকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৫২।
মোহাম্মদ হাফিজ ২০০৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার রতনপুর গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মুন্সি রহমতউল্লাহ, মা আসাদুন্নেছা বেগম, স্ত্রী আম্বিয়া খাতুন। তাঁর এক ও ছেলে চার মেয়ে।
সূত্র: প্রথম আলোর নবীনগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি গৌরাঙ্গ দেবনাথ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.