চলমান প্রসঙ্গ-বিসিএস পরীক্ষার সময়সূচি by সৌমিত্র শেখর রোবায়েত ফেরদৌস

পিএসসি কর্তৃপক্ষ পুরো ব্যাপারটি পুনর্বিবেচনা করে দেখতে পারে। লিখিত পরীক্ষার্থীর সংখ্যা যেখানে দশ হাজার সেখানে পরীক্ষা আয়োজনেও চাপটা বেশি হওয়ার কথা নয়। মাত্র দু'সপ্তাহ পিছিয়ে লিখিত পরীক্ষা আরম্ভ করলেই ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দুদের প্রধান পূজা এবং বাঙালির সর্বজনীন শারদীয় দুর্গোৎসব অতিক্রান্ত হয় শারদীয় দুর্গোৎসব আবহমানকাল ধরে বাঙালির সর্বজনীন উৎসব হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
পূজার আনুষ্ঠানিকতাটুকু ছাড়া এ উৎসবে অংশগ্রহণ করে থাকে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সব বাঙালি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও দুর্গোৎসব উপলক্ষে একাধিক দিন সরকারি ছুটি থাকত। পঁচাত্তর-পরবর্তীকালে দেশে যখন ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আরম্ভ হয়, তারপর থেকেই এই ছুটি কমিয়ে একদিন অর্থাৎ শুধু দশমীর দিন করা হয়েছে। দশমী যে বছর শুক্র বা শনিবারে হয়, সে বছর দুর্গোৎসবের আলাদা কোনো ছুটি থাকে না। বর্তমান সরকারের সময় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়েছে। এতে ধর্মীয় অধিকারের প্রশ্নে আগের চেয়ে অধিকতর সমতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা আছে। এ সমতা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটি দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে গুরুত্বের সঙ্গে মানা উচিত।
সম্প্রতি ৩১তম বিসিএস (লিখিত) পরীক্ষার সূচি ঘোষিত হয়েছে, যা শারদীয় দুর্গাপূজার মধ্যেই অনুষ্ঠিত হবে। পরীক্ষার সময়সূচি এ রকম_ ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১১ ইংরেজি প্রথমপত্র; ২৭ সেপ্টেম্বর ইংরেজি দ্বিতীয়পত্র; ২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ বিষয়াবলি প্রথমপত্র; ২৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ বিষয়াবলি দ্বিতীয়পত্র; ২ অক্টোবর আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি; ৩ অক্টোবর গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতা; ৪ অক্টোবর বাংলা প্রথমপত্র; ৫ অক্টোবর বাংলা দ্বিতীয়পত্র; ৯ অক্টোবর সাধারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি লিখিত পরীক্ষা। পাশাপাশি এবারের শারদীয় দুর্গোৎসবের সময়সূচি : ২ অক্টোবর ষষ্ঠী; ৩ অক্টোবর সপ্তমী; ৪ অক্টোবর মহাষ্টমী; ৫ অক্টোবর মহানবমী; ৬ অক্টোবর বিজয়া দশমী। অর্থাৎ শারদীয় দুর্গোৎসবের কয়েক দিন আগে থেকে ৩১তম বিসিএস (লিখিত) পরীক্ষা আরম্ভ আর পূজার তিন দিন পর পরীক্ষা শেষ হবে। ষষ্ঠী, সপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী_ এ চার দিন পূজা বাদ রেখে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের যেতে হবে পরীক্ষার হলে। দশমীর দিন ৬ অক্টোবর সরকারি ছুটি থাকায় বিসিএস পরীক্ষা নেই। হিন্দু পরীক্ষার্থীরা সেদিন পূজাস্থলে যেতে পারেন, কিন্তু বাঙালি মাত্রই জানেন, দশমীর দিন আসলে পূজার কোনো আনন্দই থাকে না; সেদিন তো বিসর্জন। এরপর ৯ অক্টোবর পরীক্ষার্থীদের আবার পরীক্ষার হলে যেতে হবে।
এ তারিখ অনুসারে বিসিএস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলে পরীক্ষার্থীদের অন্তত ১০ শতাংশ (জনসংখ্যার অনুপাতে) হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং তার সঙ্গে উৎসবে অংশগ্রহণেচ্ছু মুসলিম ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী পরীক্ষার্থী ভালোভাবে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। দুর্গাপূজা হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। প্রধান ধর্মীয় উৎসবের দিনগুলোতে একটি পাবলিক নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠান উচিত কি-না! এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন, পিএসসিতে চলমান (৩০তম বিসিএস) মৌখিক পরীক্ষা (২০০ নম্বরের) গত ঈদের কারণে প্রায় দু'সপ্তাহ বন্ধ ছিল। যেখানে ২০০ নম্বরের পরীক্ষা (মৌখিক) ধর্মীয় উৎসব ঈদের কারণে প্রায় দু'সপ্তাহ বন্ধ থাকে, সেখানে ৯০০ নম্বরের পরীক্ষা (লিখিত) কোন বিবেচনায় আরেক ধর্মাবলম্বীদের প্রধান উৎসব দুর্গাপূজা চলাকালে অনুষ্ঠিত হবে? এ সিদ্ধান্ত মানবাধিকারের কতটুকু অনুকূলে, ধর্মীয় সমঅধিকারেও কতটুকু সমর্থনযোগ্য?
৩১তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় প্রায় দেড় লাখ পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশের আর কোনো চাকরির পরীক্ষায় সম্ভবত এত বেশি পরীক্ষার্থী অংশ নেওয়ার উদাহরণ নেই। প্রিলিমিনারি পরীক্ষার পর লিখিত পরীক্ষার জন্য খুব বেশি পরীক্ষার্থী নির্বাচিত বা বাছাই করা হয় না। অতীতে দেখা গেছে, লিখিত পরীক্ষার জন্য গড়ে প্রতি পদের বিপরীতে ৯ থেকে ১০ জন পরীক্ষার্থী নির্বাচন করা হয়েছে। এবার প্রায় দেড় লাখ প্রিলিমিনারি পরীক্ষার্থীর মধ্যে দু'হাজার ১০৮টি ঘোষিত পদের বিপরীতে লিখিত পরীক্ষার জন্য নির্বাচন করা হয়েছে ১০ হাজার ২১২ জনকে। অর্থাৎ প্রতি পদের বিপরীতে গড়ে এবার পাঁচ জনেরও কম পরীক্ষার্থী নির্বাচিত হয়েছেন লিখিত পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। পিএসসি সাধারণত বিজ্ঞাপনে ঘোষিত পদের চেয়ে কিছু বেশি পদে নিয়োগ দিয়ে থাকে, অতীতে এমনই দেখা গেছে। তাহলে প্রতি পদের বিপরীতে লিখিত পরীক্ষার্থীর গড় সংখ্যা এবার আরও কমে গেল। এ অবস্থায় যারা ৩১তম লিখিত পরীক্ষার জন্য নির্বাচিত হয়েছেন তাদের সামনে প্রত্যাশা বেশি এবং প্রত্যাশা বেশি বলেই প্রতিযোগিতাটাও সর্বোচ্চ পরিমাণে হওয়ার কথা। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, লিখিত পরীক্ষায় নির্বাচিতদের অন্তত ১০ শতাংশ পরীক্ষার্থী, যারা সনাতন ধর্মাবলম্বী_ লিখিত পরীক্ষার আগে তাদের আরেকটি কঠিন পরীক্ষায় ফেলেছে পিএসসি কর্তৃপক্ষ। এবার কোন দিকে যাবে তারা! এ অবস্থায় সত্যি উদ্বেগের মধ্যে সময় কাটাচ্ছেন সনাতন ধর্মাবলম্বী পরীক্ষার্থীরা।
বেসরকারি ও বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির দুয়ার উন্মুক্ত হলেও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের কাছে প্রত্যাশিত একটি সরকারি চাকরি। পরীক্ষায় অংশগ্রহণের বয়স নির্দিষ্ট থাকায় (৩০ বছর) শিক্ষাজীবন শেষ করার পর দু'একটি বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের বেশি সুযোগ খুব কম ছাত্রছাত্রীই গ্রহণ করতে পারেন। পাস করার পর একজন ছাত্র বা ছাত্রীর ওপর বাড়তে থাকে চাকরি পাওয়ার চাপ আর দ্রুত কমতে থাকে তার চাকরি পাওয়ার সময়। তাই প্রতিটি বিসিএস পরীক্ষাই একজন পরীক্ষার্থীর জন্য অগি্নপরীক্ষা।
পিএসসি কর্তৃপক্ষ পুরো ব্যাপারটি পুনর্বিবেচনা করে দেখতে পারে। লিখিত পরীক্ষার্থীর সংখ্যা যেখানে দশ হাজার সেখানে পরীক্ষা আয়োজনেও চাপটা বেশি হওয়ার কথা নয়। মাত্র দু'সপ্তাহ পিছিয়ে লিখিত পরীক্ষা আরম্ভ করলেই ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দুদের প্রধান পূজা এবং বাঙালির সর্বজনীন শারদীয় দুর্গোৎসব অতিক্রান্ত হয়।

সৌমিত্র শেখর ও রোবায়েত ফেরদৌস :ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত

No comments

Powered by Blogger.