শেকড়ের ডাক-ভোলার হরতাল আমাদের হুঁশ ফেরাবে কি? by ফরহাদ মাহমুদ

ভোলা সদর নদীভাঙন প্রতিরোধ কমিটির ডাকে গত বুধবার ভোলায় অর্ধদিবস পূর্ণাঙ্গ ও স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়েছে। কোনো দোকানপাট খোলেনি, কোনো যানবাহন চলেনি। প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মীরা একত্রে মিছিল করেছে।


অন্যান্য রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সাধারণ মানুষ সব ভেদাভেদ ভুলে নিজেদের অস্তিত্বের তাগিদে এই মিছিলে শরিক হয়েছে। তাদের দাবি একটিই_মেঘনার ভাঙন থেকে ভোলা সদরকে রক্ষা কর এবং শহর রক্ষা বাঁধ দ্রুত বাস্তবায়ন কর। জানা গেছে, গত তিন মাসে ভোলা সদর উপজেলার কাচিয়া, ধনিয়া, ইলিশা, শিবপুর, রাজাপুর ও ভেলুমিয়া ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
অনেকে স্বপ্ন দেখেন, বঙ্গোপসাগরে চর জেগে বাংলাদেশ আয়তনে বেড়ে যাবে। এ সব স্বপ্নচারীর কথা আলাদা। সাম্প্রতিক বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শুধু ভোলা নয়, পুরো উপকূলেরই জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়ে পড়েছে। মহেশখালীসহ বিভিন্ন দ্বীপাঞ্চলের অবস্থাও খুবই করুণ। ভাঙনের ফলে বাড়িঘর হারিয়ে ইতিমধ্যেই লাখ লাখ মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। নোনাপানির ক্রমবর্ধমান অনুপ্রবেশের কারণে উপকূলীয় কৃষিও ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এটিও উদ্বাস্তু হওয়ার অন্যতম কারণ।
কোনো জলোচ্ছ্বাস নয়, কোনো বিপদ সংকেতও ছিল না। গত মার্চে (২০১১) স্বাভাবিক জোয়ারেই হঠাৎ করে তলিয়ে গিয়েছিল ভোলার বিশাল অঞ্চল। ভেঙে গিয়েছিল উপকূল রক্ষা বাঁধের একটি বড় অংশ। হাজার হাজার একর ফসলি জমি নোনাপানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। মার্চ মাসে নদীগুলোর পানি অনেক নিচে থাকে, তখনই ঘটে এই অবস্থা! আর ভরা বর্ষায়, পূর্ণিমা-অমাবস্যার সময় তাঁদের তো রীতিমতো বিনিদ্র রাত কাটাতে হয়। গত বছর ভোলাবাসী বেশ কয়েকবার এ ধরনের অবস্থার শিকার হয়। শুধু ভোলা নয়, উপকূলজুড়ে একই অবস্থা। তা ছাড়া যখন বড় বিপদ সংকেত থাকে, সমুদ্র উত্তাল থাকে, জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে_তখন তো তাদের বিপদের কোনো সীমা-পরিসীমাই থাকে না। বালুর বাঁধের মতো উড়ে যায় উপকূল রক্ষা বাঁধ। জলোচ্ছ্বাস ভাসিয়ে নেয় উপকূলের এসব অবহেলিত মানুষের জীবন ও সহায়-সম্পদ। যেমনটা ঘটেছিল ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার সময়। এর পরও যাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উপকূলীয় এলাকায় পড়ে আছেন, তাঁদের প্রতি কি রাষ্ট্রের কোনো দায়িত্বই নেই?
সিডরের সময় পুরো উপকূলই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। পটুয়াখালী ও বাগেরহাটে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল সবচেয়ে বেশি। আর আইলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সাতক্ষীরা অঞ্চল। এসব জলোচ্ছ্বাসে উপকূল রক্ষা বাঁধের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। সেই বাঁধ চার বছরেও সম্পূর্ণ মেরামত করা যায়নি। তদুপরি এই উপকূল রক্ষা বাঁধ করা হয়েছিল তদানীন্তন পাকিস্তান আমলে, স্বাভাবিক জোয়ারের পানি আটকানোর জন্য। তখনকার পরিবেশে এই বাঁধের উচ্চতা ঠিক থাকলেও পাঁচ দশক পর এর উচ্চতা জোয়ার ঠেকানোর জন্যও যথেষ্ট নয়। ইতিমধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দুনিয়াব্যাপী। বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। বরং সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি। উপকূল রক্ষা বাঁধের উচ্চতা যে পর্যাপ্ত নয়, ভোলার ঘটনাই তার প্রমাণ। কঙ্বাজার বছরে কয়েকবার করে ডুবছে। বর্ষায় স্বাভাবিক জোয়ারেই প্রায় নিয়মিত প্লাবিত হচ্ছে বাগেরহাট শহর। শহর রক্ষার দাবিতে সেখানে অনেক সভা-সমাবেশ-মিছিল হয়েছে। এবার চট্টগ্রাম শহরেও জোয়ারের পানি ব্যাপক অঘটন ঘটিয়েছে। ঝালকাঠি, বরগুনা, পটুয়াখালীসহ অন্যান্য উপকূলীয় শহরের অবস্থাও করুণ। এমন কি বাগেরহাটের সর্ব উত্তরের উপজেলা চিতলমারীতেও এখন হাজার হাজার একর জমি পতিত থাকে নোনাপানি অনুপ্রবেশের কারণে। অথচ এক দশক আগেও এসব মাঠ ভরে থাকত সোনালি ধানে। গোপালগঞ্জ, মাদারীপুরেরও কোনো কোনো অংশে নোনাপানির অনুপ্রবেশ বেড়ে গেছে। এভাবে দেশের অভ্যন্তরে নোনাপানির অনুপ্রবেশ ক্রমেই বাড়ছে এবং বাড়তেই থাকবে। তদুপরি দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বাঁধের বাইরে অরক্ষিত সমুদ্র উপকূলেও বহু মানুষ আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। তারা এখন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে। আবার উপকূলে এমন অনেক এলাকা আছে যেখানে বাঁধ নির্মাণ বা রক্ষা করা সম্ভব নয়। যেমন কঙ্বাজারের টেকনাফসংলগ্ন শাহ পরীর দ্বীপে বাঁধ তৈরির বহু চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু প্রতিবারই জোয়ারের পানি ভাসিয়ে নিয়েছে বালুমাটির বাঁধ। শুধু প্লাবিত করা নয়, বহু এলাকা সাগরগর্ভে বিলীনও হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। মহেশখালী, কুতুবদিয়ার মতো প্রাচীন বসতিপূর্ণ এলাকারও বিশাল অংশ সাগরগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সেখানে বায়ুবিদ্যুতের যে প্রকল্প ছিল, তা-ও আজ চূড়ান্ত ঝুঁকির মুখে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, আগামী এক থেকে দেড় দশকের মধ্যে আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় দুই কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হতে পারে। আবাদযোগ্য জমির অনেকটাই হারিয়ে যাবে। তার ফলে দেশে খাদ্যসংকটও ক্রমেই তীব্র হতে থাকবে।
বিপদ শুধু সাগর নয়, নদীগুলোও। সরকারি হিসাবেই দেশের ৯৭টি নদী আজ মৃতপ্রায়। অন্যগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। ফলে গত বছরও বর্ষায় উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢল এবং কয়েক দিনের টানা বর্ষণে দেশের ১১টি জেলা প্লাবিত হয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যে পরিমাণ পানি সাগরে গিয়ে পড়ে তার প্রায় ৯৪ শতাংশই আসে উজানের দেশগুলো থেকে। মৃতপ্রায় এসব নদী উজানের সেই পানি ধারণ করতে পারে না, বন্যার সৃষ্টি হয়। আবার অনেক এলাকায় সেই পানি আটকেও যায়। গত বছর সাতক্ষীরায় প্রায় ১০ লাখ লোক কয়েক মাস ধরে জলাবদ্ধ অবস্থায় মানবেতর জীবন কাটিয়েছে। কপোতাক্ষ ও বেতনা নদীর দুরবস্থাই এর জন্য দায়ী। এ ছাড়া নদীর গভীরতা কমে যাওয়ায় বর্ষায় ভাঙনও ত্বরান্বিত হয়। গত বছর কুষ্টিয়াসহ যমুনা ও পদ্মা অববাহিকার বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার পরিবার নদী ভাঙনের শিকার হয়েছে। ইতিমধ্যে মেঘনার ভাঙনে ভোলার শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র রক্ষাবাঁধের হার্ড পয়েন্টের কয়েক শ মিটার নদীগর্ভে চলে গেছে। ফলে পুরো গ্যাসক্ষেত্রটিও আজ হুমকির মুখে রয়েছে।
বন্যা ছাড়া অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে যত ক্ষয়ক্ষতি হয়, কেবল বন্যায় প্রতি বছর তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, বাংলাদেশে বন্যার প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে এবং দুটি বড় বন্যার মধ্যবর্তী সময়সীমা ক্রমশ কমে আসছে। আগেই বলেছি, বাংলাদেশে বন্যার প্রধান কারণ হচ্ছে, নদীগুলো ভরাট হয়ে যাওয়া। তাই ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীগুলোর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা ছাড়া বন্যা সমস্যা মোকাবিলার আর কোনো উপায় নেই এবং সেটি করতে হবে ব্যাপক আকারে, যাকে বলা হয় ক্যাপিটেল ড্রেজিং। কারণ প্রতি বছর উজান থেকে আসা পানির সঙ্গে প্রায় ৯৪ লাখ মেট্রিক টন পলি এসে জমা হয় আমাদের নদীগুলোতে। নদীগুলোর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে এর চেয়ে বেশি পরিমাণ ড্রেজিং করতে হবে। তা না হলে নদী ভরাটের পরিমাণ বাড়তেই থাকবে। কিন্তু আমাদের ক্যাপিটেল ড্রেজিং করার মতো ড্রেজার প্রায় নেই বললেই চলে। বর্তমান সরকার দেড় ডজনের মতো ড্রেজার আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে, এর মধ্যে তিনটি ড্রেজার চলেও এসেছে। এখন যত দ্রুত সম্ভব খনন শুরু করা প্রয়োজন। কিন্তু গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বলেছেন, দুই বছরের মধ্যেই ক্যাপিটেল ড্রেজিং শুরু হবে। শিগগিরই সম্ভাব্যতা জরিপের কাজ শুরু হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের আবেদন, প্রক্রিয়াটিকে যথাসম্ভব দ্রুততর করুন। পাশাপাশি নদী খননের কাজে আমরা ভারতের কাছ থেকে সহযোগিতা নিতে পারি। তাদের কিছু ড্রেজারও আলোচনার মাধ্যমে ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রাকৃতিকভাবে কী ভয়ংকর বিপদ ধেয়ে আসছে_আমাদের অধিকাংশ মানুষই তা নিয়ে ভাবিত নয়। ভাবনার অভাব আছে রাষ্ট্রযন্ত্রেরও। তাই বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশের পর দুই দশকেও উপকূল রক্ষা বাঁধ উন্নয়নের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। ভাঙন রোধের জন্যও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। আতঙ্কগ্রস্ত ভোলাবাসীর দলমত নির্বিশেষে নজিরবিহীন হরতালটি সরকারের মনোযোগ আকর্ষণ করবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। সাতক্ষীরা থেকে কঙ্বাজার পর্যন্ত বিস্তীর্ণ উপকূলের কয়েক কোটি মানুষকে রক্ষার প্রয়োজনে সম্ভাব্য সব কিছুই আমাদের করতে হবে। তা না হলে, উপকূলীয় এলাকার দুই কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হবে। তারা রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতে আশ্রয় নিলে সেখানেও মানবিক বিপর্যয় ঘটবে। তাই আগে থেকেই সেই বিপর্যয় রোধে সচেষ্ট হতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, যে মানুষ বা যে জাতি একটু দূরবর্তী চিন্তা করতে পারে, ভবিষ্যৎকে ভাবনায় নিয়ে উন্নয়ন করতে পারে_তারাই টিকে থাকতে পারে। জাতি হিসেবে আমরাও টিকে থাকতে চাই। সে কারণে ২৫ বছর পরের পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের এখন থেকেই কাজ করতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.