শ্রদ্ধাঞ্জলি-স্মৃতি কিংবা বিস্মৃতির কিংবদন্তি

কে হতে চায় কোটিপতি’ অনুষ্ঠানে উপস্থাপক যদি প্রশ্ন করেন, বলুন তো, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ গানটি কে গেয়েছেন? ক. হাবীব খ. ন্যান্সি গ. বালাম ঘ. আব্বাসউদ্দীন আহমদ। তখন ৯৯ শতাংশ দর্শক উত্তরটিতে আটকে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ আব্বাসউদ্দিন নামটি স্মরণ করিয়ে দেওয়ার কেউ নেই।


ঈদের সপ্তম দিন ধরে বিশাল বিনোদন বিপণনে এই কথাটি টেলেপ হলেও বলার দায় ২৫টি চ্যানেলের কারোরই পড়েনি। তাই আমরা চাই নতুন প্রজন্ম কুইজ প্রতিযোগিতায় জিতে কোটিপতি হোক, ধীমান হোক ভারতীয়দের মতো, কিন্তু তাদের প্রতি কারও কোনো দায়িত্ববোধ নেই!
আজ আমি সেই কিংবদন্তির কথা বলব। আমি আমার পিতামহের গল্প বলব। কারণ সেই সুপুরুষ, সুকণ্ঠ, যুগস্রষ্টা শিল্পীর আজ জন্মদিন। তাই আজ তাঁকে মনে করা যায় অকৃপণভাবে। মানুষ নিজের জন্য ভালো কিছু করলে সেটা হয় নিছক সাফল্য, কিন্তু সমষ্টির জন্য মঙ্গলময় কিছু করলেই তাঁকে বলা যায় মহৎপ্রাণ। আব্বাসউদ্দীন আহমদ সেই কিংবদন্তির নায়ক, যিনি সংগীতকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মুসলিম গোঁড়া সমাজে, যে সমাজে আজও দোররা মেরে আসমার মতো ফুটফুটে মেয়েকে হত্যা করা হয়, যে সমাজে শুক্রবারকে সাপ্তাহিক ছুটি রদ করতে সাহস পায় না কোনো সরকার। সুরহীন, সুধারহিত মুসলমানদের ঘরে তিনিই প্রথম মুসলিম গায়ক, যিনি স্বনামে রেকর্ড করেছেন গান আর জুঁজুর ভয় ভেঙে বাঙালি মুসলমানের ঘরে ঘরে বেজেছে সেই শিকলভাঙার গান। ভাবতে বিস্ময় লাগে বৈকি! ৬০-৭০ বছর আগে হালকা-পাতলা, স্বপ্নবান এক তরুণ কী অসীম সাহসে গান গেয়ে শোনালেন আর গোঁড়া মুসলমানের অন্তঃপুরে রেঁনেসার হাওয়া লাগল যেন সেই। চরকা ঘুরল। আজ বাংলাদেশের হূদয় হতেই সবচেয়ে সুললিত সংগীত সৃষ্টি হচ্ছে। নজরুলের সুধাময় বাণী আর আব্বাসের বীণার মতো কণ্ঠসম্পদ ভেঙে দিয়েছিল মুসলমান সমাজের অচেতনতার ঘুমঘোর। সংগীত ছাড়া আলো নেই, সুর ছাড়া ঈশ্বর নেই, হয়তো অবশেষে বুঝল তারা।
গতকাল রাতে আমি আর আমার বাবা একটি সিনেমা দেখছিলাম। নায়ক নায়িকাকে বলছে, ঐ যে সস্তা ভাতের হোটেলে বসি, চলো। দৃশ্যে কলাপাতায় ভাত আর সামান্য তরকারি খাচ্ছেন রাইমা সেন আর রাহুল বোস। আমার বাবার চোখ জলে টলমল। বললেন, আমরা গরিব ছিলাম তো মা, কষ্ট লাগে দেখতে। আমি ভাবলাম আনমনে, আমি কখনো দরিদ্র ছিলাম না। গরিবি বুঝতে কি গরিব হতে হয়? সম্ভবত না। কারণ, মানুষ তো অভিজ্ঞতা দিয়েই স্পর্শ নেয় না শুধু। স্পর্শ নেয় বোধ দিয়েও। ঘরের জানালা দিয়ে বাড়ির পাশে ঘর্মাক্ত নির্মাণশ্রমিকদের দেখে কত দিন আমি জমাটবাঁধা কষ্টবুকে ভাত খেতে পারিনি। কিন্তু বোধের পর কি? উপলব্ধির পর কি? প্রতিফলনহীন আয়না তো শুধুই পারদ। আমার দাদু আব্বাসউদ্দীন ছিলেন সময়ের আয়না। সমাজের অচলায়তন ভেঙে দিয়েছিলেন। যক্ষ্মপুরীর মাঝে এনে দিলেন বসন্তের গান। কুঠার দিয়ে ভেঙে ফেললেন নোনাধরা দেয়ালগুলো। গায়ক ছিলেন না নিছক, ছিলেন মহাবীরের দক্ষিণ হাত, বরাভয় প্রবল পুরুষ।
তাঁর লেখা আত্মজীবনী আমার শিল্পীজীবনের কথা পড়লে বোঝা যায় তাঁর অনুপম ব্যক্তিত্বের অন্তর্গত প্রখরতা। গল্পের মতো মনে হলেও উদ্ধৃত করি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস পূর্ব পশ্চিম থেকে:
১৯৪৭ সালে বহরমপুরে প্রাদেশিক সমাবেশে জিন্নাহ এসেছেন সভাপতিত্ব করতে। গ্রামবাংলার হাজার হাজার মানুষ এসেছে। সভাপতি জিন্নাহ সাহেব সভার অনুষ্ঠানসূচি হাতে তুলে নিলেন। প্রথমেই উদ্বোধনী সংগীত গাইবেন আব্বাসউদ্দীন। কঠোর ভাবলেশহীন সুরে তিনি নির্দেশ দিলেন, ‘নো মিউজিক’। বিস্ময়ের ঘোর কাটার জন্য কয়েক মুহূর্ত সবাই স্তব্ধ। তার পরই শুরু হলো হট্টগোল। আব্বাসউদ্দীনের গান হবে না, এ আবার কী রকম কথা? সভা চলতেই দেওয়া হবে না। জিন্নাহ বোঝেননি যে আব্বাসউদ্দীন নামের কে একটা গায়ক লোকবাংলার মানুষের কাছে এতখানি জনপ্রিয়। অবস্থা বেগতিক দেখে তিনি রাজি হলেন। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পর আব্বাস গেয়ে শোনালেন পরপর তিনখানা গান।
আজও বাংলার বিস্তীর্ণ নদীর বুকে পালতোলা নৌকা থেকে যখন ভেসে আসে ‘ওকি ও বন্ধু কাজল ভোমরা রে, কোনদিন আসিবেন বন্ধু কয়া যান কয়া যান রে’— চকিতে চিনে নেয় সহজিয়া মানুষ, ওই যে আব্বাসের গান! গ্রামবাংলার গান, মাঠের গান, প্রান্তরের গান, হালুয়া চাষির গান, বিরহী কিষানির হাহাকার তুলে এনে ব্রাত্যজনের অন্দরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আব্বাসউদ্দীন।
পথ নির্মাণ করে অসামান্য কেউ। সেই পথের ওপর গড়ে ওঠে সভ্যতা, সংস্কৃতি মেলে ডালপালা, হাজার বছর ধরে হাজার মানুষের পথচলা। সংস্কৃতি, সংগীতের রথ ছুটে চলে সম্মুখপানে। পথ তাঁকে মনে রাখল কি না, কি এসে-যায়? প্রিয়তম পাতা ঝরে যায়, কালের রথের ঘূর্ণিতে মধ্যমেধার মহাযজ্ঞের এই ভূখণ্ডে কিংবদন্তিরা হয়তো বা অভিমান করেই বারবার বড় একটা আসেন না। তত দিন চলতি পথের পথিকই সবাই। পুরোনো রেকর্ডটাই বাজবে স্মৃতি-বিস্মৃতির ওপার থেকে ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’—অচেনা আব্বাসউদ্দীনের গান বাজবে নতুন কোনো আব্বাসের আবির্ভাবের আশায়।
শারমিনী আব্বাসী

No comments

Powered by Blogger.