কূটনীতি-গরিবের কথা বাসি হলে ফলে by হাসান শাহরিয়ার

ভারতের একটি বিরাট লবি বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্কে বিশ্বাসী নয়। এ পর্যন্ত এই লবিটি সফলকাম হয়েছে। তিস্তা চুক্তি না হওয়ার পেছনেও এই লবিটির হাত আছে কি-না কে জানে? তবে গত ৪০ বছরে বাংলাদেশ আর পিছিয়ে নয়। এখন অনেক এগিয়েছে। ভারত তো বাংলাদেশকে তার বাজারে পরিণত করেছে।
বদলে বাংলাদেশ কিছুই পায়নি, এ দেশের পণ্যের প্রবেশাধিকারই নেই সে দেশে এ মাসের প্রথমদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যখন সদলবলে ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে ফিরতি সফরে ঢাকায় আসেন, তখন আমি বিদেশে ছিলাম। যাওয়ার আগে দুই দেশের পত্রপত্রিকা পড়ে ও টিভি চ্যানেলের খবর দেখে মনে হয়েছিল, এই 'ঐতিহাসিক' সফরে বুঝিবা বিরাট কিছু ঘটে যাবে, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি হবে; সীমান্তে নিরীহ লোকের প্রাণহানি ঘটবে না, অবাধে বাংলাদেশি পণ্য পাওয়া যাবে ভারতের বাজারে, তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা পাবে বাংলাদেশ, ভারত সফরে ভিসাপ্রাপ্তি সহজ হবে এবং সর্বোপরি দুই দেশের জনগণের মধ্যে স্থাপিত হবে বন্ধুত্বের সম্পর্ক, দূর হবে প্রায় চার দশকের অবিশ্বাস ও সন্দেহ। কিন্তু দেশে ফিরে ওই সময়ের সংবাদপত্র দেখে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ! এ কী হলো? শুনলাম, ওই দু'দিন নাকি দুই প্রধানমন্ত্রীর মুখে কেউ হাসি দেখেনি। না দেখারই কথা। দীর্ঘ আড়াই বছরের সব কসরত আপাতত ভেস্তে গেছে, শিকেয় ঝুলেছে বহু প্রতীক্ষিত তিস্তা চুক্তি। ট্রানজিট চুক্তি সই না করে বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে, গিভ অ্যান্ড টেক না হলে কোনো স্থায়ী সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় না। অর্থাৎ একতরফাভাবে কিছুই করা যায় না, উভয় পক্ষকেই সমানতালে এগিয়ে আসতে হয়। এতে বাহবা পেয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। পানি না দিলে ট্রানজিট নয়_ এই সিদ্ধান্ত ছিল শেখ হাসিনার সরকারের দূরদর্শিতার বহিঃপ্রকাশ। এমনকি বিরোধী দল বিএনপি পর্যন্ত এ ইস্যুতে সরকারকে দোষারোপ করতে পারেনি।
ভাবলাম, কিছু একটা লেখা দরকার। কিন্তু হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য আবার দেশের বাইরে যেতে হলো। ফিরে এসে আর পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটার ইচ্ছা ছিল না; কিন্তু সমকালের নাছোড়বান্দা সহকারী সম্পাদক অনুজপ্রতিম শেখ রোকনের ক্রমাগত তাগিদ উপেক্ষা করতে পারলাম না। এ সম্পর্কে নিশ্চয়ই অনেকে লিখেছেন; কিন্তু আমি তাদের সবার লেখা পড়তে পারিনি। তবে চর্বিত চর্বণ না হলেই হলো। যদি হয়, তবে তা হবে অনিচ্ছাকৃত ও কাকতালীয়।
সত্যিকার অর্থেই মনমোহন সিংয়ের এই সফর ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমর্থন পেয়েছিলেন সব দলের। সবাই চেয়েছিল সফরটি সার্থক হোক। বিএনপির গয়েশ্বর রায় বেফাঁস কথা বলায় তাকে গালমন্দ দিয়েছেন খালেদা জিয়া। সংযত আচরণ করার নির্দেশ দেন দলীয় নেতাদের। তিনি নিজেও মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে দেখা করে দুই দেশের সম্পর্ক জোরদার করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবিমৃষ্যকারিতা, একগুঁয়েমি ও অদূরদর্শিতার কারণে এই সফর সম্পূর্ণ সফল না হওয়ায় শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের জনগণও আশাহত হয়েছে। দীর্ঘ ৪০ বছর পর দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করার মহৎ সংকল্প নিয়ে মনমোহন সিং ঢাকায় এলেও ফিরে গেলেন বিমর্ষ হয়ে, মাথা নিচু করে। তিনি ভাবতেও পারেননি তারই জোটের শরিক দল তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রীর অপরিপকস্ফতার কারণে বিদেশের মাটিতে তাকে এক বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। এই ধাক্কাটা দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুব একটা সুখকর হয়নি, অবিশ্বাস-সন্দেহ বাড়বে, কমবে না।
রাজনীতি ও কূটনীতিতে নাকি শেষ কথা বলে কিছু নেই। আজ যে শত্রু, কাল সে হতে পারে বন্ধু। সবই নির্ভর করে স্বার্থের ওপর। নিজের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে কেউ বন্ধুত্ব করে না। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যে স্বার্থ আদায় করে নিতে পারে সে-ই সফল রাজনীতিক বা কূটনীতিক। এ ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জুড়ি নেই। ক্ষমতায় যাওয়ার সব কূটকৌশল তার জানা আছে। তাই কখনও তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে আঁতাত করেন, আবার কখনও বিজেপির সঙ্গে হাত মেলান। নির্দিষ্ট কোনো নীতি তিনি অনুসরণ করেন না। স্বার্থসিদ্ধির জন্য যখন যা করেন, তখন তা-ই হয় তার নীতি। অটল বিহারি বাজপেয়ি, সোনিয়া গান্ধী কিংবা মনমোহন সিং তাকে হাড়ে হাড়ে চেনেন। তামিলনাড়ূ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এআইএডিএমকে নেত্রী সাবেক চলচ্চিত্র নায়িকা জয়ললিতার মতো চাপ সৃষ্টি বা প্রয়োজনে ব্ল্যাকমেইল করে কড়ায়-গণ্ডায় নিজের স্বার্থ আদায় করে নিতে মমতা সিদ্ধহস্ত। তাই ভিন্ন দলের ভারতীয় নেতারা সন্তর্পণে ও সাবধানতা অবলম্বন করে তাদের সঙ্গে মেলামেশা করেন। কিন্তু এতসব জানা সত্ত্বেও মমতার কাছেই কুপোকাত হলেন বর্তমান ভারতের চাঙ্গা তথা ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির রূপকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। তার ঢাকা সফরে অন্য চারজন মুখ্যমন্ত্রী সফরসঙ্গী হলেও অজানা কারণে বেঁকে বসলেন মমতা। তিনি এলেন না, সাফ বলে দিলেন_ তিস্তা চুক্তিতে তার সায় নেই। কেন শেষ মুহূর্তে মমতা তাকে ল্যাং মারলেন তা এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না মনমোহন সিং। এটা ছিল মমতার স্টাইল, সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের মোক্ষম হাতিয়ার।
বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেন আরও উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠেছেন। এখন তিনি আর কেন্দ্রীয় সরকারকে তোয়াক্কাই করছেন না। ভাবছেন, তিনি পশ্চিমবঙ্গের অধীশ্বর, কেন্দ্রীয় সরকার বোধকরি তার কথায়ই চলবে। এর সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে তিস্তা চুক্তিতে প্রথমে সম্মতি প্রকাশ করে কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ ছাড়াই পরে পিছুটান দেওয়া। মমতা ভালো করেই জানেন, ইউপিএর শরিক দল তৃণমূল কংগ্রেসের ১৯ জন সদস্যের সমর্থন হারালে মনমোহন সিং সরকারের অবস্থা হবে টলটলায়মান। সম্ভবত এ সত্য উপলব্ধি করেই মনমোহন সিং মমতাকে বিগড়াতে চান না, একটি বোঝাপড়ায় আসতে আগ্রহী তার সঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট বিজয়ী হওয়ার পর কূটনৈতিক প্রটোকল ভঙ্গ করে নেহাত আবেগের বশে ভারতের একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটা ছিল তার উদারতা। তিস্তা চুক্তির প্রশ্নে শেখ হাসিনা মমতাকে ফোন করেছিলেন; 'দিদি' বলে সম্বোধন করলেও তার কথার কোনো দাম দেননি মমতা। নির্বাচনে জয়লাভের পর বাংলাদেশের একজন সাবেক মন্ত্রী (যার সঙ্গে মমতার সুসম্পর্ক ছিল) তাকে লোক মারফত চিঠি পাঠিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। কিন্তু মমতা সেই চিঠির জবাব দিয়ে সৌজন্য প্রকাশ করেননি। অনেকেই বলে, 'দিদি বদলে গেছেন।' কিন্তু 'দিদি' বোধহয় ভুলে গেছেন সোনিয়া গান্ধী, মনমোহন সিং এবং সর্বোপরি কংগ্রেসের সমর্থন না পেলে ক্ষমতায় আসা ছিল তার জন্য সুদূরপরাহত। তিনি যদি তার এই হামবড়া ভাব ত্যাগ না করেন তাহলে আগামী নির্বাচনে হয়তো তাকে আগের মতো হেরে গিয়ে দরজায় খিল মেরে সাত দিন ঘরে বসে থাকতে হবে।
খরস্রোতা তিস্তা নদী ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং-জলপাইগুড়ি হয়ে বাংলাদেশের লালমনিরহাট দিয়ে কুড়িগ্রামের চিলমারীতে প্রবেশ করে ব্রহ্মপুত্রে গিয়ে পড়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তিস্তার ৪৫০ কিউসেক পানি প্রবহমান রেখে অবশিষ্ট ৪৮ শতাংশ পাবে বাংলাদেশ এবং ৫২ শতাংশ ভারত। প্রথমে ১৫ বছর মেয়াদি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি হবে। পরে পানিপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করে একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষর করা হবে। মমতা বলছেন, পানির হিসাবে ৩৫ হাজার কিউসেক যদি বাংলাদেশ পায়, তাহলে উত্তরবঙ্গের সেচব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, বিপন্ন হবে কৃষি। তার ঘনিষ্ঠরা বলেন, স্থানীয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতা মেনে নিয়েই চুক্তিতে তাকে বাদ সাধতে হয়েছে। তবে বাংলাদেশকে এই পরিমাণ পানি দিলে আদৌ কৃষির ক্ষতি হবে কি-না সে সম্পর্কে কোনো তথ্য তার সরকারের কাছে নেই। তার সমালোচকরা বলেন, এটি নেহাত একটি রাজনৈতিক চাল। পশ্চিমবঙ্গের যে এলাকা দিয়ে তিস্তা প্রবাহিত হয়েছে সে অঞ্চলটি সিপিএমের দখলে। তৃণমূলের কোনো ভিত নেই সেখানে। ওই অঞ্চলে পানি দেওয়ার আগে সেখানে তিনি তার দলের অবস্থান সুদৃঢ় করতে চান। বড় আশা নিয়ে দিলি্ল গিয়ে তার শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সোনিয়া গান্ধী ও মনমোহন সিংকে। কিন্তু তারা আসেননি। এতেও নাকি তিনি তাদের ওপর ক্ষ্যাপা।
চুক্তি নিয়ে মমতার আপত্তির পর মনমোহন সিংয়ের উপদেষ্টা শিবশংকর মেননের দ্বিতীয় দফা ঢাকা সফরে পানির হিস্যা নির্ধারণ করা হয় সম্পূর্ণ প্রবাহের ৫০ঃ৫০ ভিত্তিতে। এই হিস্যায় চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশ ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হতো বলে মন্তব্য করেছেন তরুণ সাংবাদিক আরিফুর রহমান সাগর। কারণ এতে ৪৫০ কিউসেক মূল প্রবাহের জন্য কোনো বরাদ্দ না থাকায় বাংলাদেশের হিস্যা থেকেই মূল প্রবাহের জন্য পানি ছাড়তে হবে। এতে শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি থাকবে না। ঠিক যেমনটি হয়েছিল ফারাক্কার ক্ষেত্রে। তিস্তা চুক্তি না হওয়ার কারণে এবং শুষ্ক মৌসুমে ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে। ফলে শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সেচের পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়।
ভারতে ইতিমধ্যে আঞ্চলিক রাজনীতির ওপর কেন্দ্রের কর্তৃৃত্ব খর্ব হয়েছে। সে দেশের পররাষ্ট্র সচিব রঞ্জন মাথাই তো বলেই ফেলেছেন, ভারতের কোনো রাজ্যকে বাদ দিয়ে কোনো চুক্তি (বিদেশের সঙ্গে) সম্পাদিত হবে না। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো এখন আর আগের মতো কেন্দ্রের ওপর সম্পূর্ণ ভরসা করতে পারে না। তারা তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ভুটান ও চীনের সঙ্গে সরাসরি বাণিজ্যিক যোগাযোগ গড়ে তুলতে চায়। কিন্তু বাদ সাধে কেন্দ্রীয় সরকার। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার যদি বাংলাদেশের সঙ্গে হৃত বন্ধুত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে না পারে, তাহলে ভারতের রাজনীতিতে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে ভারতের অবহেলিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে উন্নয়নের ধারায় নিয়ে আসতে আরও কয়েক যুগ লেগে যাবে। শুধু তা-ই নয়, এই ফাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আরও মরিয়া হয়ে উঠবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সহযোগিতা না পেলে ভারত কিছুই করতে পারবে না। মমতা যা-ই বলুন না কেন, তিস্তা চুক্তি স্থগিত রেখে শেষ পর্যন্ত তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন এবং ট্রানজিট সুবিধা হলে পশ্চিমবঙ্গই লাভবান হবে। কিন্তু এ কথা তাকে বোঝাবে কে?
এটা সত্য যে, ভারতের একটি বিরাট লবি বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্কে বিশ্বাসী নয়। এ পর্যন্ত এই লবিটি সফলকাম হয়েছে। তিস্তা চুক্তি না হওয়ার পেছনেও এই লবিটির হাত আছে কি-না কে জানে? তবে গত ৪০ বছরে বাংলাদেশ আর পিছিয়ে নয়। এখন অনেক এগিয়েছে। ভারত তো বাংলাদেশকে তার বাজারে পরিণত করেছে। বদলে বাংলাদেশ কিছুই পায়নি, এ দেশের পণ্যের প্রবেশাধিকারই নেই সে দেশে। প্রতিবেশী হওয়া সত্ত্বেও ভারতের বাজার পায়নি বাংলাদেশ। বিশ্বায়নের এই যুগে নতুন মিত্র খুঁজে পেয়েছে বাংলাদেশ। ভারতের বাজার ছাড়াই বাংলাদেশ টিকে আছে এবং ভালোভাবেই। জোরজবরদস্তির দিন শেষ। বাংলাদেশ এখন আর বসে নেই, হাঁটতে শিখেছে, মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা এখন আর শুধু দিলি্লর দিকে তাকিয়ে থাকবে না। তবে কেউ যদি মনে করে ঢাকা দিলি্লর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে, তবে বলব সে বোকার স্বর্গে বাস করছে। শুধু গার্মেন্ট নয়, বাংলাদেশ আজ ভারী শিল্প তৈরি করছে। এমনকি আন্তর্জাতিক মানের জাহাজ নির্মাণ করছে, বিদেশে রফতানি করছে। অচিরেই বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। অতএব বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কৃষি, কারিগরি, আইটিসহ স্বার্থসংশ্লিষ্ট অনেক বিষয়ে আদান-প্রদান সম্ভব। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, শুধু একতরফা বন্ধুত্ব হয় না।
মনমোহনের সফর সম্পর্কে ভারত ও বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন ধরনের পর্যালোচনা এসেছে। গোড়া থেকেই লক্ষ্য করেছি, উভয় ক্ষেত্রেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে স্পর্শকাতর এই বিষয়টি নিয়ে কথাবার্তা বলেছেন দুই প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পানিসম্পদমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট অন্য মন্ত্রীদের মূল আলোচনা থেকে দূরে রাখা হয়েছে। তিস্তা চুক্তি সই করার কথা ছিল ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী পবন কুমার বানসাল ও বাংলাদেশের পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেনের। কিন্তু এ বিষয়ে মূল আলোচনা করেছেন মনমোহন সিংয়ের উপদেষ্টা শিবশংকর মেনন, শেখ হাসিনার উপদেষ্টা গওহর রিজভী ও মশিউর রহমান। রাজনীতিবিদদের বাদ দিয়ে আমলাদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার জন্য বাংলাদেশের কোনো মন্ত্রী প্রকাশ্যে কিছু না বললেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ ব্যাপারে ঘোরতর আপত্তি জানিয়েছেন। একপর্যায়ে তিনি শিবশংকরের সঙ্গে সাক্ষাৎই করেননি। মনমোহন প্রমাণ করেছেন, তার কোয়ালিশন সরকার দুর্বল; কিন্তু হাসিনার ক্ষেত্রে তো তা প্রযোজ্য নয়। তবুও তিনি কেন উপদেষ্টাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে তাদের 'সুপার মিনিস্টার'-এর দায়িত্ব দিচ্ছেন তা বোধগম্য নয়। বিষয়টি যদি রাজনীতিবিদরা হ্যান্ডেল করতেন তাহলে এ রকম বিপর্যয় ঘটত না। প্রধানমন্ত্রীর নিশ্চয়ই মনে আছে, গঙ্গা চুক্তি সম্পাদনের আগে তদানীন্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ও বিজেপির এল কে আদভানিসহ ভারতের বিরোধীদলীয় নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করে চুক্তির প্রশ্নে তাদের সায় আদায় করে নিয়েছিলেন। ঠিক এমনটি হয়েছিল ফারাক্কা চুক্তির সময়ও। হাসিনার দুই উপদেষ্টা মমতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। জানতে ইচ্ছা করছে, তার সঙ্গে তারা কী আলাপ করেছিলেন? আমি এর আগে লিখেছিলাম, 'বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কে প্রণয়ন করেন এ প্রশ্ন অনেকের। কারণ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিব থাকা সত্ত্বেও পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দেন তার পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক গওহর রিজভী, অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান ও অ্যাম্বাসেডর এট লার্জ এম জিয়াউদ্দিন। প্রধানমন্ত্রীও বিভিন্ন সময়ে তাদের কাজে লাগান। তারা কী করেন অনেক সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানতেও পারে না। তবে সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয়কেই বাস্তবায়ন করতে হয়। তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।' (সমকাল, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আয়োজন, ২২ জুন, ২০১১)। শেষ পর্যন্ত বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। এখন প্রমাণিত হয়েছে, সব কাজ সবাইকে দিয়ে হয় না। যার কাজ তাকে করতে হয় এবং ঠিক সময়ে আঘাত হানতে হয়। কথায় বলে, গরিবের কথা বাসি হলে ফলে। তবে অনেকেই তা বেমালুম ভুলে যান। পরে খেসারত দেওয়ার সময় তা মনে পড়ে। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে যায়।

হাসান শাহরিয়ার : ইন্টারন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন

No comments

Powered by Blogger.