চরাচর-আধুনিক মননে শ্রীরামকৃষ্ণ by রীতা দত্ত

বর্তমানে আমরা এমন এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি যখন একদিকে বিজ্ঞানের অভাবনীয় আবিষ্কারের ফসল তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে সমগ্র বিশ্ব সহজ দৃষ্টিগোচর; অন্যদিকে বিপরীতভাবে পৃথিবীব্যাপী চলছে বড় রাষ্ট্রগুলোর শক্তি প্রকাশের প্রতিযোগিতা, ধর্মান্ধতা, সংকীর্ণতা এবং সাম্প্রদায়িকতার উৎকট প্রকাশ, যা আমাদের মানবিক মূল্যবোধগুলোকে প্রতিনিয়তই ভূলণ্ঠিত করছে।


এগুলো দেখে চারদিকের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাওয়ার কষ্ট তীব্রভাবে অনুভব করছি। দেখছি সাংবার্ষিক নানা অনুষ্ঠান-ধর্মীয় অনুষ্ঠান, ধর্মীয় সভা, মহাসমারোহে ধর্মীয় শোভাযাত্রা, ধর্মমহোৎসব, সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন। কোনোটিরই কমতি নেই। কিন্তু এতদসত্ত্বেও আমাদের নৈতিক এত অবক্ষয় কেন হচ্ছে? পরিবেশ দূষণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের মধ্যেও চলছে নৈতিক দূষণ। আমাদের সন্তানরা ঝুঁকে পড়েছে (অবশ্য অভিভাবকদের) অতিউৎসাহে অর্থকরী বিদ্যা অর্জনে, যা দিয়ে আয়াশ হবে-প্রাচুর্য্য হবে। কিন্তু সন্তানটির মধ্যে মানবিক মূল্যবোধগুলোর সঞ্চার হচ্ছে কি না সেদিকে দৃষ্টি দেওয়ার সময় আমাদের নেই।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে কলকাতার উপকণ্ঠে দক্ষিণেশ্বরে ভাব-ভাস্বর শ্রীরামকৃষ্ণ ধর্মসাগর মন্থন করে যে অমৃত তুলে এনেছেন এবং জানিয়েছেন অমৃতের পুত্রকে, যাতে তারা নিজেদেরও অমৃতময় করে তুলতে পারে। তিনি এমন আদর্শ দেখালেন, যা সবার গ্রহণযোগ্য। কোনো কঠিন কথা নেই, জটিলতা নেই। চেষ্টা কেবল নিজের জীবনকে শুদ্ধ করা, পবিত্র করা। বিখ্যাত ঐতিহাসিক টয়নবি বলেছেন, ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণে বস্তুবল অপেক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বল। শ্রীরামকৃষ্ণ উনিশ শতকে মানুষের কাছে এ আধ্যাত্মিক বল সঞ্চারিত করেছিলেন তাঁর মুখনিঃসৃত 'যত মত তত পথ' এ বাণী দিয়ে। এ বাণীতে মানুষের বিশ্বাস দৃঢ় হয়; কারণ বাণীটি তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা প্রসূত। শ্রীরামকৃষ্ণের বাণীর এ বিশেষত্ব ঐতিহাসিক টয়নবির কথায় এই রূপ : 'শ্রীরামকৃষ্ণের বার্তার অতুলনীয় বৈশিষ্ট্য এই যে এটি তাঁর কর্ম বা আচরণের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছিল।'
বর্তমানে আমরা পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা সম্পর্কে শুনছি। যা অতীতের বর্বরতাকে হার মানায়। নিজেদের আধুনিক-শিক্ষিত বলে দাবি করছি, অথচ এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের মন-মানসিকতা আমাদের নেই। আজ থেকে অর্ধশতকেরও আগে নারীর অবমাননার যুগে শ্রীরামকৃষ্ণ নারীকে সর্বোত্তম মর্যাদা দিয়ে নিজ সহধর্মিণী সারদাদেবীকে দেবীজ্ঞানে পূজা করে জগতের সামনে অনন্য সাধারণ দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছিলেন, যাতে নারীকে যথাযথ সম্মান দেওয়া হয়। শ্রীরামকৃষ্ণের কাঙ্ক্ষিত এবং স্বামী বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনের নিঃস্বার্থ সেবা-আদর্শ, যা মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে প্রাণের বাঁধন গড়ে তোলার কাজে ব্যস্ত, আর এর পেছনে আছে মানুষের অন্তরঙ্গ শুভবুদ্ধির জাগরণ। আজকের সংকটময় বিশ্বে রামকৃষ্ণ মিশন শান্তির বার্তাবহ। UNESCO-এর প্রাক্তন প্রধান Fedrico Mayor সবিস্ময়ে মন্তব্য করেছিলেন, '১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে স্বামী বিবেকানন্দ তাঁহার প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনের যে সংবিধান প্রণয়ন করিয়াছিলেন তাহার সহিত ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে গঠিত ইউনেস্কোর সংবিধানের অত্যাশ্চর্য মিল দেখিয়া আমি সত্যিই বিস্মিত। এই দুই সংবিধানে মানুষের সামগ্রিক উন্নতিকেই মূল লক্ষ্য করা হইয়াছে। দুটি সংগঠনই সহিষ্ণুতার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করিয়াছে। কেননা ইহাই শান্তি পরিস্ফুটনের সহায়ক। ইহারা উভয়ে সমাজে ও সংস্কৃতিতে যে বৈচিত্র্য রহিয়াছে তাহাদের স্বীকৃতি দিয়াছে এবং অখণ্ড ঐক্যলাভের পক্ষে ইহাদের অত্যন্ত আবশ্যিক বলিয়া মনে করিয়াছে।'
উন্নত বিশ্বের সঙ্গে সাজুয্য বজায় রাখার জন্য সমসাময়িক বৈজ্ঞানিক জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি আমাদের আধ্যাত্মিক জ্ঞানেরও প্রয়োজন রয়েছে। মানুষ তার মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলছে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, মানুষ যেন 'মানুষ' হতে পারে, 'মান+হুঁশ' হতে পারে। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতিটি মুহূর্ত ব্যয়িত হয়েছে মানুষের আধ্যাত্মিক চেতনাকে জাগ্রত করার জন্য। তিনি জানতেন, জাগতিক উন্নতির পাশাপাশি যদি আধ্যাত্মিক চেতনা বা আধ্যাত্মিক উন্নতি না হয়, তবে কোনো দেশ, কোনো রাষ্ট্র এবং বিশ্ব সে রকম উন্নতি লাভ করতে পারে না এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা হয় না। সে জন্য শ্রীরমকৃষ্ণ চেয়েছিলেন, যাতে মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিক চেতনা জাগ্রত হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ প্রদর্শিত পথ ব্যক্তি-সমাজ, রাষ্ট্র এবং বিশ্বে শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ গঠনে সহায়ক। শ্রীরামকৃষ্ণের অনুধ্যান করতে করতে এই যুগে যদি তাঁর ভাবে আমাদের জীবনকে পরিচালিত করতে পারি, তা হলে এ বিশ্বের সব সমস্যার সমাধান হতে পারে। এ বিষয়টি স্মরণ করে বারবার তাঁকে প্রণাম জানাই এবং প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদের হৃদয়কে আলোকিত করেন। আমরা যেন শ্রীরামকৃষ্ণের বার্তা উপলব্ধি করার সামর্থ্য অর্জন করতে পারি।
রীতা দত্ত

No comments

Powered by Blogger.