নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন-আইভীর ছেঁড়া পোস্টার আর রাজনীতির ভবিষ্যৎ by শাহ্দীন মালিক

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন ৩০ অক্টোবর। মেয়র পদে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী তিনজন। একজন বিএনপির, একজন আওয়ামী লীগের আর তৃতীয় জন আইভী (ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী)। সচেতন পাঠক, সম্ভবত ইতিমধ্যেই মনে মনে গজ গজ করছেন—এটা তো আমরা সবাই জানি, মায়ের কাছে মামাবাড়ির গল্প বলার আর সময় পেলে না!


তথাস্তু! সোজাসুজি আসল কথায় চলে আসি। আমি করজোড়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সম্মানিত ভোটারদের সবিনয় অনুরোধ করছি, আপনারা ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে ভোট দিয়ে, আপনাদের নতুন সিটির প্রথম মেয়র নির্বাচন করুন।
ধরেই নিচ্ছি, যাঁরা আইভীকে সমর্থন করেন না, তাঁরা অধমের কথায় রুষ্ট হবেন। প্রথম আলোয় পড়েছিলাম, সাংসদ নাসিম ওসমান সাহেব প্রথম আলোর সম্পাদক সাহেবকে গণপিটুনির আশ্বাস দিয়েছিলেন। অধম নগণ্য, তাই প্রত্যাশা অত্যল্প।
আইভীকে ভোট দেওয়ার অনুরোধের কারণ একটাই—নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের ওপরই নির্ভর করবে ভবিষ্যতে আমাদের সাংসদ-মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী কে হবেন। এমনকি বিচারপতি কে হবেন, সেটা এই নির্বাচনের ফলাফলের ওপর নির্ভরশীল। কারণ তিন বছর ধরেই দেখছি, যে দল ক্ষমতায়, প্রধান বিচারপতি শুধু সে দলের সমর্থক আইনজীবীদেরই বিচারপতি নিযুক্ত হওয়ার জন্য যোগ্য মনে করেন। আর নিম্ন আদালতের বিচারকদের মধ্য থেকে কাকে যে কখন বিচারপতি হওয়ার যোগ্য মনে করেন, তার কারণ দর্শানোর কোনো বাধ্যবাধকতা আছে বলে তো মনে হয় না। ফাঁকতালে কিছু ভালো বিচারক যে নিয়োগ পাচ্ছেন না, তা নয়। কিন্তু সুুপ্রিম কোর্ট যেকোনো প্রতিষ্ঠানের, যেকোনো সিদ্ধান্ত যদি ‘কারণ দর্শানো’ ব্যতিরেকে হয়, তাহলে সহজেই সেই সিদ্ধান্তের আইনগত বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে মামলা করলে ফল পাওয়া যায়।
সুপ্রিম কোর্টের রায়েই বলা হয়েছে, কাকে, কেন বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করা হচ্ছে, প্রধান বিচারপতিকে তা লিখিতভাবে জানাতে হবে এবং এ লেখালেখি করার আগে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ও অন্যদের সঙ্গে সলাপরামর্শ করতে অর্থাৎ মতামত নিতে হবে।
আমাদের উইকিলিকস বোধ হয় শিগগিরই হবে না। না হওয়া পর্যন্ত প্রধান বিচারপতির লিখিত এবং কারণসংবলিত মতামত জানতে পারব না। অবশ্য তথ্য অধিকার আইনের আওতায় চেষ্টা তো করা যেতে পারে। জানতে পারলে বোঝা যেত যে, শ দেড়েক জ্যেষ্ঠতর জেলা আদালতের বিচারকদের ডিঙিয়ে যাঁকে সুপারিশ করা হয়েছে, প্রধান বিচারপতি যাঁকে বিচারপতির শপথবাক্য পাঠ করালেন, তিনি যে সবার চেয়ে বেশি যোগ্য, দক্ষ ও সৎ, তা কীভাবে মূল্যায়ন করলেন?
অনেকটা প্রকটভাবে আওয়ামী লীগ কেমন করে বুঝল, নারায়ণগঞ্জের ভোটাররা আইভীকে আর পছন্দ করেন না। পত্রপত্রিকায় পড়েছি, আওয়ামী লীগের নেতারা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অন্তত মিলিত হয়েছেন, আলাপ-আলোচনা করেছেন, সংবাদ সম্মেলন করেছেন, দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী—সেলিনা হায়াৎ আইভী আর শামীম ওসমানকে ঢাকায় তলব করেছেন, সমঝোতার চেষ্টা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে সাংসদ বা এমনকি প্রতিমন্ত্রীর বিকল্প পদও আলাপ-আলোচনায় এসেছে। ফয়সালা হয়নি। আওয়ামী লীগ বেছে নিয়েছে শামীম ওসমানকে।
আইভী ও শামীম ওসমান দুটি পৃথক ঘরানার রাজনীতিবিদ। অধমের সম্বল শুধু সংবাদমাধ্যম। সংবাদমাধ্যম থেকে যা জেনেছি, এর সারমর্ম হলো—আইভী প্রায় আট বছর নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন কিন্তু দুর্নীতি-সন্ত্রাসের তেমন কোনো অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে নেই। সিটি করপোরেশন ঘোষিত হওয়ার পর বেশ কয়েক মাস সরকারি প্রশাসক দায়িত্বে আছে। অর্থাৎ আইভী ‘পদে’ নেই মাস চারেক। এর পরও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি।
অন্যদিকে শামীম ওসমানের কৃতিত্ব-খ্যাতি দেশজোড়া। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা তো প্রায় দেড় ডজন এবং সম্ভবত প্রায় সব কিসিমেরই আছে। আর নিজের দল ক্ষমতায় না থাকলে ভদ্রলোক দেশে থাকতে আগ্রহী হন না সচরাচর। প্রতিপক্ষ দল ক্ষমতায় থাকবে আর আমরা হালুয়া-রুটি বা টু-পাইস কামাব, এমন আশা করার মতো উজবুক তো আর বড় নেতা হতে পারেন না। তাই দেশে থেকে যদি কোনো ফায়দা না হয়, তাহলে দরকার কী।
এখন একেবারে খোদ-আপনা দল ক্ষমতায়। তাই শুধু দেশে থাকা নয়, বড় পদও দরকার এবং দলও মনে করেছে, শামীম ওসমান দলের জন্য আদর্শ প্রার্থী। আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট মাহমুদুর রহমান মান্না প্রথম আলোতে তাঁর ২৬ জুলাইয়ের কলামের (দল না থাকুক, আমরা তো আছি) শেষে লিখেছেন, শামীম ওসমানকে দলীয় সমর্থন দেওয়া দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একটা ভুল সিদ্ধান্ত।
তাঁর সঙ্গে অধম সম্পূর্ণ একমত। কিন্তু এ সিদ্ধান্তটা যে ভুল সিদ্ধান্ত, সেটার প্রমাণ দিতে পারেন একমাত্র নারায়ণগঞ্জের ভোটাররা।

২.
নারায়ণগঞ্জের ভোটাররা যদি শামীম ওসমানকে ভোট দিয়ে নির্বাচন করেন, তাহলে দলের সিদ্ধান্তটা যে ভুল ছিল না, সেটা প্রমাণিত হবে। অর্থাৎ প্রমাণিত হবে আইভীর মতো প্রার্থী, যাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, খুন, চাঁদাবাজি, হানাহানির মামলা বা অভিযোগ নেই, তাঁকে ভোটাররা পছন্দ করেন না। দুর্নীতি করেননি, তাই হয়তো ভোটারদের অপছন্দ।
পক্ষান্তরে যাঁকে সংবাদমাধ্যম ‘গডফাদার’ আখ্যায়িত করছে এবং গডফাদার খেতাব যিনি বহু বছরে, বহু সন্ত্রাসী ও বেআইনি কার্যকলাপে সম্পৃক্ত থেকে যথাযথভাবে মূল্যায়িত হয়েছেন, তাঁর মতো প্রার্থীই ভোটারদের পছন্দ এবং ভবিষ্যতের নির্বাচনে আমরা শামীম ওসমানের মতোই প্রার্থী পাব। দল তখন বলবে, দেখলে তো, এ দেশের ভোটাররা গডফাদারকে পছন্দ করে ভোট দেয়। অতএব আমরা গডফাদার-গোছের প্রার্থীদেরই মনোনয়ন দেব।
আইভী-গোছের প্রার্থীদের সংবাদমাধ্যম এবং নচ্ছার সুশীল সমাজ-গোছের ‘গায়ে মানে না, আপনি মোড়ল’ মার্কা লোকজন যতই চেঁচাক না কেন, জনগণ বেছে নেয় দুর্নীতিপরায়ণ সন্ত্রাসী, গডফাদারদের। শামীম ওসমান, সৈয়দ আবুল হোসেন, শাজাহান খানের মতো লোকজনই এ দেশের ভোটারদের প্রিয় পাত্র। এবং হারিছ চৌধুরী, গিয়াস আল মামুন, লুৎফুজ্জামান বাবর গং। মানি লন্ডারিং, বোমা, হত্যার সঙ্গে জড়িত গংই মনোনয়ন পাবে, ভোট পাবে, নেতা হবে, শহর ও দেশ চালাবে।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, নারায়ণগঞ্জবাসী সন্ত্রাসী রাজনীতির পক্ষে ভোট দেবেন না। দিতে পারেন না। অনেকে অনেকবার বলেছেন, তা-ও পুনরাবৃত্তি করছি—এ দেশের ভোটার সব সময়ই ভালো-মন্দের ফারাক করেছেন সেই ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন থেকে, অর্থাৎ অর্ধশতাব্দীরও আগে থেকে।
অবশ্য অনেক সময় ভোটাররা বাধ্য হয়েছেন দুই বদলোকের মধ্য থেকে একজনকে ভোট দিতে। কারণ প্রার্থীই ছিলেন দুজন। এবার চিত্রটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বদলোকের বিপরীতে পরীক্ষিত ভালো প্রার্থী আছেন—আইভী আছেন।
আইভীকে ভোট দিন। আইভীর পোস্টার ছেঁড়া যায়, কিন্তু ভোটাররা বিভ্রান্ত হন না।
ড. শাহ্দীন মালিক, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট।

No comments

Powered by Blogger.