গ্যাস-সম্পদ-বিদেশি কোম্পানি কত গ্যাস নেয়, আমরা কত পাই by বদরূল ইমাম

বাংলাদেশে বিদেশি তেল কোম্পানিগুলো সরকারের সঙ্গে প্রোডাকশন শেয়ারিং কনট্রাক্ট বা সংক্ষেপে পিএসসির অধীনে কাজ করে থাকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই নানা সময়ে বিদেশি তেল কোম্পানিগুলো দেশের বিভিন্ন স্থানে এ চুক্তির অধীনে গ্যাস অনুসন্ধানের কাজে নিয়োজিত হলেও ১৯৯৮ সালের আগপর্যন্ত এ ধরনের চুক্তির কার্যক্রমে দেশের কতটা লাভ বা ক্ষতি হয়, সে বিষয়টি বিবেচনার সুযোগ আসেনি।


১৯৯৮ সালে সর্বপ্রথম সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র থেকে বিদেশি কোম্পানির দ্বারা গ্যাস উৎপাদন শুরু হওয়ার পর পিএসসি চুক্তির অধীনে কোম্পানি ও দেশের মধ্যে গ্যাস ভাগাভাগির বিষয়টি বাস্তবতা লাভ করে এবং তার ফল বিচার করার সুযোগ হয়। পরে আরও কয়েকটি বিদেশি তেল কোম্পানি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার এবং তা থেকে গ্যাস উৎপাদন শুরু করলে বিষয়টি আরও পূর্ণাঙ্গভাবে বিচার করার সুযোগ হয়। বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে সম্পাদিত পিএসসি চুক্তির ধারাগুলো জনসাধারণের জ্ঞাতার্থে প্রকাশ করা হয় না। তাই জনসাধারণের মধ্যে এ নিয়ে একরকম অবিশ্বাস ও অসন্তোষ বিরাজ করে। আর এ ধরনের অসন্তোষ থেকে জনবিক্ষোভ জন্ম নেয়, যা আমরা সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে লক্ষ করি।
পিএসসির অধীনে দেশের সরকার কর্তৃক বিদেশি কোম্পানিকে নিয়োগ করার প্রচলন শুরু হয় উনিশ শতকের ষাটের দশকে ইন্দোনেশিয়ায়। পরে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় এটির প্রচলন বাড়তে থাকে এবং বর্তমানে এশিয়া-আফ্রিকার প্রায় ৪০টি দেশে এ চুক্তির অধীনে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান চলে। এসব দেশের মধ্যে ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, রাশিয়া, কাজাখস্তান, আজারবাইজান, মিসর, নাইজেরিয়া, সিরিয়া প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত। একটি দেশের সরকারের কাছে এ চুক্তিব্যবস্থার যে দিকটি সবচেয়ে আকর্ষণীয় তা হলো, বিদেশি কোম্পানি তার নিজস্ব অর্থ বিনিয়োগ করে গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ চালাবে। তাতে যদি আবিষ্কারে সফলতা না আসে, তবে ক্ষতির দায় পুরোটাই কোম্পানির নিজের। আর যদি কোনো আবিষ্কার হয়ে থাকে, তখন উৎপাদিত গ্যাস কোম্পানি ও দেশের সরকারের সঙ্গে ভাগাভাগি হবে। তবে এ ভাগাভাগি হওয়ার দুটি পর্যায় থাকে। প্রথম পর্যায়ে উৎপাদিত গ্যাসের একটি অংশ (কস্ট গ্যাস) কোম্পানি তার খরচ উশুল করার জন্য পেয়ে থাকে এবং বাকি অংশ (প্রফিট গ্যাস) কোম্পানি ও সরকারের মধ্যে পূর্বনির্ধারিত অনুপাতে ভাগাভাগি হয়। দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় যখন কোম্পানি তার খরচ পুরোটাই উশুল করে নেয়। এ পর্যায়ে পুরো গ্যাসটি প্রফিট গ্যাস হিসেবে গণ্য হয় এবং তা কোম্পানি ও সরকারের মধ্যে পূর্বনির্ধারিত অনুপাতে ভাগাভাগি হয়।
২০০৮ মডেল পিএসসি অনুযায়ী, বাংলাদেশে বিদেশি কোম্পানি গ্যাস আবিষ্কার করে উৎপাদনে গেলে প্রথম পর্যায়ে প্রতিবছর উৎপাদিত গ্যাসের ৫৫ শতাংশ কস্ট রিকভারি বা খরচ তুলে নেওয়া বাবদ নিতে পারে। বাকি ৪৫ শতাংশ প্রফিট গ্যাসের ন্যূনতম ৫৫ শতাংশ বাংলাদেশ পাবে। অর্থাৎ তার খরচ পুরোপুরিভাবে উশুল না করা পর্যন্ত কোম্পানি উৎপাদিত গ্যাসের ৫৫+২০, অর্থাৎ ৭৫ শতাংশ এবং বাংলাদেশ ২৫ শতাংশ পেতে থাকবে। কোম্পানির খরচ উশুল হয়ে গেলে উৎপাদনের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে উৎপাদিত গ্যাসের ৫৫ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত বাংলাদেশ পাবে (বেশি উৎপাদিত হলে বাংলাদেশের ভাগ বেশি নিয়মে)। কিছুদিন আগে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনকালে গ্যাস ভাগের বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক হতে দেখা যায়। কর্তৃপক্ষ নানাভাবে জনগণকে আশ্বস্ত করতে উদ্যোগী হয় যে বাংলাদেশ ৮০ শতাংশ পর্যন্ত গ্যাস পাবে (ডেইলি স্টার, ২১ জুন ২০১১)।
বাস্তবে বাংলাদেশ কতটা গ্যাস পাচ্ছে: বাংলাদেশে বর্তমানে পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে বিদেশি তেল কোম্পানি পিএসসি চুক্তির অধীনে গ্যাস উৎপাদন করে। এদের সবগুলোতেই প্রাথমিকভাবে খরচ উশুল সময় পার হয়ে গেছে। তাই উৎপাদিত গ্যাসের পুরোটাই এখন প্রফিট গ্যাস এবং তা ভাগাভাগির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ন্যূনতম ৫৫ থেকে সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ পাওয়ার কথা। কিন্তু পেট্রোবাংলা রিপোর্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালের আগস্টে সাগরবক্ষে অবস্থিত সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র থেকে মোট ১ দশমিক ৩ কোটি ঘনমিটার গ্যাস উৎপাদিত হয়, যার মধ্যে বাংলাদেশ পায় ২০ শতাংশ এবং বিদেশি কোম্পানি পায় ৮০ শতাংশ (এমআইএস রিপোর্ট আগস্ট-২০১১)। একই সূত্রে জানা যায় যে ২০১০-১১ আর্থিক বছরে এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে মোট ১৮ দশমিক ৩ কোটি ঘনমিটার গ্যাস উৎপাদিত হয়, যার মধ্যে বাংলাদেশ পায় ২০ শতাংশ এবং কোম্পানি পায় ৮০ শতাংশ।
একই সূত্র অনুযায়ী, শেভরন মৌলভীবাজার গ্যাসক্ষেত্রে ২০১১ সালের আগস্টে মোট ৩ দশমিক ৯ কোটি ঘনমিটার গ্যাস উৎপাদিত হয়, যার মধ্যে বাংলাদেশ পায় ৩৪ শতাংশ এবং কোম্পানি পায় ৬৬ শতাংশ। ২০১০-১১ আর্থিক বছরে এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে মোট ৫০ দশমিক ২ কোটি ঘনমিটার গ্যাস উৎপাদিত হয়, যার মধ্যে বাংলাদেশ পায় ৪১ শতাংশ এবং কোম্পানি পায় ৫৯ শতাংশ।
শেভরন কোম্পানির অন্য গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানা বর্তমানে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ গ্যাস উৎপাদক। এটিতে দৈনিক প্রায় ৭০ কোটি ঘনফুট (প্রায় দুই কোটি ঘনমিটার) গ্যাস উৎপাদিত হয়। পিএসসির চুক্তি অনুযায়ী, খরচ উশুল সময় পার হলে এই পরিমাণ গ্যাস উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার ৭৫ শতাংশ গ্যাস পাবে আর কোম্পানি পাবে ৩৫ শতাংশ। কিন্তু পেট্রোবাংলার সূত্রমতে, ২০১১ সালের আগস্টে এই গ্যাসক্ষেত্রে মোট ৬৩ দশমিক ৬ কোটি ঘনমিটার গ্যাস উৎপাদিত হয়, যার ৬৩ শতাংশ পায় বাংলাদেশ আর ৩৭ শতাংশ পায় কোম্পানি। ২০১০-১১ আর্থিক বছরে এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে মোট ৭১৭ কোটি ঘনমিটার গ্যাস উৎপাদিত হয়, যার মধ্যে বাংলাদেশ পায় ৫৯ শতাংশ এবং কোম্পানি পায় ৪১ শতাংশ। আবার আইরিশ কোম্পানি টাল্লো পরিচালিত কুমিল্লার বাঙ্গুরা গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদিত গ্যাসের ৩৮ শতাংশ পায় বাংলাদেশ আর ৬৬ শতাংশ পায় কোম্পানি।
দেখা যাচ্ছে যে অনুসন্ধান বিনিয়োগ খরচ উশুল করার পরও কোম্পানির ভাগে গ্যাসের পরিমাণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের ভাগের তুলনায় বেশি। এর কারণ হলো, অনুসন্ধান বিনিয়োগ উশুল করা হয়ে গেলেও কোম্পানি অন্যান্য খাতে খরচের অর্থ উশুল করে থাকে। আর এ খরচের খাতগুলো শেষ হয়েও যেন শেষ হয় না।
কস্ট গ্যাসের ঝুলন্ত লেজ: উন্নয়নশীল দেশগুলোয় যেখানে ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাস আবিষ্কারের জন্য আর্থিক সংগতি বা কারিগরি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা রয়েছে, সেখানে পিএসসি চুক্তির মাধ্যমে বিদেশি কোম্পানিকে গ্যাস অনুসন্ধান করতে দেওয়ার আগ্রহ থাকার মূল কারণ এই যে দেশের সরকার এর মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ থেকে বিরত থাকে। আবার গ্যাস অনুসন্ধানে সফলতা পেলে সরকার সে সম্পদের ভাগ পেয়ে থাকে। কিন্তু চুক্তিপত্রে লিখিত গ্যাস ভাগাভাগির পারস্পরিক অনুপাত দেশের পক্ষে আশাব্যঞ্জক (যেমন—খরচ উশুল হয়ে গেলে সরকারের ভাগ উৎপাদিত গ্যাসের ৮০ শতাংশ) মনে হলেও বাস্তবে তা অধিকাংশ সময়ই সরলরেখায় কার্যকর হয় না। এর কারণ হলো, বিদেশি কোম্পানির কস্ট গ্যাসের লেজটা ‘অনির্দিষ্ট সময়ের’ জন্য ঝুলে থাকা। আর এটিকে ঝুলিয়ে রাখার সুচতুর পদ্ধতি চালু রাখতে বিদেশি কোম্পানি যথেষ্ট পারদর্শী।
বিদেশি কোম্পানির খরচ উশুলের বিষয়টি বেশ ঘোলাটে। পিএসসি চুক্তির অধীনে কার্যকরভাবে জড়িত ছিলেন এমন একজন বাংলাদেশি কর্মীর ভাষ্যমতে, বিদেশি কোম্পানি যখন অনুসন্ধানে নামে, তখন তাদের খরচের মাত্রা হয় যথেষ্ট রক্ষণশীল। তার কারণ, গ্যাস না পেলে এ খরচের দায় তাদের। কিন্তু গ্যাস আবিষ্কার হয়ে গেলে তাদের খরচের মাত্রার যেন কোনো লাগাম থাকে না এবং কারণে-অকারণে নানা খাতে তাদের খরচ বাড়তে থাকে। এর কারণ এই যে তখন তারা নিশ্চিত, সব খরচই উৎপাদিত গ্যাস থেকে উশুল (কস্ট গ্যাস) করা যাবে। দুষ্ট লোকেরা বলে, বিদেশি কোম্পানির কর্মীরা নাকি তাদের পোষা বিড়ালকে দামি শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করানোর খরচটিও কস্ট গ্যাস হিসেবে যোগ করে থাকে। বিড়াল বা কুকুরের শ্যাম্পু মাখা তো ছোটখাটো ব্যাপার, বড় খরচের উদাহরণগুলো কম নয়। যেমন—বাংলাদেশের সাগরবক্ষে সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হওয়ার পর উৎপাদন পর্যায়ে গেলে বিদেশি কোম্পানি প্রয়োজনের অতিরিক্ত আকারের প্রসেস প্ল্যান্ট স্থাপন করতে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়। পেট্রোবাংলা দৈনিক ১৫০ থেকে ২০০ ইউনিট ক্ষমতাসম্পন্ন প্ল্যান্ট তৈরির কথা বললেও কোম্পানি ৫০০ ইউনিট ক্ষমতাসম্পন্ন প্ল্যান্ট তৈরি করে, যার জন্য বিশাল আকারের খরচ হয়। সাঙ্গু কখনো ১৫০ ইউনিটের বেশি গ্যাস উৎপাদন করেনি এবং বর্তমানে দৈনিক মাত্র ১৫ থেকে ২৫ ইউনিট গ্যাস উৎপাদন করে থাকে।
আবার খরচ উশুল কেবল অনুসন্ধান ও উৎপাদন খরচের মধ্যেই সীমিত নয়, বরং তাতে ক্যাপিটাল কস্ট, অপারেটিং কস্ট ইত্যাদি যাবতীয় খরচ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আর এই অন্তর্ভুক্তি কোথায়, কতটা যৌক্তিক—তা দেখার দায়িত্ব সরকার ও কোম্পানির যৌথ কমিটির হাতে থাকলেও বিদেশি কোম্পানির সুচতুর কর্মীরা এসব বিষয় সুবিধাজনকভাবে ‘ম্যানেজ’ করার ব্যাপারে সুদক্ষ। তাই দেখা যায় যে বাস্তবে কস্ট রিকভারি বা খরচ উশুলপর্ব যেন শেষই হয় না। আর এ রকম ব্যবস্থাপনা বিদেশি কোম্পানিকে তাদের লভ্যাংশ বাড়িয়ে নিতে সাহায্য করে।
উপরিউক্ত কারণে বিভিন্ন দেশে পিএসসি চুক্তির সুফল নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে। কোনো কোনো দেশ, যেমন—মালয়েশিয়া তার পিএসসি চুক্তিতে খরচ উশুলের অশুভ ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন এনেছে। বাংলাদেশে বিদেশি কোম্পানির কার্যক্রম দেশের জন্য কতটা লাভজনক হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। এটি ঠিক, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে সর্বাধুনিক বিদেশি প্রযুক্তির প্রয়োজন। তবে পিএসসির সনাতনী ধারাগুলো পরিবর্তন করে দেশের স্বার্থ রক্ষার সুনিশ্চিত ব্যবস্থা না করা হলে বিদেশি কোম্পানির প্রযুক্তি ও অর্থবল দেশের কাজে আসবে না।
ড. বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.