রঙ্গব্যঙ্গ -একটি কাল্পনিক গল্প-হরতাল আতঙ্ক by মোস্তফা কামাল

আবদুল আলী সরকারি চাকরি করেন। সচিবালয়ে দ্বিতীয় গ্রেডের চাকরি। বেতন কম। কিন্তু সরকারি বাসায় থাকেন বলে কোনোমতে তাঁর সংসারটা চলছে। তা না হলে বেতনের টাকায় বাসা ভাড়াও দিতে পারতেন না। তাঁর তিন ছেলেমেয়ে। সুমন রহমান তাঁর বড় ছেলে। অনেক কষ্টে তিনি সুমনের লেখাপড়ার খরচ জুগিয়েছেন।


আশায় বুক বেঁধেছিলেন, ছেলে চাকরি পেলে তাঁর সংসারের টানাপড়েন দূর হবে। অন্য ছেলেমেয়ের পড়ার খরচ জোগাতে তাঁকে বেগ পেতে হবে না। তাঁর দুশ্চিন্তাও কেটে যাবে।
সুমন বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ পাস করেছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ইন্টারভিউ দিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু মন মতো চাকরি পাচ্ছে না। তার পরও চেষ্টার ত্রুটি নেই তার। আসলে চাকরি তো আর ছেলের হাতের মোয়া নয় যে হাত বাড়ালেই পেয়ে যাবে। তা ছাড়া মামা-খালুও নেই যে সুমনের জন্য তদ্বির করবেন। চাকরি হলে নিজের চেষ্টাতেই হবে।
সুমন নিজেকেই নিজে সান্ত্বনা দেয়। নিজের চেষ্টায় চাকরি হওয়া অনেক ভালো না! অন্তত কেউ কথা বলতে পারবে না। একদিন সকাল ১১টায় গুলশানের একটি অফিসে তার চাকরির ইন্টারভিউ। সুমন আজিমপুর থেকে বাসে গুলশান ২ নম্বর গোলচক্করে নেমে হেঁটে ইন্টারভিউ দিতে যাবে বলে মনস্থির করে। কিন্তু বাস ফার্মগেটে আসার পর দেখল, সামনে ভয়াবহ যানজট। গাড়ি কিছুতেই আর সামনে এগোচ্ছে না। কী আর করা! অপেক্ষা করতেই হবে। কিন্তু সেই অপেক্ষারও তো একটা শেষ আছে!
অপেক্ষা করতে করতে একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে সুমন গাড়ি থেকে নেমে সামনে এগোতে লাগল। যানজটের কারণ জানার চেষ্টা করল। পরে জানতে পারল, একটি রাজনৈতিক দলের মিছিল বের হয়েছে। তাই যানবাহন চলাচল বন্ধ। চারদিকে পুলিশ আর পুলিশ। প্রধান সড়ক দিয়ে মিছিলের পর মিছিল যাচ্ছে। শেষ কখন হবে তা বুঝতে পারছে না। সুমন আর গাড়িতে না উঠে হাঁটতে শুরু করে। সে দ্রুত হাঁটে আর ঘড়ির দিকে তাকায়। তার হাঁটার চেয়ে যেন ঘড়ির কাঁটা দ্রুত চলছে। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সুমন গন্তব্যে পেঁৗছতে পারছে না। সে এবার সিএনজি অটোরিকশায় ওঠে। কিন্তু অটোরিকশার চাকাও যায় আটকে। কারণ মহাখালীতে ব্যাপক যানজট। শেষ পর্যন্ত সময় ফুরিয়ে যায়। কিন্তু সুমন গন্তব্যে পেঁৗছতে পারে না।
এদিকে আবদুল আলীর সংসার খরচ বাড়তে থাকে। তাঁর সীমিত আয়ে সংসার যেন আর চলে না। প্রতিদিন সুমন তার বাবার শুকনো মুখের দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সহায়তা করতে চায়। কিন্তু চাকরি নামের সোনার হরিণ তাকে ধরা দেয় না। সে বিরক্ত হয়। সে মনে মনে বলে, বাবার এই দুঃসময়ে কেন যে চাকরিটা হয় না! এ সময় বাবার পাশে না থাকতে পারলে আমাকে পড়াশোনা করিয়ে কী লাভ হলো! যে করেই হোক চাকরি আমাকে পেতেই হবে।
সুমন আবার একটি ইন্টারভিউ কার্ড পেয়েছে। বনানীতে একটি বহুজাতিক কম্পানির প্রধান কার্যালয়ে ইন্টারভিউ দিতে যাবে সে। বিকেল ৩টায় ইন্টারভিউ। একই দিন লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা। যদি ভালো পরীক্ষা হয় তাহলে নিয়োগপত্র পেয়ে যাবে সে। কেন জানি তার মনে হচ্ছে, তার পরীক্ষা ভালো হবে এবং চাকরিটা সে পেয়ে যাবে। আগে কখনো তার এ রকম মনে হয়নি। যা হোক, সুমন যথারীতি পরীক্ষা দিতে রওনা হয়।
হঠাৎ রাস্তায় যানবাহনের ব্যাপক জটলা। ঘটনা কী! গাড়ি আর সামনে যাবে না। ভীষণ গণ্ডগোল হচ্ছে। সুমন একে-ওকে জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা ভাই, গণ্ডগোল কিসের?
একজন পথচারী বললেন, গাড়ি ভাঙচুর হচ্ছে। বিআরটিসির দুটি বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে। পিকেটাররা পাগলের মতো আচরণ করছে।
কেন, সমস্যা কী? সুমন আবারও প্রশ্ন করল।
পথচারী বেশ তেজি কণ্ঠে বললেন, আপনি তো দেখছি দুনিয়াদারির কোনো খোঁজখবরই রাখেন না? কী করেন আপনি? গ্রাম থেকে আসছেন নাকি?
'স্যরি ভাই!'
'আবার বলে, স্যরি ভাই!'
'রাগ করেন কেন ভাই!'
'রাগ করব না! হরতাল ডাকছে জানেন না?'
'জানি, জানি তো!'
'এইটা হচ্ছে হরতালের আগের দিনের মহড়া! বুঝতে পারছেন? হরতাল যাতে ঠিকঠাক মতো পালন করা হয় তাই আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে। এবার বুঝছেন?'
'বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার ইন্টারভিউয়ের কী হবে?'
'কিসের ইন্টারভিউ? পথচারী জানতে চাইলেন।'
'না, মানে আমার একটা ইন্টারভিউ আছে।'
'তাহলে হাঁটা শুরু করেন। হাঁটা ছাড়া গতি নেই।'
সুমন মনে মনে ভাবে, লোকটা খারাপ বলেনি। রাস্তার যে অবস্থা, হেঁটে হেঁটেই যেতে হবে। সুমন হাঁটা শুরু করল। হঠাৎ দেখল, মিছিলকারীরা এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছে। পেছন থেকে ধেয়ে আসছে পুলিশ। পিকেটাররা ইটের খোয়া মারছে। আর পুলিশ ছুড়ছে কাঁদানে গ্যাস। এর মধ্যে কাঁদানে গ্যাসের ঝাঁজ এসে লাগে সুমনের চোখে। সে রুমাল দিয়ে চোখ মোছে আর দৌড়াতে থাকে। দৌড়াতে দৌড়াতে একপর্যায়ে সে পুলিশের মুখোমুখি হয়। ব্যস, পুলিশ যেন শিকার পেয়ে গেছে। শুরু হয় পিটুনি। পুলিশের গায়ে ইট মারে, কার এত সাহস! সুমন যতই বলে, সে ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছিল। পুলিশ ততই খেপে ভূত হচ্ছিল। ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশ বলতে লাগল, 'মিথ্যা বলার আর জায়গা পেলে না! ডাণ্ডা মেরে একেবারে ঠাণ্ডা করে দেব!'
হাতকড়া পরিয়ে সুমনকে পুলিশের গাড়িতে তোলা হলো। তারপর তাকে থানায় নেওয়া হলো। মনের দুঃখে সুমন কাঁদছিল। ওকে কাঁদতে দেখে একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানতে চাইলেন, কী হলো, তুমি কাঁদছ কেন?
সুমন কাঁদতে কাঁদতে বলল, স্যার, আমি ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছিলাম। অথচ আমাকে রাস্তায় পেয়ে ধরে নিয়ে এসেছে।
'সত্যি বলছ?'
'জি স্যার, সত্যি বলছি। এই যে দেখেন আমার ইন্টারভিউ কার্ড।'
'এই! ওকে ছেড়ে দাও।'
সুমনকে ছেড়ে দেওয়া হলো। সুমন দৌড়াবে না হাঁটবে বুঝতে পারছিল না। ভয় ও আতঙ্ক তাকে তাড়া করছিল। শেষ পর্যন্ত সে জোরে এক দৌড় দিল!
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.