অর্থনীতি-সম্পদশালী বাংলাদেশ by আবু এন. এম. ওয়াহিদ

বছর দুয়েক আগে আমার বস টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটির বিজনেস স্কুলের ডিন ড. টিলডেন কারি একদিন আমার কাছে জানতে চাইলেন বাংলাদেশের লোকসংখ্যা কত। আমি বললাম ১৬০ মিলিয়ন, অর্থাৎ ১৬ কোটি। একটু অবাক হয়ে তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, সে দেশের আয়তন কত? আমি বললাম ৫৫ হাজার ৬শ' বর্গমাইল বা ১ লাখ ৪৪ হাজার
বর্গকিলোমিটার। সঙ্গে সঙ্গে ডিন কারি টেনেসির সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করলেন। পাঠক-পাঠিকাদের সুবিধার জন্য বলছি, টেনেসি অঙ্গরাজ্যের আয়তন বাংলাদেশ থেকে একটু ছোট_ ৪১ হাজার ২২০ বর্গমাইল এবং এর লোকসংখ্যা মাত্র ৬৩ লাখ ৫০ হাজার। সাধারণত বাংলাদেশের আয়তন এবং জনসংখ্যার কথা শুনলে বিদেশিরা আঁতকে ওঠে এবং করুণা করে ভাবে, এত অল্প জায়গায় এত লোক! না জানি কী কষ্টে গাদাগাদি করে খেয়ে না খেয়ে জীবন যাপন করছে! কেউ কেউ আবার তাদের মনের ভাব অকপটে প্রকাশও করে ফেলে। তারা এ পরিসংখ্যানকে নেতিবাচকভাবে দেখে এবং বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষকে হেয় করে, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। কিন্তু সেদিন আমার ডিন সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। তিনি বললেন, 'দেন ইওর কান্ট্রি মাস্ট বি ভেরি রিসোর্সফুল।' অর্থাৎ 'তা হলে তোমাদের দেশ নিশ্চয়ই খুব সম্পদশালী।' 'ইয়েস ইনডিড' বলে আলোচনায় ইতি টেনে আমি প্রসঙ্গ পাল্টালাম।
ডিন কারি এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকার অনেক দেশ দেখেছেন। কিন্তু বাংলাদেশে তার যাওয়ার কোনো সুযোগ হয়নি। তিনি বাংলাদেশের মানুষ দেখেছেন, বাংলাদেশের কথা শুনেছেন, বিশেষ করে গ্রামীণ ব্যাংক এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কথা, কিন্তু বাংলাদেশি মানুষের আয়-উপার্জন এবং জীবনমান সম্বন্ধে তার খুব একটা স্বচ্ছ ধারণা নেই। তাই তিনি স্বাভাবিকভাবে ভেবেছেন টেনেসি থেকে সামান্য বড় আয়তন বিশিষ্ট একটি দেশে টেনেসির ৩০ গুণ মানুষ যখন খেয়ে-পরে বেঁচে আছে, তা হলে নিশ্চয়ই সে দেশ সম্পদশালী না হয়ে পারে না। আজকে লিখতে বসে যখন ডিন কারির কথা মনে পড়ল, তখন আমিও তার মতো করেই ভাবতে লাগলাম এবং বাংলাদেশের দুটি সম্পদ শনাক্ত করলাম_ দেশের মাটি এবং তার পানি।
আমার মতে, বাংলাদেশের মাটি তার একটি অন্যতম মূল্যবান সম্পদ। এ দেশের মাটি মাটি নয়, বরং সোনা এবং এক অর্থে নয়; বরং দুই অর্থে। প্রথমত হাতেগোনা কয়েকটি ছোট দেশ, যেমন ম্যাকাউ, সিঙ্গাপুর, জিব্রাল্টার, গাজা স্ট্রিপ, বারমুডা, মাল্টা, মালদ্বীপ, বাহরাইন বাদ দিলে বাংলাদেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি। এখানে প্রতি বর্গমাইলে ২ হাজার ৮৫০ জন লোকের বাস। মোট জমির মাত্র ৫৫.৩৯ শতাংশ আবাদি। অবশিষ্ট অনাবাদি। তার মধ্যে আবার নদী ভাঙন এবং বাড়িঘর ও অন্যান্য স্থাপনা তৈরিতে প্রতি বছর নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ১ শতাংশ করে। এ অবস্থাও অস্বাভাবিক। বাংলাদেশ ১৬ কোটি মানুষের জন্য মোটামুটি পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন করতে সক্ষম। এর কারণ বাংলাদেশের ভূমি খুব উর্বর এবং এখানকার জলবায়ু কৃষির জন্য খুব উপযোগী। ফসলের জন্য সময়মতো যথেষ্ট পরিমাণে বৃষ্টি হয়। তার ওপর বাংলাদেশের কৃষকরা কাজে যেমন আন্তরিক, তেমনি পরিশ্রমী। বাংলাদেশের জনসংখ্যা এ অবধি স্থিতিতে পেঁৗছায়নি। প্রতি বছর এখনও বাড়ছে ১.৫৭ শতাংশ হারে। যেহেতু জমির পরিমাণ কম, তাই বাংলাদেশের প্রতি বর্গইঞ্চি জমি যত্ন সহকারে রক্ষা করতে হবে। নদী ভাঙন থেকে বাংলাদেশের মাটি ও জমি বাঁচাতে হবে। এজন্য দাতা দেশ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ইসলামী ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ইত্যাদির সঙ্গে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প প্রস্তাব নিয়ে অবিলম্বে সিরিয়াস আলোচনা শুরু করা উচিত। এতে ব্র্যাকসহ বড় বড় এনজিওকেও সম্পৃক্ত করার কথা ভাবতে হবে। প্রযুক্তিগত সহযোগিতার জন্য চীন, রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস ও জার্মানির মতো দেশগুলোর সঙ্গে সরকারের তরফ থেকে শিগগির কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করা দরকার। বাংলাদেশের মাটিতে সোনা ফলে, সোনার ফসল ফলে। সেই হিসেবে এ দেশের মাটি সোনা।
আবার আরেক অর্থেও বাংলাদেশের মাটি সোনা। বাংলাদেশে মানুষ বাড়ছে, মানুষের আয়-উপার্জন বাড়ছে। জমি বাড়ছে না, বরং কমছে। ফলে জমির দাম বাড়ছে হুহু করে। বিশেষ করে শহরে জমি সোনাদানার মতোই দুষ্প্র্রাপ্য। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার আগে ঢাকা ছিল একটি প্রাদেশিক শহর। বর্তমানে এটা একটি স্বাধীন দেশের রাজধানী। এটি পৃথিবীর জনবহুল নগরগুলোর অন্যতম। ঢাকা শহরে জমির দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে পৃথিবীর যে কোনো আধুনিক বড় শহরের মতোই। ১৯৭৫ সালে ঢাকা শহরে যেখানে ১ কাঠা জমির দাম ছিল ২০-২৫ হাজার টাকা, এখন ঢাকার কোনো কোনো অঞ্চলে একই পরিমাণ জমি বিক্রি হচ্ছে ৬-৭ কোটি টাকায় কিংবা তার চেয়েও বেশি দামে। এ অর্থেও বাংলাদেশের মাটি সোনা।
সম্পদের বিবেচনায় তার পরে আসে পানি। আসলে বাংলাদেশের মাটি এবং পানি দুটিই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কোনটা আগে আর কোনটা পরে বলা মুশকিল। কারণ ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ একটি ব-দ্বীপ বা ডেল্টা। পানিবিধৌত উজানের পলিমাটি দ্বারাই বঙ্গভূমির সৃষ্টি। অত্যন্ত সাদামাটাভাবে বাংলাদেশ সব সময়ই পানি নিয়ে দু'ধরনের বিড়ম্বনায় পড়ে।
প্রথমত শুকনো মৌসুমে খাল, বিল, পুকুর, হ্রদ, হাওর, বাঁওড় সব শুকিয়ে যায়। নদীতে পানির প্রবাহ কমে যায়। ব্রহ্মপুত্র বাদে বাংলাদেশের ৫৪টি নদীর উৎসমুখ ভারতে। ইদানীং ভারত প্রায় প্রতিটি নদীতে সেচ ও বিদ্যুৎ প্রকল্পের নামে বাঁধ দিয়েছে। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে সব নদী থেকে তারা শীতকালে তাদের প্রয়োজনমতো পানি প্রত্যাহার করে নেয়। এ ব্যাপারে ভাটির দেশ হিসেবে আমাদের প্রয়োজন এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি ভারতের যতটা শ্রদ্ধাশীল ও সংবেদনশীল হওয়ার কথা ততটা নয়। ছোট দেশ, ছোট অর্থনীতি, দুর্বল সরকার, জাতীয় স্বার্থে বিভক্ত রাজনীতি, অদক্ষ কূটনীতি, অযোগ্য এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্র নিয়ে এ ব্যাপারে বাংলাদেশ বিশেষভাবে বেকায়দায় রয়েছে। এসব দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে ভারতের কাছ থেকে শুকনো মৌসুমে পানির ন্যায্য হিস্যা যে করেই হোক বাংলাদেশকে আনতে হবে। পানির আরেক নাম জীবন। বাংলাদেশের মানুষ, গাছপালা ও জীববৈচিত্র্যকে বাঁচাতে হলে শীতকালে প্রয়োজনীয় পানির নিশ্চয়তা আদায় করা ছাড়া বাংলাদেশের কোনো উপায় নেই।
দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের কাছে উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত আসামের চেরাপুঞ্জিতে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। বাংলাদেশেও প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানিতে খাল, বিল, পুকুর, হ্রদ, হাওর, বাঁওড়_ সব পানিতে ভরে টইটম্বুর হয়। শীতকালে ভারত নদীগুলোর বাঁধ থেকে পানি প্রত্যাহার করলেও গ্রীষ্মকালে সব বাঁধের স্লুইস গেট খুলে দেয়। ফলে বাংলাদেশে যে পরিমাণ পানির ঢল নামে তা এ দেশের নদীনালা বিপদসীমার নিচে দিয়ে টেনে নিয়ে সাগরে ফেলতে পারে না। পানি ফুলে-ফেঁপে উঠে বন্যার সৃষ্টি করে। মানুষের ঘরবাড়ি ও ফসলের প্রচুর ক্ষতি করে। এ বন্যাকে সামাল দিতে হলে বাংলাদেশের ভূপৃষ্ঠে পানির ধারণক্ষমতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়াতে হবে। এজন্য দেশের সব খাল, বিল, পুকুর, হ্রদ, হাওর, বাঁওড় একযোগে খনন করা শুরু করা দরকার। এ খনন কাজে ড্রেজার মেশিন ও অন্যান্য উন্নত প্রযুক্তির সাহায্য নিতে হবে। আবার শুধু এসব প্রযুক্তির ওপর ভরসা করে বসে থাকলেও চলবে না। অল্প অল্প করে দেশীয় সম্পদ ও দেশীয় প্রযুক্তির সাহায্যে খনন কাজে লেগে যাওয়া উচিত। রাজনৈতিকভাবে সাধারণ মানুষকে উদ্দীপিত করে লাখ লাখ টুকরি আর কোদাল নিয়ে সবাইকে একযোগে নেমে পড়তে হবে। সদিচ্ছা, সাহস, প্রত্যয় আর লক্ষ্য যদি সঠিক হয়, তবে এ কাজে ব্যর্থ হওয়ার কোনো অবকাশ নেই।
চীন যদি হাজার বছর ধরে নিজস্ব শ্রম ও সম্পদ ব্যবহার করে গ্রেট ওয়াল তুলতে পারে, তবে বাংলাদেশের দৃঢ়প্রত্যয়ী ১৬ কোটি মানুষ কেন তার নদীনালা, খালবিল খনন করতে পারবে না! যত দিন লাগে লাগুক। কাজ শুরু করে দেওয়া উচিত। যে জাতি খালি পায়ে, খালি গায়ে, লুঙ্গি কাছা মেরে আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে হারিয়ে স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনতে পারে, সে জাতি কেন এ কাজ করতে পারবে না, আমার মাথায় আসে না।


আবু এন. এম. ওয়াহিদ : অধ্যাপক টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি; এডিটর জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ
awahid@tnstate.edu

No comments

Powered by Blogger.