সাদাকালো-সংবিধান সংশোধন নিয়ে টানাপড়েন by আহমদ রফিক

গত শতকের পঞ্চাশের দশক অর্থাৎ বায়ান্ন থেকে যার সূচনা, পরবর্তী এক দশক ধরে সে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জনের আন্দোলন-লড়াইয়ের চরিত্র অর্জন করেছিল। তাতে ছিল ছাত্র-শিক্ষক-পেশাজীবী থেকে শুরু করে ক্রমে সাধারণ মানুষের সংশ্লিষ্টতা। রাজনীতিকরা সেখানে যদিও মূল গায়েন_কখনো এগিয়ে কখনো পিছিয়ে।


কিন্তু রাজপথের মানুষ-ছাত্র-অছাত্ররা মিলে শেষোক্তদের ভুল পথে হাঁটতে দেয়নি। যে জন্য ঊনসত্তর-একাত্তরের লড়াই সফল হতে পেরেছিল।
এসব আন্দোলনের চরিত্র বিচার করতে গেলে দেখা যায়, প্রতিটিরই মূল আদর্শ বা লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা ও রাজনৈতিক সচেতনতার পথ ধরে অর্জিত সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধ। নেপথ্যে ভাষিক জাতীয়তা তথা বাঙালি জাতীয়তার সেক্যুলার চেতনা যা আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্ববোধের বিরোধী নয়। এমন এক বোধের কারণে উগ্র ধর্মীয় রক্ষণশীলতার অনুসারী কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক বিশেষ গোষ্ঠীর বাইরে গোটা বাঙালি জাতি পাকিস্তানি সামরিক হামলার বিরুদ্ধে একাট্টা হতে পেরেছিল। আর সে কারণে রণাঙ্গনে বিজয়ও সম্ভব হয়েছিল।
ওই যাত্রায় সংস্কৃতি-রাজনীতি হাত ধরাধরি চলেছে। স্বদেশি সংগীত থেকে গণসংগীত একাত্ম হয়ে রাজনীতির যাত্রায় সাহস ও শক্তি জুগিয়েছে, রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা প্রগতি চেতনায় স্নাত হয়েছে। মত ও পথের কিছু ভিন্নতা সত্ত্বেও মূল লক্ষ্য অর্জনে ভিন্নতা ছিল না। সেখানে জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিবাদী, গণতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রী এক কাতারে দাঁড়ানো। সম্ভবত সেই ঐক্য চেতনার ফসল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান, যা পতাকার লাল-সবুজের তাৎপর্যে প্রতিফলিত এবং জাতীয় সংগীতের স্বদেশ-বন্দনায় ঐতিহ্যনির্ভর।
আদর্শগত বিচারে সামান্য স্ববিরোধিতা সত্ত্বেও প্রথম সংবিধানের মূলস্তম্ভ গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বাঙালিয়ানার তাৎক্ষণিক আবেগ ও আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পেরেছিল। এ কথা সত্য, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুরো এক বছরের অহিংস ও সশস্ত্র লড়াইয়ে যুদ্ধের চেয়ে আবেগ সংগত কারণে বড় হয়ে উঠে আমাদের ভাসিয়ে নিয়েছিল। সংবিধান রচনায় সম্ভবত সে আবেগের প্রতিফলন বা প্রকাশ ঘটেছিল। চার মূলস্তম্ভে তা পরিস্ফুট। পরিস্ফুট গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সহাবস্থানে।
তবে আমার বিশ্বাস, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি না থাকলেও সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা তথা সেক্যুলার চরিত্র ক্ষুণ্ন হতো না। গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সংবিধানে ধর্মীয় চেতনার আধিপত্য থাকতে পারে না, প্রকৃত অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিফলনই সেখানে স্বাভাবিক। তাতে সুবিধা ছিল একটাই_পরবর্তী সময়ে উদ্দেশ্যবাদী মহলের অপপ্রচার যে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মহীনতা হালে পানি পেত না। সংবিধান রচয়িতাদের মনে রাখা দরকার ছিল, ধর্মের নামে মানুষকে সহজে বিভ্রান্ত করা যায় এবং সে বিভ্রান্তি প্রায়ই হিংসাশ্রয়ী হয়ে ওঠে। চলি্লশের দশকের শেষার্ধে আমাদের তা রক্তের স্রোতে বুঝিয়ে দিয়েছিল। তা থেকে আমাদের শিক্ষা হয়নি। এ লেখায় ভুল বোঝার সম্ভাবনা মাথায় রেখেই বলতে চাই 'ধর্মনিরপেক্ষতা' শব্দটি প্রত্যক্ষভাবে সংবিধানে ব্যবহার না করেও অন্য ভাষায় ওই প্রয়োজন মিটিয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু যা ঘটে গেছে তা নিয়ে বিতর্ক না তুলে প্রায় চার দশকের রাজনৈতিক টালমাটাল ও টানাপড়েনের ঝড়বাদল পার হয়ে একুশ শতকের আধুনিকতায় পেঁৗছে আমার মনে হয়, স্বাধীনতাযুদ্ধের চারিত্রিক ফসল বাহাত্তরের সংবিধান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মূল আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এটাই বহাল থাকা উচিত।
কারণ ওই সংবিধান যেমন ব্যক্তি ও সমষ্টির জন্য গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষা করবে, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতার রক্ষাকবচ হবে, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার সামাজিক-সাংস্কৃতিক সম-অধিকার নিশ্চিত করবে, তেমনি ভবিষ্যতে শ্রেণীবৈষম্য কমিয়ে আনার আদর্শ বাস্তবায়নে সহায়ক হবে। সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বী সেখানে নিজেকে বঞ্চিত মনে করবে না, অসহায় বোধ করবে না। কিন্তু গণতন্ত্রের কথা যত ফলাও করে সংবিধানে লেখা হোক, সেখানে 'বিসমিল্লাহ' বা 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম'-এর উপস্থিতি গণতন্ত্রের বিপরীত আদর্শ বা চরিত্রের প্রতিফলন ঘটাবে, সংবিধানটিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মবিশ্বাসী জনগোষ্ঠীর সংবিধানে পরিণত করবে। এমনকি রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের অন্তর্ভুক্তি এমন ভুল ধারণার সুযোগ তৈরি করবে যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ আসলে একটি ইসলামী রাষ্ট্র। বিদেশে এমন কথা অনেক শোনা গেছে।
তা ছাড়া ওই দুটি বিষয় সংযোজনের ফলে বাংলাদেশে অমুসলিম সম্প্রদায় (হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান) আদর্শগতভাবে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হতে বাধ্য, যতই রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে কোরআন, গীতা, ত্রিপিটক ও বাইবেল থেকে পাঠ করা হোক না কেন। বাস্তবে তো দেখা যায়, দল নির্বিশেষে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, এমনকি প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও আনুষ্ঠানিক বক্তব্য শুরু করেন 'বিসমিল্লাহ'র পুরো বাক্যটি পাঠ করে। সে ক্ষেত্রে অন্য ধর্মগ্রন্থের কোনো সদবাক্য পাঠ করা হয় না। তাহলে বহু ধর্মভিত্তিক গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে গণতন্ত্রের মূলনীতি রক্ষা পেল কোথায়?
সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তনের প্রথম কারিগর রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সরকার ও দলের পক্ষে এমন ফাঁপা যুক্তি দেখানো হয়েছিল যে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী ধর্মবিশ্বাসে মুসলমান, তাই তাদের ধর্মীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে এই পরিবর্তন। এ যুক্তি একেবারেই ধোপে টেকে না। যেখানে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান, মন্ত্রিসভা তথা শাসকদের প্রায় সবাই মুসলমান, এমনকি প্রশাসনে, আমলাতন্ত্রেও একই বিষয় সত্য, সে ক্ষেত্রে মুসলমানের ধর্মীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়ার কোনো অবকাশই নেই। ঘটনাও তাই বলে।
বরং আশঙ্কা থাকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বা সম্প্রদায়গত স্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়ার, যা সেক্যুলার সংবিধান সত্ত্বেও সামাজিক ক্ষেত্রে কখনো কখনো ঘটে থাকে, যেমন বাংলাদেশে, তেমনি সেক্যুলার সংবিধানের ভারতে। এটা উপমহাদেশের বাস্তবতা এবং বিভাগ পূর্বকালীন সাম্প্রদায়িক চেতনা তিন রাষ্ট্রই বহন করে চলেছে। তাই সংবিধানে, প্রশাসনিক বা সামাজিক ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকারগত রক্ষাকবচই বরং জোরদার করা দরকার, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের নয়। তাতেই গণতন্ত্র রক্ষা পাবে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রাষ্ট্রে ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ ঘটবে।
এ সহজ সত্যটা কেন আমরা বুঝি না, আসলে বুঝেও মানতে চাই না। সালিস মানি কিন্তু তালগাছের অধিকার ছাড়ি না। এ জন্যই আধুনিকতার চেতনা ও মূল্যবোধ, গণতন্ত্রের মৌল সত্য রাষ্ট্রিক, সামাজিক ও ব্যক্তিক জীবনে প্রতিফলিত করতে চাইলে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল দলিল সংবিধানে তেমন প্রতিফলন ঘটাতেই হবে। সমাজজীবনে, ব্যক্তিজীবনে তার চর্চা তো পরের কথা। ভাবতে অবাক লাগে, অগণতান্ত্রিক (অমানবিকও বটে) পরিবর্তনগুলো যখন সংবিধানে ঘটানো হয়, তখন গণতন্ত্রী রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ বা প্রগতিবাদী কোনো সংগঠন থেকে কার্যকর প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়নি, আন্দোলন গড়ে তোলা তো দূরের কথা। তেমন সাহস কারো হয়নি।
তাহলে কি ভাবতে হবে যে আমাদের শিক্ষিত, আধুনিক এলিট শ্রেণী, কথিত সুশীল সমাজ নামেই গণতন্ত্রী বা প্রগতিবাদী, বাস্তবে নয়? তাদের গণতান্ত্রিক আধুনিকতার চেতনায় অনেক ফাঁকি রয়ে গেছে? বহুজাতিক, বহুভাষিক ও বহুধর্মীয় রাষ্ট্রে প্রায়ই সংখ্যাগরিষ্ঠকে নিয়ে যে একদেশদর্শিতার প্রকাশ ঘটে, বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। বরং সে একটু বেশি মাত্রায় ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠের পাতে ঝোল টানার পক্ষপাতী। আরো নির্মম সত্য যে ওই ঝোলমাছ মমধর্মী নিম্নবর্গীয়দের ভাগ্যেও জোটে না, সেসব সুযোগ-সুবিধা ভুক্তভোগী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, বিত্তবান ও ব্যবসায়ী-শিল্পপতি শ্রেণীর জন্যই বরাদ্দ থাকে। বর্তমানে সংবিধান পরিবর্তন নিয়ে তার ধারা-উপধারা নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, সে ক্ষেত্রে উলি্লখিত বক্তব্যের যৌক্তিকতা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যুক্তিগ্রাহ্য ভাবনায় রাখতে অনুরোধ জানাই। আমরা গণতন্ত্রের স্বার্থে, সুষ্ঠু মানবাধিকারের স্বার্থে বর্তমান বাংলাদেশের জন্য পূর্ণাঙ্গ প্রথম সংবিধানে ফিরে যেতে চাই। তবে সেখানে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব ও অধিকার সংরক্ষণও চাই, যা বাহাত্তরের আবেগে উপেক্ষিত হয়েছিল, যতদূর জানি স্বেচ্ছায় নয়, ভুলক্রমে আবেগের টানে।
আর সে সংবিধানে বিভ্রান্তি এড়াতে 'ধর্মনিরপেক্ষতা'র তাৎপর্য অন্য বাক্যবন্ধে প্রতিফলিত করা যেতে পারে। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মীয় অনুষঙ্গ সংবিধানে রাখা এবং বাস্তবে তার ব্যবহার যে গণতন্ত্রের পরিপন্থী তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। জানি না, দেশের অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রী বা প্রগতিবাদী দলগুলো কেন প্রতিবাদে সোচ্চার হচ্ছে না?
সংবিধানের পরিবর্তন ও সংশোধন নিয়ে বিতর্ক ও প্রশ্ন যখন তত্ত্বগতভাবে উঠে এসেছে তখন গণতন্ত্রী ও প্রগতিবাদী রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর এ সুযোগে একাট্টা হওয়া অতি জরুরি, বিশেষ করে দক্ষিণপন্থী ও ধর্মীয় রক্ষণশীল শক্তিগুলোকে গণতান্ত্রিকভাবেই মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে। সংবিধান নিয়ে গত কয়েক দশকে আমরা অগণতান্ত্রিকতাকে প্রশ্রয় দিয়েছি, ধর্মীয় রক্ষণশীলতাকে মেনে নিয়ে অন্যের ধর্মীয় অধিকার ক্ষুণ্ন করেছি। এবার সে ভুলের অবসান ঘটাতে হবে।
শেষ মুহূর্তে হলেও দেখে স্বস্তিবোধ করছি যে মহাজোটের কয়েকটি শরিক দল জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দল, ন্যাপ ও গণতন্ত্রী পার্টি সংবিধান সংশোধনের প্রশ্নে ভিন্নমত প্রকাশ করে সংসদীয় কমিটিতে চিঠি দিয়েছে। তারা সংবিধানের প্রস্তাবনায় বিসমিল্লাহ সংযোজন, রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিধান রাখা এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের অধিকার প্রদানের বিরোধী। তাদের মতে এসবই সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থী (কালের কণ্ঠ, ২৫ মে, ২০১১)।
তাদের বক্তব্য, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সংবিধানের চার মূলনীতি পুনর্বহাল হয়েছে। এর বিপরীত কোনো প্রস্তাব সংবিধানের মৌল ভিত্তিকে ক্ষুণ্ন করবে। এটা নিঃসন্দেহে শুভ পদক্ষেপ, তবে কতটা দাগ কাটবে জানি না। প্রসঙ্গত বলি, যতদূর জানি মহাজোট-বহির্ভূত বামপন্থী দলগুলো, যেমন সিপিবি বাহাত্তরের গণতান্ত্রিক সংবিধান পুনর্বহাল চায়। তবে মহাজোটের প্রধান দলটির আশঙ্কা_'বিসমিল্লাহ' ও 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' সংবিধান থেকে বাদ দেওয়া হলে এর প্রভাব পড়তে পারে তাদের ভোটের বাঙ্।ে কারণ বিএনপি ও জামায়াত এ সুযোগ ছাড়বে না, বিভ্রান্তিকর প্রচারে লেগে যাবে।
আমরা জানি, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক দীর্ঘকাল থেকে তৃণমূল স্তরে বিস্তৃত। সেভাবেই তাদের ভোটব্যাংক। তাই তাদের তৃণমূল কর্মী এবং কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের নেতারা যদি সংবিধান সংশোধন জনসাধারণের কাছে সঠিক ভাষ্যে তুলে ধরার শ্রমটুকু স্বীকার করেন, তাহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা নেই। জনসাধারণের বাস্তববোধ যথেষ্ট, ধর্মনিষ্ঠ হলেও অন্ধ বিভ্রান্তিকর বক্তব্য তারা বড় একটা গ্রহণ করে না।
বরং সরকারের কাছে তারা চায় প্রাত্যহিক সমস্যার সমাধান, বিশেষ করে সহনীয় পর্যায়ের দ্রব্যমূল্য এবং অন্যান্য বিষয়। সেসব বিষয়ে সরকারের আন্তরিকতাই তাদের কাম্য। সেখানে সম্পর্কটা ঠিক থাকলে সংবিধান পরিবর্তন নিয়ে তারা মাথা ঘামাবে না, বিরোধী দলের বিভ্রান্তকর প্রচারণা আস্থায় নেবে না। তাই সাধারণ মানুষের স্বার্থে দরকার সরকার তরফে আন্তরিকতা ও কিছু সদর্থক পদক্ষেপ। সেখানে রয়েছে সরকারেরও স্বার্থ।
সংবিধান সংশোধনের প্রশ্নে বড় একটি তাৎক্ষণিক কাঁটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে। এর প্রধান কারণ, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সহিষ্ণু গণতন্ত্রের চর্চা ও পরস্পরের প্রতি আস্থার বড় অভাব, বিশ্বাসের অভাব। যুক্তিসংগত বিষয়েও 'না' বলাটা বিরোধী দলের রাজনৈতিক অভ্যাসে পরিণত। রাজনীতি বেশ কিছুদিন থেকেই সংঘাতের ঐতিহ্য তৈরি করে চলেছে। এটা জাতির জন্য শুভ নয়। এসব বিবেচনা থেকেই বোধ হয় সম্প্রতি দেশের সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েও এখন থেকে পরবর্তী দুইবারের জন্য ওই ব্যবস্থা বহাল রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু তাতেও সমস্যার শেষ নেই। ইতিমধ্যেই বিরোধী দলের ঘোষণা, 'তারা বর্তমান বিদায়ী প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে মেনে নেবে না। ব্যস, এরপর শুরু হবে ঘাত-প্রতিঘাত, রাজপথ রণাঙ্গন হয়ে উঠবে, যেমনটা আগে দেখা গেছে।
মনে হয়, এ জন্যই তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে নতুন প্রস্তাবে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি বিদায়ী সরকারপ্রধান ও বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে আলোচনা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করবেন। আপাতদৃষ্টিতে বেশ নিরীহ প্রস্তাব, ভালো প্রস্তাব। কিন্তু সদিচ্ছা না থাকলে এতেও কাঁটা বের করা যাবে। কারণ আমাদের রাজনীতি 'জি-হ্যাঁ' বনাম 'জি-না'র সংঘাতে বড় বেশি অভ্যস্ত। আমাদের তাই অনুরোধ, দয়া করে সমঝোতার পথে সহিষ্ণু হোন, তাতে উভয়েরই মঙ্গল। এবং আমাদেরও।
৩০ মে ২০১১
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক

No comments

Powered by Blogger.