রোহিঙ্গা : গোদের ওপর বিষফোড়া by জাফর আলম

বর্তমান ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার বিশ্বের দীর্ঘতম সৈকত কঙ্বাজারের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে ব্যাপক মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তার মধ্যে কঙ্বাজার সমুদ্র সৈকতকে বিশ্বমানে উন্নত করা, কঙ্বাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সৈকত রোড মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ, বিশেষ পর্যটন জোন গড়ে তোলা, সোনাদিয়ায় সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, আন্তর্জাতিক রেলপথে সংযোগের জন্য দোহাজারী থেকে গুমধুম পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণ উল্লেখযোগ্য।


কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অবৈধ রোহিঙ্গা অভিবাসী সমস্যা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত দেখা যায়। কারণ কঙ্বাজারের সমাজজীবন থেকে শুরু করে এমন কোনো পর্যায় নেই, যেখানে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করেনি, আর সৃষ্টি করেছে নানা অরাজকতা, রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা। ফলে কঙ্বাজার জেলার ১৮ লাখ অধিবাসী রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে দারুণভাবে উদ্বিগ্ন।
বাংলাদেশের রয়েছে নানা সমস্যা, তদুপরি পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। কঙ্বাজার জেলায় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ এবং নানা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে টেকনাফ, উখিয়া, বান্দরবান এমনকি জেলা শহরের আশপাশের পাহাড়েও বসতি স্থাপন ও পুনর্বাসন 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের' মতো অবস্থা। এ প্রসঙ্গে কিছু তথ্য-উপাত্ত আমি তুলে ধরছি। প্রথম দফায় ১৯৭৮ সালের পরিসংখ্যান মোতাবেক অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা ছিল প্রায় তিন লাখ। দ্বিতীয় দফায় ১৯৯১-৯২ সালে প্রায় দুই লাখ ৬০ হাজার।
কঙ্বাজার বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা। মাছ ও লবণ উৎপাদন করে এ জেলা বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করে এবং সারা দেশের লবণ চাহিদা মেটায়। অন্যদিকে মাছ রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। পর্যটন শিল্পে কঙ্বাজার জাতীয় অর্থনীতিতে যে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে, তা সবারই জানা। অথচ এমন একটি সম্ভাবনাময় জেলাকে একমাত্র রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের অভাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ধ্বংসের পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে; কিন্তু কেউ দেখার নেই।
রোহিঙ্গাদের বাড়তি চাপে স্থানীয় অধিবাসীদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। ফলে জিনিসপত্রের দামও বেড়ে গেছে। রোহিঙ্গারা একদিকে দাতা সংস্থাগুলোর রেশন পায়; অন্যদিকে বাসাবাড়িতে কাজ করে বাড়তি উপার্জন করে। ফলে স্থানীয় দিনমজুর শ্রেণীর লোকজন কর্মহীন হয়ে পড়ছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সরকারের সমন্বয়হীনতার অভাব রয়েছে। এনজিও ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলো সরকারের তোয়াক্কা না করে নিজেদের মতো কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
১৯৯৫ সাল থেকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো শুরু হয়। ২০০৫ সাল পর্যন্ত আড়াই লাখ রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হয়। কিন্তু গত পাঁচ-ছয় বছরে তাদের অধিকাংশ আবার বাংলাদেশের কঙ্বাজারে ফেরত এসেছে। কিন্তু সরকার এদের কোনো নিবন্ধন করেনি, ফলে তারা এখন অবৈধ।
স্থানীয়দের অভিযোগ, রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির দেখাশোনার জন্য কোনো সরকারি সংস্থা নেই। এখানে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য তালিকা তৈরির কাজ ইউএনএইচসিআর, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, মন্ত্রিপরিষদ, খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং আইন মন্ত্রণালয়ের একত্রিত হয়ে যৌথভাবে করার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। এখন ইউএনএইচসিআর এককভাবে রোহিঙ্গাদের নিবন্ধের কাজ করছে। নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা মাত্র ২৪ হাজার। কিন্তু বাস্তবে এদের সংখ্যা চার লাখ ছাড়িয়ে গেছে_এ কথা আগেই উল্লেখ করেছি। মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র, তাদের সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ ও সুসম্পর্ক রয়েছে। চীন আবার মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ মিত্র। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কূটনৈতিক পর্যায়ে প্রচেষ্টা চালিয়ে আমরা মিয়ানমারকে রাজি করানোর জন্য চীনের সাহায্য নিতে পারি। আমার ধারণা, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো দরকার।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ-মিয়ানমারের ১৩৯ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে ১৩টি পয়েন্টে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। মিয়ানমার সরকার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ায় বর্ডার গার্ড অবৈধ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পুশব্যাকও করতে পারছে না।
সম্প্রতি ঢাকার আরেকটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে 'সশস্ত্র রোহিঙ্গা জঙ্গিরা আবার সংগঠিত হচ্ছে, পাহাড়ে অস্ত্র মজুদ, ছাত্রসংগঠন করে সদস্য সংগ্রহ করছে।' অবশ্যই এ রিপোর্ট পাঠের পর কঙ্বাজারবাসী হিসেবে আমাদের আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ওই রিপোর্টে রোহিঙ্গা সশস্ত্র জঙ্গিদের সঙ্গে পাকিস্তানের জঙ্গিদের যোগাযোগ রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিজ্ঞ মহলের মতে, এ জন্য কঙ্বাজার ও নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকার রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও মাদ্রাসাগুলোতে নজরদারি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। কারণ ছাত্রসংগঠন করে মাদ্রাসা থেকে সদস্য সংগ্রহ করা অস্বাভাবিক নয়। অবৈধ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধে জরুরি ভিত্তিতে প্রতিরোধ এবং অবৈধ রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে মিয়ানমারের সঙ্গে অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারের দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শুরু করা প্রয়োজন। সরকার, বিশেষত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার সবিনয় অনুরোধ জানাচ্ছি। কারণ প্রবাদ আছে, 'সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়।'
লেখক : অনুবাদক ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.