দুর্নীতি-ব্যর্থতার দায় মন্ত্রীদেরই নিতে হয় by নির্মল সেন

শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে যারা মন্ত্রীদের অযোগ্যতা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চেয়ে যারা সমাবেশ ও মিটিং-মিছিল করেছেন, তাদের দেশাত্মবোধ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী তিনি দেশের সেরা দেশাত্মবোধসম্পন্ন মানুষ হবেন এটাই স্বাভাবিক, মানুষ প্রত্যাশাও করে তাই।
আমি জানি না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেন তাদের উদ্দেশে এ কথা বলেছেন। আমি এখন আমার গ্রামের বাড়ি কোটালীপাড়া থাকি। গত ১৩ সেপ্টেম্বর কোটালীপাড়া শহীদ মিনারে অবস্থান ধর্মঘট করেছিলাম। সেখানে আমি একটি লিখিত বক্তব্য দিয়েছিলাম, যাতে আমি কোনো মন্ত্রীকে দুর্নীতিবাজ বলিনি। আমি সারাদেশের সড়ক ব্যবস্থার দুরবস্থার কথা বলেছিলাম। আমি নিরাপদ জীবন চেয়েছিলাম। নিরাপদ সড়ক চেয়েছিলাম। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চেয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম, 'নো রোড_ নো ভোট'। আমি দেশবাসীকে আহ্বান করেছিলাম রাস্তাঘাটের উন্নয়ন না হলে আপনারা কাউকে ভোট দেবেন না। এই 'নো রোড_ নো ভোট' আমার পুরনো একটি স্লোগান। রাস্তাঘাটের বেহাল দশার কারণে ৪ বছর আগেও কোটালীপাড়ায় আমি একটি অবস্থান ধর্মঘট করেছিলাম। সে ধর্মঘট থেকে আমি ঘোষণা দিয়েছিলাম_ 'নো রোড_ নো ভোট'। রাস্তাঘাটের সে বেহাল দশা আজও আছে। শুধু কোটালীপাড়া নয়, সারাদেশের রাস্তাঘাটের একই অবস্থা। তাই আমি গত ১৩ সেপ্টেম্বরের অবস্থান ধর্মঘট থেকে যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়েছিলাম।
আমি কোটালীপাড়ার অধিবাসী। বহুদিন ধরে লিখছি। কোটালীপাড়া একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। ঢাকা থেকে মাওয়া দিয়ে রাজৈর হয়ে আমাকে কোটালীপাড়ায় আসতে হয়। রাজৈর হয়ে কোটালীপাড়ায় আমার বাড়িতে আসা মুশকিল। রাজৈর থেকে কোটালীপাড়ার রাস্তাটি চলাচলের অযোগ্য। অন্য পথও আছে। মাওয়া-ভাঙ্গা-ভাটিয়াপাড়া হয়ে গোপালগঞ্জ দিয়ে কোটালীপাড়া আসা যায়। কিন্তু সেখানেও সমস্যা। গোপালগঞ্জ থেকে কোটালীপাড়ার রাস্তার অবস্থা যাচ্ছেতাই। একসঙ্গে ছোট দুটি বাসও পাশ কাটাতে পারে না। অর্থাৎ সে রাস্তাটিও ভালো নয়। ফলে টেকেরহাট থেকে গান্দিয়াশুর-দত্তডাঙ্গা হয়ে কোটালীপাড়া আসতে হয়। বাকি থাকে মাঝবাড়ি-টুঙ্গিপাড়া সড়ক। এই সড়কটির উন্নয়ন কাজ চলছে। তবে ধীরগতিতে। আবার গৌরনদী-কোটালীপাড়া সড়কটি অসম্পূর্ণ। অর্থাৎ কোনো রাস্তা দিয়েই নিশ্চিন্তে নিরাপদে কোটালীপাড়া আসা সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে আমি অনেক লিখেছি কিন্তু কোনো কাজে আসেনি।
আমার অন্য কথাও আছে। এক সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের সততা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন। অন্যদিকে পদ্মা সেতুর ব্যাপারে নির্মাণ কাজে পরামর্শক নিয়োগ নিয়ে কানাডিয়ান একটি কোম্পানির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ইতিমধ্যে যেসব প্রতিষ্ঠানের সততা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে দুদক তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করার ঘোষণা দিয়েছে। দুদক বলেছে, সত্যতা পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে দুর্নীতির যে অভিযোগ উঠেছে তা খতিয়ে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন। এসব কারণে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর জন্য টাকা দেবে কি-না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ফলে অক্টোবর মাসে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হচ্ছে না। অর্থাৎ পদ্মা সেতুর কাজ অনিশ্চিত। আমি কারও দুর্নীতির কথা বলছি না। এর পর আসে শেয়ারবাজারের কথা। প্রতিদিন শেয়ারবাজারে ধস নামছে। বিনিয়োগকারীরা মিছিল করছে। মানববন্ধন করছে। এ ব্যাপারে সরকার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। তারা একটি রিপোর্ট দিয়েছিল। রিপোর্টে অনেকের বিরুদ্ধে কথাবার্তা আছে। তারা সমাজের কেওকেটা। অর্থমন্ত্রী প্রথমে তাদের নাম প্রকাশ করতে চাননি। এখন শোনা যাচ্ছে কারও কারও বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। শেয়ারবাজার ও পদ্মা সেতুর ব্যাপারে এ প্রশ্নগুলো দুর্নীতি কি-না তা আমি বলতে চাই না। তবে শেয়ারবাজার নিয়ে রোজ যে মিছিল ও মানববন্ধন হচ্ছে তা ভালো কথা নয়। পৃথিবীতে দুর্নীতির দায়ে অনেক মন্ত্রী বরখাস্ত হয়েছেন। অনেক মন্ত্রী ব্যর্থতার দায়ে পদত্যাগ করেছেন। সম্প্রতি ভারতের টেলিযোগাযোগমন্ত্রী তার নামে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় পদত্যাগ করেছেন।
আমরা শহীদ মিনারে ব্যর্থ মন্ত্রীদের পদত্যাগ দাবি করেছিলাম। কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ করিনি। শেয়ারবাজার, পদ্মা সেতু বা রাস্তাঘাটের বেহাল দশা যদি কোনো মন্ত্রণালয়ের অধীনে হয়ে থাকে তা হলে সেই ব্যর্থতা ওই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর ওপর বর্তায়। সে সম্পর্কে মন্ত্রীদের কিছু বক্তব্য থাকে। সাধারণ জনগণের কিছু বক্তব্য থাকে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা যদি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন, আমার মনে হয় সেখানে দুর্নীতির কোনো অবকাশ থাকে না।
২০ সেপ্টেম্বর কয়েকটি দৈনিক পত্রিকার খবর হচ্ছে_ 'অব্যাহত দরপতনে শেয়ারবাজার উত্তাল। মতিঝিল অবরুদ্ধ। বিনিয়োগকারীরা অর্থমন্ত্রীর অপসারণ দাবি করছে'। অন্য একটি খবর হচ্ছে_ 'সড়ক ও জনপথের অবহেলায় ফেরত গেল এডিবির দেওয়া ১০০ কোটি টাকা'। এর জন্য কে দায়ী আমি বলতে চাই না। কিছুদিন আগে সংসদে সাংসদ তারানা হালিম বলেছেন, 'সব ব্যাপারে অতীত সরকারের দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমরা নিজেরা কী করেছি তা চিন্তা করা উচিত।' আমি দুর্গত এলাকায় অনেক সাহায্য দেওয়ার কথা শুনেছি। কিন্তু স্থানীয় লোকেরা বেতার, টেলিভিশন ও বিভিন্ন সংবাদপত্রের সাংবাদিকদের সামনে বলেছে, তারা প্রয়োজনীয় সাহায্য পায়নি। এ ছাড়া এবার ঈদের আগে ব্যবসায়ীরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বাড়াবেন না। কিন্তু তারা তাদের সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি।
পোশাক শ্রমিকদের নূ্যনতম মজুরি বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। তাও হয়েছিল আপনার হস্তক্ষেপের ফলে। শ্রমিকরা এবার কিছু পেয়েছে। তাই অনেক মন্ত্রীর মন্ত্রণালয়ের অব্যবস্থা সম্পর্কে লিখলাম। আমি এসব মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করছি না। কারণ ইতিমধ্যে আপনি দলীয় ফোরামে বলেছেন, শুধু মুখে বললেই হবে না, সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ পেলে সেসব মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন, অন্যথায় নয়। এর চেয়ে সুনির্দিষ্ট করে কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতি কিংবা দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ আনার প্রয়োজন আছে কি? এই যদি হয় অবস্থা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সব ক্ষেত্রে যদি আপনার হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয় তাহলে দেশ চলবে কীভাবে?

নির্মল সেন : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.