চা শিল্পের দুরবস্থা দূর করা জরুরি by মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

ছোটকালে বুড়োদের কাছে শুনেছি, ব্রিটিশ যুগে নাকি ইংরেজ সাহেবরা এখানকার মানুষকে বিনা পয়সায় চা খাওয়াতো। তাদের কথা শুনে মনে হতো, ইংরেজরা যেন ঘুরে ঘুরে তা করত। এখন বুঝতে পারছি, বিষয়টি সে রকম কিছু ছিল না। ছিল হয়তো আতিথেয়তার মধ্যে। ওদের কাছে বাঙালি কেউ গেলে চা পান করতে দিত। ঠিক আমাদের এখানে সেই যুগে কেউ কারো বাড়ি গেলে পান-সুপারি যেমনটি খেতে দিত।


এখনো গ্রামে গেলে কেউ কেউ পান-সুপারির অভ্যাস আছে কি না জানতে চায়। তবে এখন গ্রামেও চা-বিস্কুট আপ্যায়নের রীতি চোখে পড়ে।
হ্যাঁ, ব্রিটিশ বা পাকিস্তানকালে এখানকার শহুরে মানুষজন চা-নাশতায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। এটা ক্রমেই বিস্তৃত হতে থাকে। একসময় সকালে পান্তা বা গরম ভাতের প্রচলন ছিল। এখন সকালে নাশতার পর এক কাপ চা না হলে কারো-ই বোধ হয় চলে না। অফিস বা কর্মস্থলে গিয়েও কয়েক কাপ চা পান করেন না, এমন মানুষ খুব কমই আছে। এককালে বাঙালি পরিবারে কেউ এলে পান-সুপারি খাইয়ে বিদায় করার স্থলে এখন প্রায় পুরোটাই চা-চানাচুর-বিস্কুট দখল করেছে। গ্রামেও কারো বাড়িতে গেলে চা খাওয়ার দৃশ্যই চোখে পড়ে। শহরের ঘরে ঘরে চায়ে অভ্যস্ত সব পরিবারই। অসংখ্য চায়ের দোকান ছাড়াও রাস্তার পাশে কেতলিতে চায়ের পানি গরম করে অসংখ্য কর্মজীবী মানুষ বসে আছে, ঘুরে ঘুরে চা বিক্রি করছে। গ্রামেও এখন হাট-বাজারে অসংখ্য চায়ের দোকান হচ্ছে। এগুলো সবার জমজমাট আড্ডার জায়গা হিসেবে পরিচিত হচ্ছে। এমনকি এই পানীয় চা শুধু আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ব্যাপকভাবে সমাদৃত। কোনো কোনো দেশে কফির ব্যবহার হয়তো বেশি। তবে চায়ের কদর পৃথিবীজুড়েই রয়েছে। সেই চা নিয়েই কিছু কথা, বিশেষ করে বাংলাদেশে চা শিল্পের দুরবস্থা নিয়েই আজকের লেখা।
গত ৪ আগস্ট কালের কণ্ঠের শেষ পৃষ্ঠায় 'চা শিল্পের দুই প্রতিষ্ঠানে জনবল সংকট, অনিয়ম' শীর্ষক প্রতিবেদনটি আমার চোখে পড়েছে। প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের চা অঞ্চল হিসেবে খ্যাত শ্রীমঙ্গল থেকে সরেজমিনে দেখে তথ্য-উপাত্তসহ লিখেছেন কালের কণ্ঠের স্থানীয় সাংবাদিক বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন। প্রতিবেদনটি পড়ে আমাদের প্রতিদিনকার প্রিয় চায়ের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছুটা আশঙ্কা বোধ করলাম। জানি, এমন একটি বিষয় নিয়ে লেখার মতো তথ্য-উপাত্ত আমার হাতে নেই। আমি চা শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টও নই। তবু বিশ্বজিৎ বাপনের প্রতিবেদনে যেসব তথ্য উঠে এসেছে, তা পত্রিকায় লেখার জন্য একেবারে কম নয়। আমার বিবেচনায়, বিশ্বজিৎ বাপনের প্রতিবেদনে উপস্থাপিত যে সমস্যাগুলো দেশের চা শিল্পে এখন বিরাজ করছে, সেগুলো গুরুত্ব সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে আনা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। কেননা, আমাদের এখন একটি অতি প্রয়োজনীয় অর্থকরী শিল্পের রুগ্ণ দশা চলতে থাকবে, তা কিভাবে মেনে নেওয়া যায়? দেশের চা শিল্প ধ্বংস হলেও তো আমাদের চা পান করতে হবে। তাহলে কি বিদেশ থেকে চাও কিনে আনতে হবে। চা নিয়েও কি বাজারে দামের ওঠানামা সহ্য করতে হবে। ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে জর্জরিত হতে হবে সাধারণ ভোক্তাদের! অথচ আমাদের দেশে প্রচুর চা পাতা উৎপন্ন হচ্ছে, শিল্প হিসেবে এর অবকাঠামো দাঁড়িয়ে গেছে, হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। আমাদের এই চা পাতাই বিদেশে ব্যাপকভাবে রপ্তানি করা সম্ভব। ইউরোপে শ্রীলঙ্কান এবং ভারতীয় চায়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশের চা শ্রীলঙ্কান এবং ভারতীয় চায়ের থেকে খুব আলাদা কিছু নয়। বাংলাদেশ প্রতিবছর যে কয় টন চা বিদেশে রপ্তানি করছে, তা যেসব দেশের বাজারে পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে ভোক্তারা বাংলাদেশের চা অপছন্দ করে বলে শুনিনি। হ্যাঁ, দার্জিলিংয়ের চায়ের সুবাস আমাদের চায়ে পাওয়া যায় না। কিন্তু তাতে কী? আমাদের চাবিষয়ক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা যদি নতুন নতুন জাতের চাগাছ উদ্ভাবন করতে পারতেন, তাহলে হয়তো এর চেয়েও উন্নত জাতের চা পাতা বাংলাদেশে উৎপন্ন করা যেত। কিন্তু গবেষণার কাজটি যেসব প্রতিষ্ঠান করত, সেই বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) এবং প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিটই (পিডিইউ) এখন লোকবলের অভাবে শূন্য হতে চলেছে। ভাবতেই অবাক লাগে, এই দুটি প্রতিষ্ঠানেই নাকি অনেক গুরুত্বপর্ণ পদে দীর্ঘদিন ধরে কর্মকর্তা নেই। তাহলে প্রতিষ্ঠান দুটিই বা কিভাবে চলছে? চা শিল্পের উন্নতিই বা কিভাবে আশা করছি আমরা?
দেশে এখন ১৬২টি চা বাগান রয়েছে। এর সিংহভাগই বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে অবস্থিত। মৌলভীবাজারে ৯০টি, হবিগঞ্জে ২৩টি, সিলেটে ১৯টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১টি, চট্টগ্রামে ২২টি, রাঙামাটিতে ১টি এবং পঞ্চগড়ে ১টি চা বাগান রয়েছে। এসব চা বাগানে হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করে, চা বাজারজাতকরণের সঙ্গে জড়িত রয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। তবে দেশের চা শিল্প সম্পর্কে গবেষণার জন্য প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট সব চাহিদার জোগান সংগত কারণেই আশা করতে পারে। এখানে যেসব বিশেষায়িত গবেষণা হওয়া জরুরি, তাতে কোনোভাবেই ছেদ পড়া উচিত নয়। কেননা, নিরন্তর গবেষণা ছাড়া কোনোভাবেই উন্নত জাতের চায়ের চারা উদ্ভাবন করা সম্ভব নয়। প্রতিষ্ঠানটি ১৯৫৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সীমিত লোকবল নিয়েও ১৮টি ক্লোন উদ্ভাবন করলেও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাবেই সম্ভবত মাত্র দু-তিনটি ক্লোনকে মাঠ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছে। ১৮টি ক্লোনের সব ক'টিই যদি নেওয়া সম্ভব হতো, তাহলে আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের চায়ের রং ও স্বাদে তো বৈচিত্র্য আসতই, উৎপাদনও ব্যাপক পরিমাণে বৃদ্ধি পেত। আমাদের দেশে কৃষি খাতে অনেক ধরনের বীজ ও জাতের উদ্ভাবন ঘটানো হয়েছে, ঘটছেও। এর সুফল জাতীয়ভাবে আমরা পাচ্ছি।
চা আমাদের অন্যতম অর্থকরী ফসল। এখানে নিরবচ্ছিন্ন গবেষণা ছাড়া এক কদমও অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। বিটিআরআই নামক প্রতিষ্ঠানটি সেই উদ্দেশ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই প্রতিষ্ঠানে আটটি বিভাগে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা নিয়োগও পেয়ে থাকেন। বিভাগগুলো হচ্ছে মৃত্তিকাবিজ্ঞান, প্রাণরসায়ন, উদ্ভিদবিজ্ঞান, কৃষিতত্ত্ব, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব, কীটতত্ত্ব, কৃষি পরিসংখ্যান ও অর্থনীতি এবং চা প্রযুক্তি। চা শিল্পের উন্নয়নে এ ধরনের বিশেষায়িত জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু মনে হয়েছে, বিভাগগুলোকে জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার চেয়ে আমলাতান্ত্রিক নিয়ম-নীতির দপ্তরেই বেশি পরিণত করা হয়েছে। অথচ প্রয়োজন ছিল প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরের বিভাগগুলোকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত করা, ছাত্রছাত্রী ভর্তি করে এর বিভাগগুলোকে সক্রিয় করা, যেসব ছাত্রছাত্রী এখান থেকে পাস করত, শুধু তাদেরই প্রতিষ্ঠানে এবং চা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত করা। তাহলে দেশের চা শিল্প এতদিনে হয়তো ভিন্ন অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়ে যেত। একই সঙ্গে যেসব বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এখানে নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁরাও কর্মকর্তা না হয়ে শিক্ষক ও গবেষকে পরিণত হতে পারতেন। তাতে প্রতিষ্ঠানটিও প্রকৃত বিজ্ঞান ও গবেষণার মর্যাদা এবং চরিত্র লাভ করার সুযোগ পেত। দূর থেকে আমার কাছে মনে হয়েছে, সেই চরিত্রটি লাভ করতে না পারার কারণেই এখানে নিয়োগপ্রাপ্ত বেশির ভাগ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শেষ পর্যন্ত ইনস্টিটিউটে থাকার চিন্তা করেন না। সুযোগ পেলেই কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে পাড়ি জমান। এ কারণেই গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির মস্তিষ্ক হিসেবে খ্যাত অংশটি প্রায়ই ফাঁকা হয়ে পড়ে। দেহের অন্য অংশগুলো তাই অচল হতে বাধ্য। শেষ বিচারে এখন এটা রূপান্তরিত হয়েছে দেশের অন্যসব সরকারি আমলানির্ভর প্রতিষ্ঠানে, যেখানে চাকরি করা হয়, কিন্তু কাজ করা যায় না; তাই ভালো ফল বলে কিছু অর্জিতও হয় না।
অথচ এই একটি প্রতিষ্ঠানকেই যদি আমরা একটু জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় চলতে দিতাম, তাহলে চা শিল্পে হয়তো বড় ধরনের বিপ্লবই আমরা ঘটিয়ে দিতে পারতাম, দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের বাজার দখল করাও হয়তো সম্ভব হতো। এখন ভারত ও শ্রীলঙ্কা সে বাজার অনায়াসেই দখল করে নিয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়লে শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যেও পিছিয়ে পড়তে হয়_এই বোধ ও শিক্ষা যত তাড়াতাড়ি আমরা ধরতে পারব, ততই মঙ্গল। দেশের চা শিল্পকে এই দুরবস্থা থেকে মুক্ত করতে হলে এর প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের সঙ্গে শিক্ষা ও গবেষণাকে গুরুত্ব দিতে হবে, আমলাতান্ত্রিক পুরনো ধ্যান-ধারণাকে বিদায় করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
চা শিল্পের দুরবস্থা দূর করতে হবে জাতীয় স্বার্থেই, জাতীয় অর্থনীতির জন্য তো বটেই। পাশাপাশি এ কথাটিও আমলে নিতে হবে, এর সঙ্গে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের বিষয়টিও জরুরি। আমাদের রপ্তানি পণ্যের তালিকায় চা যাতে আবার একটি বড় স্থান করে নিতে পারে, সেই প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
patwari54@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.