বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩০৩ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আমির হোসেন, বীর প্রতীক অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করেন তিনি নিকষ অন্ধকার রাত। গোপন স্থান থেকে বেরিয়ে পড়লেন আমির হোসেনসহ ১১ জন নৌ-কমান্ডো। তাঁরা গেলেন কর্ণফুলী নদীর পূর্ব পাড়ে জলদিয়া বাতিঘরে।


নেমে পড়লেন সমুদ্রে। অদূরে ভেসে আছে অনেকগুলো জাহাজ। তারপর তাঁরা অনেকক্ষণ সাঁতার কাটলেন। সবার পায়ের ফিনস ওঠানামা করছে। প্রায় দেড় ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় কেটে গেল। নৌ-কমান্ডোরা মাথা তুললেন; দেখলেন, দূরত্ব কমেনি একটুকুও। তখন ভয়ংকর হয়ে উঠছে সমুদ্র। ক্রমশ বাতাস বাড়ছে, তুঙ্গে উঠছে গর্জন। হালকা ঢেউ বিশাল বিশাল ঢেউয়ে রূপ নিচ্ছে। পাহাড়সম উঁচু ঢেউ শোঁ শোঁ শব্দে গভীর সমুদ্র থেকে ধেয়ে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যে তাঁরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন একে অপরের কাছ থেকে। সবাই প্রাণপণে চেষ্টা করছেন তীরে পৌঁছানোর। কিন্তু ব্যর্থ হলো তাঁদের সে চেষ্টা। হারিয়ে গেলেন অতল পানিতে।
এ ঘটনা ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালের। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে। নৌ-কমান্ডোদের দলনেতা ফারুক-ই-আজম সিদ্ধান্ত নেন বহির্নোঙরে অপারেশনের। তখন সেখানে অপেক্ষমাণ ছিল বেশ কয়েকটি জাহাজ। অপারেশনের জন্য স্থির হয় জোয়ার-ভাটার নির্দিষ্ট সময়। কিন্তু এ অভিযানের জন্য রেকিতে একটা বিরাট ভুল করে ফেলেন কমান্ডোরা। ওই ভুলটি ঘটে তাঁদের নিজেদের অজ্ঞাতেই। সেটা হলো দূরত্বের হিসাব। তাঁরা আন্দাজ করেছিলেন, ওই দূরত্ব দেড়-দুই মাইলের বেশি হবে না। বাস্তবে সে দূরত্ব ছিল চার-পাঁচ গুণ বেশি। জলপথের দূরত্ব পরিমাপে তাঁরা কেউ অভিজ্ঞ ছিলেন না। আরেকটি ভুল তাঁরা করেন। ভাটার সময় টার্গেটের কাছে তাঁদের যাওয়ার কথা ছিল নৌকায়। কিন্তু নৌকা না পেয়ে তাঁরা সাঁতরেই সেখান যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। শেষ পর্যন্ত এক করুণ পরিণতির মধ্য দিয়ে ওই অপারেশন শেষ হয়। পানিতে হারিয়ে যাওয়ার পর তাঁরা জীবন্মৃত অবস্থায় তীরে পৌঁছান। আমির হোসেনসহ চারজন নদীর পশ্চিম মোহনায় মেরিন একাডেমি জেটির কাছে তীরে ভেসে ওঠেন অজ্ঞান অবস্থায়। পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের ধরে নিয়ে যায়। জ্ঞান ফেরার পর পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ ও পাশবিক নির্যাতন করে। নির্মম নির্যাতনে একজন (মোহাম্মদ হোসেন, বীর প্রতীক) মারা যান। আমির হোসেনসহ তিনজন বেঁচে যান। পরে তাঁদের স্থানান্তর করা হয় ঢাকায়। ঢাকা সেনানিবাসে বন্দী থাকা অবস্থায় তাঁরা নির্মম নির্যাতনের শিকার হন।
আমির হোসেন ১৯৭১ সালে ফেনী কলেজে পড়াশোনা করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন প্রতিরোধ যুদ্ধে। পরে ভারতে যান। ভারতে তাঁকে মুক্তিবাহিনীর নৌ-কমান্ডো দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে, বিশেষ করে চট্টগ্রাম বহির্নোঙর অপারেশনের জন্য আমির হোসেনকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়েছে। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ২৯৭।
আমির হোসেনের পৈতৃক বাড়ি ফেনী সদর উপজেলার ফরহাদনগর ইউনিয়নের নৈরাজপুর গ্রামে। বর্তমানে তিনি কানাডাপ্রবাসী। তাঁর বাবার নাম দলিলুর রহমান, মা শরবত বিবি। স্ত্রী হোসনে আরা বেগম। তাঁদের চার মেয়ে ও এক ছেলে।
সূত্র: ফখরুল ইসলাম (নোয়াখালী) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১০।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrshed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.