সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সংসদে প্রস্তাব গ্রহণ

সরকার না চাইলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে গতকাল একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে জাতীয় সংসদে। ফলে সংসদীয় বিধি অনুযায়ী সরকারকে এ বিষয়ে এখন আইন প্রণয়ন করতে হবে।সংসদ সচিবালয় সূত্র জানায়, সরকারের অবস্থানের বাইরে সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশের সংসদীয় ইতিহাসে এটিই প্রথম।
আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম সিদ্ধান্ত প্রস্তাবটি প্রত্যাহারের অনুরোধ করলে নোটিশদাতা সরকারদলীয় সাংসদ বেনজীর আহমদ তা প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু সংসদীয় নিয়ম অনুযায়ী এটি ভোটে দেওয়া হলে সাংসদেরা সিদ্ধান্ত প্রস্তাবটি প্রত্যাহারের বিপক্ষে ভোট দেন। ফলে প্রস্তাবটি সংসদে গৃহীত হয়ে যায়। ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী এ সময় অধিবেশনে সভাপতিত্ব করছিলেন।
যোগাযোগ করা হলে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, সংসদে সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গৃহীত হওয়ায় এখন অবশ্যই আইন করতে হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যারা বাধাগ্রস্ত করতে চায়, তাদের অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু যে আইনের কথা বলা হচ্ছে, তা বিরোধী দলকে দমনের উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে। তিনি মনে করেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাধা দিয়েছে আওয়ামী লীগ নিজেই। শাস্তি হওয়া সাত শতাধিক অপরাধীকে তারা ছেড়ে দিয়েছে। জামায়াতে ইসলামীকে পাশে বসিয়ে রাজনীতি করে বাধা সৃষ্টি করেছে। এখন বিএনপি যা করছে, তা হচ্ছে এই বিচারের প্রক্রিয়াগত সমালোচনা। এটা দেশে-বিদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকেও হচ্ছে। সরকার বাধা সৃষ্টিকারীদের শান্তি না দিয়ে সমালোচনাকারীদের শাস্তি দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে।
যেভাবে প্রস্তাবটি গৃহীত হলো: গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে সংসদের বেসরকারি দিবসে সিদ্ধান্ত প্রস্তাবটি উপস্থাপন করেন বেনজীর আহমদ। প্রস্তাবটি ছিল, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য যারা বাধাগ্রস্ত করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিধি-বিধান করা হোক।’ সরকারি দলের গোলাম দস্তগীর গাজী, শহিদুজ্জামান সরকার, ইসরাফিল আলম, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, নাজমা আকতার ও জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক প্রস্তাবের আগে ‘অবিলম্বে’ শব্দটি যোগ করার সংশোধনী আনেন। সংসদে তা গৃহীত হয়।
এরপর প্রস্তাবের ওপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সরকার আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার-প্রক্রিয়া শুরু করেছে। মার্চের মধ্যে আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হবে। এরই মধ্যে সংসদে এ বিষয়ে একটি প্রস্তাবও পাস হয়েছে। সরকার আপাতত বাধাদানকারীদের ব্যাপারে নমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করছে। তবে এ নমনীয় ভাব থাকবে না। অবিলম্বে বাধাদানকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। এ ব্যাপারে নতুন কোনো আইন প্রণয়নের প্রয়োজন নেই। প্রচলিত আইনেই বিচার করা সম্ভব। এ বক্তব্য দিয়ে আইন প্রতিমন্ত্রী সিদ্ধান্ত প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য নোটিশদাতা বেনজীর আহমদকে অনুরোধ করেন।
প্রতিমন্ত্রীর অনুরোধে সাড়া দিয়ে বেনজীর আহমদ প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করে নেন। এরপর আইন প্রতিমন্ত্রীর অনুরোধে সিদ্ধান্ত প্রস্তাবটি প্রত্যাহারের জন্য ডেপুটি স্পিকার ভোটে দেন। কিন্তু অল্প কয়েকজন সাংসদ প্রস্তাব প্রত্যাহারের পক্ষে মৃদুস্বরে ‘হ্যাঁ’ উচ্চারণ করেন। সঙ্গে সঙ্গে মহাজোটের সব সাংসদ একযোগে দাঁড়িয়ে প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেন। মুহূর্তেই অশান্ত হয়ে ওঠে অধিবেশন কক্ষ। ফজলে রাব্বি মিয়া, আলী আশরাফ, মুজিবুল হক, মুহিবুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন সাংসদ ফ্লোর না নিয়েই চিৎকার করে ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন।
ফজলে রাব্বি মিয়া ফ্লোর নিয়ে বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধে আমরা ৩০ লাখ সহযোদ্ধাকে হারিয়েছি। যুদ্ধাপরাধীরা ওই সময় প্রকাশ্য আমাদের মা-বোনদের সম্ভ্রমহানি করেছে। নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছে। এদের বিচার করতে জাতীয় সংসদেই সর্বসম্মতভাবে প্রস্তাব পাস হয়েছে। তাই এই প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করা হলে যারা যুদ্ধাপরাধী, যারা এ বিচারকার্যকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়, তারা সুযোগ পাবে। ষড়যন্ত্রকারীরা উৎসাহিত হবে। প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করা হলে সংসদকে অবমাননা করা হবে।’
এ সময় সরকারি দলের সব সাংসদ টেবিল চাপড়ে ফজলে রাব্বিকে সমর্থন জানান। উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সামাল দিতে সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী দাঁড়িয়ে বলেন, প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করা উচিত হবে না। বরং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ যত দিন শেষ না হচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত প্রস্তাবটি স্থগিত রাখা যেতে পারে।
এ সময় চিফ হুইপ আব্দুস শহীদ বলেন, প্রস্তাবটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে প্রস্তাব উত্থাপনকারী সাংসদ নিজেই প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করার কথা বলেছেন। এখন এটি গ্রহণ বা প্রত্যাহার করার এখতিয়ার সম্পূর্ণ স্পিকারের। ফজলে রাব্বিসহ সদস্যরা আবার একযোগে দাঁড়িয়ে এর বিরোধিতা করেন। তীব্র হইচইয়ের এ পর্যায়ে পাঁচটা ৪০ মিনিটে স্পিকার আবদুল হামিদ অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করে সভাপতির দায়িত্ব নেন।
স্পিকার বলেন, ‘মন্ত্রী বললেও প্রস্তাবটি আমি ভোটে দেব। সদস্যরা ভোট দিয়ে যদি প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন, তবে তা গৃহীত হবে। আর প্রত্যাহারের পক্ষে ভোট দিলে প্রস্তাবটি প্রত্যাহার হবে। এ নিয়ে প্রতিবাদের কিছু নেই।’
এ সময় স্পিকার প্রস্তাব উত্থাপনকারী বেনজীর আহমদকে ফ্লোর দিয়ে জানতে চান, তিনি প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করে নিতে চান কি না। জবাবে বেনজীর আহমদ বলেন, ‘আমি প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করে নিতে চাই না। আমি যে প্রস্তাব এনেছি, তা দেশের মানুষের ৪০ বছরের পুঞ্জীভূত দুঃখ-বেদনার বহিঃপ্রকাশ। এ সিদ্ধান্ত প্রস্তাবটি গ্রহণ করার জন্য আমি সংসদে দাবি রাখছি।’
এরপর প্রস্তাবটি ভোটে দিলে তা সর্বসম্মতভাবে পাস হয়। এমনকি প্রস্তাব প্রত্যাহারের অনুরোধকারী আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামও প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক এবং সংসদবিষয়ক গবেষক নিজাম উদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ঘটনা সংসদের ইতিহাসে নেই। সাধারণত মন্ত্রীরা প্রত্যাহারের অনুরোধ করলে সাংসদেরা তার বিপক্ষে ভোট দেন না। এর আগে পঞ্চম সংসদে সরকারি দলের বিপক্ষে কোস্টগার্ড-সম্পর্কিত একটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব পাস হয়েছিল। সেদিন সংসদে সরকারি দলের সদস্যরা সংখ্যায় কম ছিলেন। শেষ পর্যন্ত বিরোধী দলের ভোটে সিদ্ধান্ত প্রস্তাবটি গৃহীত হয়ে যায়।
আরেকটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব: প্রতিটি উপজেলা সদরে একটি করে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করার ব্যাপারে অন্য একটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গতকাল গৃহীত হয়। এ প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন জুনাঈদ আহমেদ পলক।

No comments

Powered by Blogger.