নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে অনানুষ্ঠানিক কথা by জাহাঙ্গীর আলম ও তানভীর সোহেল

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে সরকার ও বিরোধী দলের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তা হচ্ছে। নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা কেমন হবে, এ নিয়ে কথা বলছেন তাঁরা। উভয় দলের নেতারা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।


আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা জানান, বিভিন্ন দূতাবাসের অনুষ্ঠানে সরকার ও বিরোধী দলের নেতারা আমন্ত্রিত হন। এসব অনুষ্ঠানে তাঁদের মধ্যে কিছু কথাবার্তা হয়। আবার প্রভাবশালী কয়েকটি দেশের দূতাবাসের মাধ্যমেও তাঁদের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী সরকারব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
জানা যায়, উভয় দলই এ বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে আগ্রহী। অতীতের অরাজনৈতিক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের অভিজ্ঞতার আলোকে সমস্যা জটিল হওয়ার আগেই রাজনৈতিক সমাধানের ব্যাপারে তাঁরা নীতিগতভাবে একমত।
তবে বাস্তবে সমাধানে পৌঁছানো কতটুকু সম্ভব, তা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যেই সন্দেহ রয়েছে। এখনো উভয় দল নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলেও অন্য নামে নির্দলীয় সরকার চাইছে। আর আওয়ামী লীগ দলীয় বা অরাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে গণতন্ত্র ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছে। তারা নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করে রাজনৈতিক সরকারের অধীনেই নির্বাচন করার পক্ষে।
বিভিন্ন দূতাবাসের অনুষ্ঠানে এ নিয়ে বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হওয়ার কথা নিশ্চিত করেন কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী।
একইভাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে এখন পর্যন্ত নির্দলীয় সরকারের বিষয়ে বিএনপির আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা হয়নি। তবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক কথা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ ধরনের সরকারের রূপরেখা কী হবে তা চূড়ান্ত হয়নি। তবে এ নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা হয়েছে। দলের নিজস্ব কিছু চিন্তাভাবনা তো আছেই।
সূত্র জানায়, কিছু দিন আগে একটি প্রভাবশালী দেশের দূতাবাসের নৈশভোজে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের দেখা হয়। তাঁদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তায় নির্বাচনকালীন সময়ের সরকারব্যবস্থা নিয়েও কথা হয়। উভয় নেতা রাজনৈতিক সমঝোতার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পরররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ও ব্লেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক ছাড়াও দুই দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয় বলে জানা গেছে।
সরকারের নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনির্বাচিত বলে এ ব্যবস্থায় সরকার দুর্বল থাকে। তাই নির্বাচনকালে অনির্বাচিত বা অরাজনৈতিক সরকার থাকলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় তৃতীয় কারও হস্তক্ষেপের আশঙ্কা থাকে। কারণ, ১৯৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও সেনা-অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়েছিল। একইভাবে ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়েও দুই বছর অরাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় ছিল। এতে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা হয়রানির মধ্যে পড়েন। এ ছাড়া উচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা অসাংবিধানিক বলে আখ্যা দেওয়ায় তা জাতীয় সংসদ বাতিল করেছে।
সরকারের নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, রাজনীতিবিদদের কর্তৃত্ব বহাল রেখেই নির্বাচনকালীন সরকার হতে পারে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার যেকোনো প্রস্তাব সরকার মানতে প্রস্তুত।
বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, তত্ত্বাবধায়ক হোক আর অন্তর্বর্তী হোক—যে সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, সেই সরকারের প্রধান ও অন্য সদস্যদের অবশ্যই অরাজনৈতিক ব্যক্তি হতে হবে। কোনো দলীয় ব্যক্তিকে মেনে নেওয়া হবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। বিষয়টি সরকারকে বোঝানো সম্ভব হয়েছে বলেই দল মনে করে। এ ব্যাপারে অনেক সময় নানা অনুষ্ঠানে দেখা হলে আওয়ামী লীগের নেতারা জানতে চেয়েছেন। আমরা সেটা বলেছি।’ তিনি বলেন, বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক বা অন্য যে নামেই হোক না কেন, এমন সরকার গঠনে যেকোনো স্থানে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত আছে।
বিএনপির নেতারা জানান, গত বুধবার রাতে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে রবার্ট ব্লেকের বৈঠকেও এ নিয়ে কথা হয়। এ সময় খালেদা জিয়া নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।

No comments

Powered by Blogger.