জীবন অদম্য-ভালো থেকো জুঁই by ওয়াসি আহমেদ

জুঁই, ওরফে হাওয়া আক্তার জুঁই নামের সবে কৈশোর পেরোনো মেয়েটিকে ভালো থাকার মতো মামুলি কুশল কামনা এক অর্থে বোকামিই। মেয়েটি তার বয়সী আর পাঁচটা নিম্নবিত্ত ঘরের মেয়ের মতো হয়েও এতটাই আত্মপ্রত্যয়ী, অদম্য সাহসী, নিছক কুশল কামনার তোয়াক্কা তার করার কথা নয়।


২১ জানুয়ারি ডেইলি স্টার-এর প্রথম পাতায় সে বড়সড় খবর হয়ে এসেছে। ‘বড়সড়’ এ জন্য বললাম, ছবিটবিসমেত খবরটা পত্রিকার অনেকখানি জায়গা জুড়েছে। ১৮-১৯ বছর বয়সী জুঁই বিবাহিত আর যেহেতু তাকে নিয়েই খবর, বিষয়টা স্বামীনিগ্রহসংক্রান্ত হওয়াই স্বাভাবিক। তবে আমাদের দেশ-কালের দৈনন্দিন রুটিনভিত্তিক নৃশংসতার নিরিখে জুঁইয়ের ঘটনা কিছুটা ব্যতিক্রমী হলেও তাক লাগানো কিছু নয়। আগেই বলেছি জুঁই বিবাহিত, পড়াশোনায় প্রবল আগ্রহ, কিন্তু নিজের আগ্রহ তো বড় কথা নয়, বিবাহিত হয়ে সে যেহেতু স্বামীর অধীন, তাকে তো সে অধীনতা পদে পদে মেনে চলতে হবে—লেখাপড়ায় আগ্রহের মতো উটকো শখকে বেদম ঝাঁটাপেটা করে হলেও। তবে এ মেয়ে একরোখা, পড়বেই। শুধু স্কুল-কলেজের গণ্ডিই পেরোবে না, উচ্চশিক্ষাও নাকি নেবে, নেবেই। তার দুবাইপ্রবাসী স্বামী রফিকুলের কাছে যা আনুগত্যহীনতার চরম বেলাজ প্রকাশ ছাড়া আর কী! তার আত্মশ্লাঘা হাটে-বাজারে সশব্দে ফুটো করে দেওয়ার মতো ব্যাপার। কিন্তু সমাধানসূত্র আছে, আর তা সোজাসাপটাও। রফিকুল গোপনে দেশে ফিরে সেই সোজাসাপটা পথই ধরে। গত ডিসেম্বরের ৪ তারিখে এইচএসসি পরীক্ষার্থী জুঁইকে কায়দা করে ঢাকায় বোনের বাসায় ডেকে এনে তার ডান হাতের আঙুলকটা সে ঘ্যাঁচ করে কেটে নেয়। দা-ছুরি-কাঁচি যা-ই সে ব্যবহার করুক, কর্তনপর্বটি নিশ্চয় তার খুব মনঃপূত হয়, কারণ ডানহাতি জুঁই লেখালেখির সময় কলম-পেনসিল তো ডান হাতেই ধরে। সুতরাং কেটে-ছেঁটে সাফ্ করার পর কলম বা পেনসিলের মতো ফালতু খেলনার সঙ্গে জুঁইয়ের সখ্য চিরতরে ঘুচে যাবে, এ তো অবধারিত।
বলার অপেক্ষা রাখে না, আমরা যারা এ দেশে বাস করি, সকালে খবরের কাগজে চোখ বোলাই, ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় সন্ধ্যায় টিভির সামনে বসি, তাদের কাছে এ ঘটনা ভয়ংকর কিছু নয়—কটা মাত্র আঙুলই তো!
ডেইলি স্টার-এর খবরের মূল ঘটনা এটুকুই। কিন্তু মূল ঘটনার পিছু পিছু গত মাস দেড়েকে যে নীরব ঘটনাপ্রবাহ জুঁইকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বা ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি থেকে জুঁই যেভাবে নিজেকে দাঁড় করিয়েছে, তা আমাদের অবশ-বিবশ অনুভূতিকে নাড়াই দেয় না, আপাদমস্তক শিহরিত করে ছাড়ে। আমরা জানতে পারি, এমন অবস্থায়ও পিছুহটা দূরের, আত্মীয়স্বজন, বাবা-মায়ের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও জুঁই আসন্ন পরীক্ষায় বসার জেদি ঘোষণা দিয়েছে। পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে গোপনে মায়ের তহবিলে হাত দিয়েছে, আঙুলহীন ডান হাতের নির্ভরতা ঝেড়ে বাঁ হাতে কোনো রকমে কলম আঁকড়ে এইচএসসি পরীক্ষার ফরমপূরণ করেছে। চিকিৎসকেরা পরম যত্নে তার কাটা আঙুলের পরিচর্যা করেছেন, কব্জি আর বুড়ো আঙুলে স্পিন্ট বসিয়ে কলম ধরার মোটামুটি একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কিন্তু তাই বলে পাক্কা তিন ঘণ্টার পরীক্ষা! চিকিৎসকদের প্রতি সকৃতজ্ঞ জুঁই তাদের বারণ সত্ত্বেও পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হাসপাতাল ছেড়ে নরসিংদীতে বাড়ি ফিরে গেছে। উচ্চশিক্ষার সিঁড়ি ভাঙতে অন্য পথ তার জানা নেই।
জুঁইয়ের প্রতি সহমর্মী সাংবাদিক যখন তার কাছে জানতে চেয়েছেন, সে কোনো ধরনের সাহায্যের প্রত্যাশী কি না, সে একবাক্যে জানিয়েছে—না। নিজেকে সে নিজ প্রচেষ্টায় দাঁড় করাতে চায়। এমনকি অন্যের সহানুভূতির মুখাপেক্ষীও সে নয়।
নিজ প্রচেষ্টা—অহর্নিশ কতই না আমরা কথাটা শুনি। শুনতে ভালো লাগে, বিশ্বাস কি করি? না করলেও শুনি এবং বলিও। এ আমাদের ইচ্ছাপূরণ। নিজ প্রচেষ্টা বলতে কতখানি জেদ, অহংকার, আত্মপ্রত্যয় আর আমাদের মতো পরিবেশ-পরিস্থিতিতে বাধাবিঘ্ন্ন চুরমার করার কতটা শক্তি দরকার, তা কি ভাবি? এ মুহূর্তে জুঁইয়ের আঙুলছাঁটা ডান হাতটা যখন চোখে ভাসছে, আমার সংশয় আমাকে ছেড়ে যাচ্ছে। জুঁই, আমি দেখতে পাচ্ছি তুমি তোমার নিজের, একার প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাচ্ছ। এমনিতেই তুমি অনেকখানি এগিয়ে। আমার শুভকামনায় কিছু যাবে আসবে না, তবু বলি, ভালো থেকো, ভালো থেকো সোনার মেয়ে।
ওয়াসি আহমেদ: কথাসাহিত্যিক।

No comments

Powered by Blogger.