ওরাও যে মানুষ!-সাতক্ষীরা ও খুলনার বন্যাকবলিতদের বাঁচতে দিন

মরা কি মানষির মধ্যে পড়ি'_এই প্রশ্ন খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার আলেয়া বেগমের। ৫৫ বছর বয়সে দিনের পর দিন উপোস করে, নির্ঘুম রাত কাটিয়ে এমনই সংশয় জন্মেছে তাঁর। শুধু আলেয়া বেগম নন, সাতক্ষীরা ও খুলনার ১০ লাখের বেশি মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে রমজান ও ঈদ পার করেছে। অনেককেই ঘরবাড়ি ছেড়ে রাস্তার পাশে বা কোনো উঁচু স্থানে পলিথিনের ছাউনিতে আশ্রয় নিতে হয়েছে।


খাবার নেই, তৃষ্ণা মেটানোর মতো পানি নেই, এমনকি কেউ মারা গেলে তাকে কবর দেওয়ার মতো জায়গাও নেই_এভাবেই পার করছে তারা একটি মাস। অথচ তাদের জন্য সরকারি-বেসরকারি সাহায্য-সহযোগিতা নেই বললেই চলে।
তাদের এই দুঃখের কারণ কপোতাক্ষ নদ ও বেতনা নদী। এ দুটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির পানি নামতে পারছে না। ফলে সৃষ্টি হয়েছে স্থায়ী জলাবদ্ধতার। ফসলের জমি, মাছের ঘের_সবই এখন পানির নিচে। এলাকার প্রায় সব নলকূপও পানির নিচে। দরিদ্র ও কৃষিজীবী এসব মানুষের হাতে কোনো কাজ নেই, কোনো উপার্জন নেই। সাতক্ষীরা-খুলনা মহাসড়কের দুই পাশে ১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে উদ্বাস্তুর জীবনযাপন করছে হাজার হাজার পরিবার। ক্ষুধা তাদের নিত্যসঙ্গী। ঈদের দিনও সন্তানের মুখে ভালো কোনো খাবার তুলে দিতে পারেননি_এই আফসোস অনেক মা-বাবার। আর নতুন জামা কিনে দেওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। তাই বন্যা ও জলাবদ্ধতার শিকার সাতক্ষীরার কয়েক শ গ্রামের মানুষের কাছে এবার ঈদ ছিল কেবলই কষ্টের। একসময়ের প্রমত্ত কপোতাক্ষ আজ অনেক স্থানেই মৃতপ্রায় খালে পরিণত হয়েছে। হেঁটে পার হওয়া যায়। কোথাও কোথাও কপোতাক্ষের তলদেশের উচ্চতা জলাবদ্ধ এলাকার চেয়ে বেশি। ফলে বৃষ্টির পানি নামতে না পেরে স্থায়ী জলাবদ্ধতা তৈরি করে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এর জন্য মূলত দায়ী বিভিন্ন অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রচেষ্টা। অতীতে এ এলাকায় বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। সেগুলোরই বিরূপ প্রতিক্রিয়া আজকের স্থায়ী জলাবদ্ধতা। তাই অবিলম্বে কপোতাক্ষসহ স্থানীয় নদনদী থেকে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে ফেলতে হবে এবং উপযুক্ত গভীরতায় খনন করতে হবে। এর আগে জলাবদ্ধ এলাকার দুর্গত মানুষকে রক্ষায় সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
আমরা ক্রমেই এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে চলেছি। দেশের বেশির ভাগ নদী আজ মৃতপ্রায়। ফলে বর্ষায় যেমন বন্যা ও জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে, নদীর ভাঙন ক্রমেই তীব্র হচ্ছে, তেমনি শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবও প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। অনেক স্থানে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অন্যদিকে দিন দিনই বেড়ে চলেছে সাগরের থাবা। এ বছরও কঙ্বাজার, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বাগেরহাটসহ উপকূলীয় জেলাগুলোর লাখ লাখ মানুষ একাধিকবার বন্যা মোকাবিলা করেছে। ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলায় উপকূল রক্ষাবাঁধ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত বহু স্থানেই বাঁধ মেরামত করা যায়নি। ফলে স্বাভাবিক জোয়ারেই বহু এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। যেকোনো মূল্যেই হোক, এই মহাবিপর্যয় থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে। সে জন্য ভারতের সঙ্গে অভিন্ন নদীগুলোর পানিবণ্টনের সমস্যা দ্রুত নিরসন করতে হবে। পাশাপাশি দেশের নদীগুলো পুনরুদ্ধারে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। সাতক্ষীরাসহ কিছু স্থানে আশু পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, নদী না বাঁচলে এই দেশও বাঁচানো সম্ভব হবে না। তাই নদীর ক্ষতি হতে পারে, এমন কোনো প্রকল্প হাতে নেওয়া থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.