তৃণমূল বনাম কংগ্রেস এবং মিডিয়া by সুব্রত আচার্য্য

মাত্র সাত মাসের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মধ্যে শরিকি বিবাদ প্রকাশ্যে ঝগড়ায় পরিণত। দুটি ভিন্ন ইস্যুতে তৃণমূল কংগ্রেস এবং কংগ্রেসের তর্কযুদ্ধে শামিল রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও। বলা ভালো, চলমান এই বাদানুবাদের মুখ্য ভূমিকায় রয়েছেন রাজ্যবাসীর 'পরিবর্তনের কাণ্ডারি' মমতা ব্যানার্জি স্বয়ং। তাঁর মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যরাও এখন প্রকাশ্যে সরকারের শরিক জাতীয় কংগ্রেসকে 'কানকাটা' বলে গালমন্দ দিচ্ছেন।


এটাও মমতার দেখানো পথ। মহাকরণে মিডিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে মমতা ব্যানার্জি কয়েক দিন আগে বলে দিলেন, 'সব দরজা খোলা আছে। চলে যেতে পারেন। সিপিএমের সঙ্গে জোট করে তৃণমূল কংগ্রেসের এই সরকারে থাকা চলবে না'। এর কিছুদিন আগেও তাঁরই মন্ত্রিসভার কয়েকজন সিনিয়র মন্ত্রী কংগ্রেসের ওপর রেগে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে সরকার ছেড়ে চলে যাওয়ার ফিসফাঁস করলেও প্রকাশ্যে কংগ্রেস সম্পর্কে কটূক্তি করার সাহস পাননি। দলের প্রধান তথা মুখ্যমন্ত্রীর মুখে সরকারের একমাত্র শরিক সম্পর্কে এমন মন্তব্য শোনার পর স্বাভাবিকভাবে ওই মন্ত্রীরাই এবার কংগ্রেসের চরিত্র হননে মাঠে নেমেছেন কোমর বেঁধে। যেমন_গত মঙ্গলবার কলকাতার একটি অনুষ্ঠানে মমতা ব্যানার্জি কংগ্রেসকে কুকুরের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, 'বাবু যায় বাজার, কুত্তা ভুকে হাজার'। অর্থাৎ তৃণমূল কংগ্রেস মা-মাটি-মানুষের সরকারের ভালো কাজ করছে। সেটা করে যাবে। পাশ থেকে কংগ্রেস যতই সমালোচনা করুক। তাতে তাদের (তৃণমূল কংগ্রেস) কিছুই যায়-আসে না। মমতা ব্যানার্জির এই উক্তি কিংবা কটূক্তি যা-ই বলুন না কেন পরদিন কলকাতার একটি-দুটি দৈনিক পত্রিকায় লিড হয়। সেখানেও কংগ্রেসকে কুকুরের সঙ্গে তুলনা করায় পত্রিকাগুলো মমতার হালকা সমালোচনা করে। যদিও মমতা ব্যানার্জি মাত্র কয়েক দিন আগেও মিডিয়া নিয়ে প্রকাশ্যে বিস্ফোরক অভিযোগ তুলে সমালোচনার মিডিয়ার সঙ্গে মধুচন্দ্রিমা ভাঙার শিলান্যাস (ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন) করেছিলেন। উত্তর দিনাজপুরে তাঁর রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সমর্থক বাহিনী যেভাবে রায়গঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ দীলিপ দে সরকারকে পিটিয়েছে, সেই দৃশ্য বিভিন্ন টেলিভিশনের মাধ্যমে প্রায় সারা দিন দেখানোয় ওই ঘটনা রাজ্যে 'টক অব দ্য স্টেটে' পরিণত হয়। সেই দৃশ্য দেখানোর জন্য নাকি মিডিয়াগুলো কংগ্রেস এবং সিপিএমের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে কলকাতার মিডিয়ায় একটি অংশ প্রশ্ন তুলেছে, নির্বাচনের আগে যেভাবে মমতাময় হয়ে গিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়া জগৎ। এর জন্য কত টাকা দিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী। পক্ষে থাকলে বন্ধু, সমালোচনা করলে শত্রু_এই নীতিই কি নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। রাজ্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যেভাবে তাঁর ছাত্র সংগঠনের ক্যাডাররা অক্টোপাসের মতো শিক্ষাব্যবস্থাকে গ্রাস করতে চাইছে, সেটা রাজ্যবাসী গত কয়েক দিন ধরে সংবাদমাধ্যমের বদৌলতে দেখে বিস্মিতই হয়নি; রবং এ ঘটনায় মমতার সরকারের সার্বিক সাত মাসের সাফল্য পর্যন্ত ঢেকে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। পরিবর্তনপন্থী বুদ্ধিজীবীরা এখন প্রকাশ্যে তৃণমূল সরকারের সমালোচনা করছেন। এমনকি যে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন বরাবরই এই সরকারকে পছন্দ করে আসছেন, তিনিই শিক্ষাঙ্গনে তৃণমূলের সন্ত্রাসে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। মমতা ব্যানার্জি সেদিন মিডিয়ার বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে ঠিক কী বলেছিলেন, 'এখানে কোনো টাকার খেলা হয়েছে কি না সেটাও দেখা দরকার'। শুধু তা-ই নয়, সাংবাদিকদের একটি প্রশ্নে সেদিনই মমতা উত্তেজিত হয়ে বলেন, 'আমি মিডিয়ার সব প্রশ্নের উত্তর দেব না।' বামফ্রন্টকে বিতাড়নের আগে পরিবর্তনের হাওয়াকে জোরদার করার পেছনে যে মিডিয়ার বড় ভূমিকার দাবি করেছিলেন, সেই মমতা ব্যানার্জির মুখে এখন মিডিয়ার বিরুদ্ধে এমন কথা শোনা যাচ্ছে। আর এতেই কলকাতার দুটি বড় দৈনিক পত্রিকা মমতার সরকারের কড়া সমালোচনার পথে হাঁটতে শুরু করেছে সম্প্রতি। এ নিয়েও মমতার প্রকাশ্যে বক্তব্য ছিল সম্প্রতি। বর্তমান পত্রিকার সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে মহাকরণে দাঁড়িয়ে মমতা বলেছিলেন, 'আমরা ক্ষমতায় আসার আগেও আমাদের পক্ষে বলতেন। এখন বর্তমান আমাদের বিরুদ্ধে বলে।' মন্দ কাজের সমালোচনা করায় পত্রিকার নাম ধরে এভাবে মিডিয়ার সামনে মন্তব্য করার পরদিন ওই পত্রিকাটিও মমতাকে প্রচ্ছন্নভাবে হুঁশিয়ার করে দিয়ে লেখে, 'আমরা কারো হুমকিতে ভয় পাইনি। তৃণমূল ভালো কাজ করলে ভালো বলব। খারাপ কাজ করলে সমালোচনা করব।' মিডিয়ার সঙ্গে মধুচন্দ্রিমা নিয়ে না বলে বরং এখন মূল কথায় ফেরা যাক।
তৃণমূল কংগ্রেসের সরকারের ৪০ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর মধ্যে কংগ্রেসের পূর্ণমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী মিলিয়ে সংখ্যাটা মাত্র পাঁচে। যদিও দ্বন্দ্ব বা ঝগড়াটা মনে হয় এই মন্ত্রিত্ব নিয়ে নয়। এই ঝগড়ার পেছনেও রয়েছে মূলত কেন্দ্রীয় রাজনীতি, এটার প্রধান কারণ। বলা ভালো, জোট রাজনীতির 'আন্ডারপ্রেসার গেম'। এফ ডি-তে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করায় ওই সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি কংগ্রেস পরিচালিত ইউপিএ সরকার। শুধু তা-ই নয়, সংসদে পাস হওয়া সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত লোকপাল বিলের তীব্র আপত্তি জানায় তৃণমূল কংগ্রেস। ফলে বাড়েনি পেট্রল-ডিজেলের দাম। কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্য থেকে তৃণমূল কংগ্রেস যেভাবে একের পর এক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করছে, তাতে কংগ্রেস যথেষ্ট অস্বস্তিত্বে রয়েছে। আর সে কারণেই তৃণমূল কংগ্রেসকে আন্ডারপ্রেসারে রাখার কৌশল হিসেবেই পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস তৃণমূলের বিরুদ্ধে চাপ বাড়াতে মাঠে নামে। কিন্তু এখানে কংগ্রেস ভুল করে। ইন্দিরা ভবনের নজরুল ইসলাম একাডেমী করার কথা জানালেও মমতা কখনোই বলেননি ইন্দিরা ভবনের নাম পরিবর্তন করা হবে। কিন্তু কংগ্রেস ইন্দিরা ভবনের নাম পরিবর্তন করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে প্রথম সরকারের বিরুদ্ধে পথে নেমে মিছিল করে। প্রতিবাদ সভা করে। এ ঘটনায় তৃণমূল যথেষ্ট ক্ষুব্ধ। জ্যোতি বসুর সরকারি বাসভবন ছাড়া একসময়ের পর্নকুটির ইন্দিরা গান্ধী তিন রাত যাপনে 'ইন্দিরা ভবন' হিসেবে নামকরণ করা হয়। এর বেশি কিছু ইতিহাস নেই এর পেছনে। কিন্তু তা সত্ত্বেও নজরুল ইসলামের মতো একজন কবিকে নিয়ে এমন উদ্যোগের বিরোধিতা করায় তৃণমূল উল্টো কংগ্রেসের ওপর চাপ প্রয়োগ করার কথা চিন্তা করতে করতেই উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ কলেজের ছাত্র পরিষদের হামলার শিকার হন একজন অধ্যক্ষ। ওই ঘটনায় কংগ্রেসের তরফ থেকে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। তৃণমূল কংগ্রেসের সমালোচনা করেন রায়গঞ্জের কংগ্রেস সংসদ সদস্য দীপাদাশ মুন্সি। এতেই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। এতটাই যে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নন, রাজ্য সরকারের সচিবালয় মহাকরণে সংবাদ সম্মেলনে হাজির হন তৃণমূল সভানেত্রী হিসেবে। মমতা বলেন, এ ঘটনার নিন্দা জানালেও এর পেছনে কংগ্রেস এবং সিপিএমের হাত রয়েছে।
মমতার এই মন্তব্য প্রচার হওয়ার পরদিনই ধর্মতলার সরকারে শরিক দল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে একই পথ অবলম্বন করে তৃণমূল কংগ্রেসও প্রতিবাদ সভা করে। সেখানে তৃণমূল শীর্ষ নেতা তথা রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় কংগ্রেসকে বলেন, মুখ্যমন্ত্রী দরজা খোলা থাকার কথা বলেছেন, এখনো আপনারা (কংগ্রেস) কেন বের হচ্ছেন না। সাপের মুখেও চুমু, ব্যাঙের মুখেও চুমু খাওয়া চলবে না। আবগারি মন্ত্রী সুব্রত মুখার্জি বলেন, চিলে কান নিয়ে গেছে শুনে কান না ধরে চিলের পেছনে দৌড়াচ্ছে কংগ্রেস নেতৃত্ব। আসলে এদের কান কাটা। নইলে মুখ্যমন্ত্রীর বলার পরও এরা সরকারে রয়েছে। বিশ্বাস হচ্ছে না। আসলে যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। ৩৪ বছরের বামফ্রন্টের শাসন দেখে অভ্যস্ত রাজ্যবাসীর প্রত্যাশা ছিল, যে ভুলগুলো বামফ্রন্ট করেছে, সেটি অন্তত করবে না বহু কাঙ্ক্ষিত তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত বর্তমান সরকার। কিন্তু রাজ্যবাসী গত কয়েক দিন ধরে যা দেখছেন, তাতে নতুন করে আবার বামফ্রন্টের পক্ষে নতুন পরিবর্তনের হাওয়াও উঠতে পারে_এমনটা ভাবলেও ভুল হবে না এখন।
লেখক : কলকাতার সাংবাদিক
subrata.acharjee@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.