কখনও কখনও প্রতিবাদ অনিবার্য হয়ে ওঠে-সীমান্তে নির্যাতন by আবু সাঈদ খান

জাতি হিসেবে যে আত্মমর্যাদাবোধ জনগণের মাঝে দেখি, নেতাদের কথাবার্তায় তার কোনো প্রতিফলন দেখি না। তাই বাংলাদেশের নাগরিক হাবিবুরের ওপর অত্যাচারের ঘটনায় ভারতের মানুষ যখন ঘৃণা ও ধিক্কার জানাচ্ছে, তখন বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কাছে এটি কোনো ব্যাপারই নয়। তার ভাষায়, 'সীমান্তে যা কিছু ঘটছে তার সঙ্গে বহু বিষয় জড়িত। এগুলো রাষ্ট্রীয় বিচারযোগ্য কোনো বিষয় নয়।


দুই দেশের পক্ষ থেকেই চোরাকারবারি, মাদক পাচার ও গরু চুরি হচ্ছে। প্রতিনিয়ত ঘটনা ঘটছে। এসব অতীতেও ঘটেছে, এখনও ঘটছে এবং ভবিষ্যতেও ঘটবে। এগুলো নিয়ে রাষ্ট্র খুব বেশি চিন্তিত নয়।' এর মানে কি এই যে, এভাবেই বাংলাদেশের নাগরিকরা লাঞ্ছিত হবে, আর রাষ্ট্র মুখ বুজে রইবে?
নির্মম বর্বতার শিকার হয়েও ক্ষত গোপন রেখেছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের আটরশিয়া গ্রামের হাবিবুর রহমান। কিন্তু আজ তা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সংবাদ। গত ১৯ জানুয়ারি বাংলাদেশি এক যুবকের ওপর ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের বর্বরতার ভিডিও চিত্রটি ফাঁস করে দেয় ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল এনডিটিভি। কেউ একজন পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার মৌরুসী সীমান্তচৌকির বিএসএফের হাতে বাংলাদেশের এক যুবককে বিবস্ত্র করে পেটানোর দৃশ্য মোবাইল ফোনে ধারণ করেছিল। এই ভিডিওটি গণমাধ্যমে আসার পর দুই দেশে আলোচনার ঝড় উঠেছে। বিভিন্ন সূত্রে স্পষ্ট যে, হাবিবুরকে গরু চোরাচালানকারী সন্দেহ করে তার কাছে ঘুষ চাওয়া হয়েছিল। তা দেওয়ার অপারগতায় তাকে বিবস্ত্র করে নির্মমভাবে পিটিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে বাংলাদেশে পুশব্যাক করা হয়েছে।
আমি হাবিবুরকে নির্দোষ মনে করছি না। তিনি আইনের চোখে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হতে পারেন। হতে পারেন চোরাচালানকারীও। এ জন্য তার আইনানুগ দণ্ড হলে আমাদের বলার কিছু থাকত না। কিন্তু এমন অমানবিক নির্যাতন কি সমর্থন করা যায়? ভারতের বিবেকবান মানুষও এটি সমর্থন করে না। সেখানকার গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকার কর্মীসহ অনেকেই ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ করেছেন।
অবশ্য সীমান্তে এমন ঘটনা নতুন নয়। নির্যাতন-নিপীড়ন তো বটেই, হত্যাকাণ্ডও আকসার ঘটছে। বিএসএফের ক্যাম্পে বেধড়ক পেটানো, বৈদ্যুতিক শক দেওয়া, গোপনাঙ্গে পেট্রোল ঢেলে আগুন দেওয়ার ঘটনাও শোনা যায়। দুঃখজনক হলেও সত্য, বিএসএফের হাতে গত ১ বছরে ৩১ বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন (অধিকার, মানবাধিকার প্রতিবেদন ২০১১)। বিভিন্ন সূত্র মতে, গত এক দশকে বিএসএফের গুলিতে নিহতের সংখ্যা এক হাজার। গত বছর সীমান্তে যখন কাঁটাতারের বেড়ায় কিশোরী ফেলানীর লাশ ঝুলছিল, তখনও ভারতের বিবেকবান মানুষ প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। সংশ্লিষ্ট বিএসএফ সদস্যদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। এবারও হাবিবুরের ওপর নির্যাতনের জন্য ৮ বিএসএফ সদস্যকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। ভারতীয় সংবাদপত্রই বলছে, বিভিন্ন সময়ে সাসপেন্ড হওয়া সদস্যরা আবার ফিরে আসে, অনুরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটায়। শুধু তাই নয়, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বারবার প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু সীমান্তে রক্তপাত বন্ধ হয় না।
এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যখন সীমান্তে বাংলাদেশের নাগরিকের রক্ত ঝরে, নির্যাতনে আহাজারি ওঠে, তখন বাংলাদেশের জনগণের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়, বন্ধুত্বের জন্য বাড়ানো হাত কেঁপে ওঠে।
ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী, বন্ধুরাষ্ট্র। আমরা ভুলতে পারি না, কোনোদিন ভুলব না যে, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে ভারত আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সে দেশের সেনাসদস্যরা আমাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। লাখো শহীদের রক্তে মিশে আছে ভারতীয় জোয়ানদের রক্তও। এই রক্তের বন্ধনকে অটুট রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সিংহভাগ জনগণের সদিচ্ছার অভাব নেই। তবে এ ক্ষেত্রে বন্ধুরাষ্ট্রের বন্ধুসুলভ আচরণ প্রত্যাশিত।
বাংলাদেশ ও ভারত সরকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে উদ্যোগী। সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশ ঘুরে গেলেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও চলতি মাসে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য ঘুরে এসেছেন। দুই সরকারের মধ্যে উষ্ণ বন্ধুত্ব রয়েছে, কিন্তু দুই দেশের বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে শুধু সরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ বা চুক্তি, কিংবা আওয়ামী লীগ-কংগ্রেস বা বিএনপি-কংগ্রেসের মধ্যে চুক্তি যথেষ্ট নয়; জনগণের মধ্যেও যোগাযোগ বাড়ানো জরুরি। বন্ধুত্বের প্রধান ভিত্তি হচ্ছে পিপল টু পিপল ফ্রেন্ডশিপ। আর সেটি করতে হলে সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে আসা-যাওয়া যোগাযোগ বাড়াতে হবে। উল্লেখ্য, যে ইউরোপের দেশগুলো একদা একে অন্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জড়িয়েছিল, সেই ইউরোপ আজ ইউরোপীয় ইউনিয়নের পতাকাতলে সমবেত। সেটি সম্ভব হয়েছে জনগণের মধ্যে অবাধ যোগাযোগের ফলে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক দেশের নাগরিক অন্য দেশে বিনা ভিসায় গাড়িতে বা ট্রেনে চেপে চলে যেতে পারে; যত খুশি সওদা করে ফিরতে পারে। না ফিরে সেখানে বাড়ি করেও বাস করতে পারে। আর আমাদের এখানে ভিসার জন্য যে কী কসরত করতে হয়, তা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। এ ক্ষেত্রে ভারতের বাংলাদেশ দূতাবাসের বাড়াবাড়িও কম নয়। কোনো পক্ষ মনে রাখে না যে, আমাদের পূর্বপ্রজন্ম একই দেশের নাগরিক ছিল। একই সঙ্গে তারা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রচনা করেছে। আমরা অভিন্ন ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী। দুই দেশের নাগরিকরা কেবল প্রতিবেশী নয়, অনেক ক্ষেত্রে একই পরিবারের সদস্য। এমনও আছে যে, বোন থাকেন ঢাকায়, ভাই কলকাতায়। কিংবা বাবা-মা রাজশাহীতে, ছেলেমেয়ে মুর্শিদাবাদ বাস করছেন। '৪৭-এর দেশ বিভাগ লাখ লাখ পরিবারকেও বিভক্ত করে দিয়েছে। সেই জায়গা থেকে দুই দেশের কঠোর ভিসা ও সীমান্তনীতি কতটুকু মানবিক?
ভারত বাংলাদেশের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে। সেটি তার রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত। এ নিয়ে কিছু বলছি না। তবে এর কারণ বোঝার অধিকার আমাদের আছে। এ সম্পর্কে ইতিপূর্বে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নাগরিকরা ভারতে গিয়ে বসবাস করতে পারে_ তা প্রতিরোধ করার জন্য এই আয়োজন। এখন নতুন কারণ যোগ হয়েছে জঙ্গি ঠেকানো। এ অভিযোগ অস্বীকার করি না যে, বাংলাদেশের কিছু লোক ভারতে কৃষি খামার, ইটভাটা কিংবা নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করে থাকে। অন্যদিকে এটি কারও অজানা নয় যে, অনেক ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশের গার্মেন্টসহ শিল্প-কারখানায় ট্যুরিস্ট ভিসায় এসে কাজ করছে। বাংলাদেশের নাগরিকদের বিনা ভিসায় ভারতে গিয়ে কাজ করা এবং ভারতের নাগরিকদের ট্যুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে এসে কাজ করা_ আইনের চোখে একই অপরাধ। তবে মানবিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি যৌক্তিক বিবেচিত হতে পারে। সেই বিবেচনায় উভয় দেশ এই যৌক্তিক কারণ মেনে নিয়ে ওয়ার্ক পারমিট দেওয়ার বিষয় ভাবতে পারে, কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আটকানো মানবিক সমাধান নয়। আর জঙ্গি ঠেকানোর বিষয়টি হাস্যকর। যখন জঙ্গি অধ্যুষিত আফগানিস্তান-পাকিস্তানের সঙ্গে সৌহার্দ্য নীতি গ্রহণ করা হচ্ছে, যখন জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় সফল বাংলাদেশের প্রতি কেন সন্দেহের তীর বর্ষিত হচ্ছে, তা বোধগম্য নয়।
উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের যে দেয়াল গড়ে উঠেছে, তা পরিবর্তিত না হলে দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব কি আদৌ সম্ভব? এখানে বাণিজ্যিক প্রয়োজনে ট্রানজিট-ট্রানশিপমেন্টের কথা ভাবা হচ্ছে। কিন্তু মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ, শ্রমশক্তির বিনিময়কে উপেক্ষা করা হচ্ছে। তবে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বৃহৎ দেশের ভূমিকাই প্রধান। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়া, বিভিন্ন নদীতে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার, তিস্তা চুক্তি স্থগিত করা, ভারতে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো প্রদর্শনে নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি দুই দেশের বন্ধুত্বে চিড় ধরাচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ব্যর্থতা কম নয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অতীতে আমরা অন্ধ ভারত বিরোধিতা দেখেছি, তা সাম্প্রদায়িক ও সংকীর্ণ মানসিকতাপ্রসূত। আর আজ যেটি দেখছি, সেটিকে এককথায় বলার সুযোগ নেই। বর্তমান মহাজোট সরকারের কোনো কোনো নেতার বক্তব্য শুনে তাদের কূটনৈতিক জ্ঞান সম্পর্কে প্রশ্ন দেখা দেয়। টিপাইমুখ বাঁধের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রতিমন্ত্রী বলেই ফেললেন, ওটি ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। কেউ কেউ বললেন, আগে বাঁধ দিক, পরে দেখা যাবে_ আসলে ক্ষতি হচ্ছে কি-না? প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টার ভাষায় ট্রানজিটের মাশুল নিয়ে দরকষাকষি অসভ্যতা। হয়তো তাই দরকষাকষি না করে ১৯৭২-এর ইন্দো-বাংলাদেশ প্রটোকল ইন ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রেডের আওতায় পণ্য পরিবহনের সুযোগ অবারিত করেছে। তিতাসের বুকে বাঁধ দিয়ে ভারতের পণ্যবাহী ট্রেইলারকে পারাপারে সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
জাতি হিসেবে যে আত্মমর্যাদাবোধ জনগণের মাঝে দেখি, নেতাদের কথাবার্তায় তার কোনো প্রতিফলন দেখি না। তাই বাংলাদেশের নাগরিক হাবিবুরের ওপর অত্যাচারের ঘটনায় ভারতের মানুষ যখন ঘৃণা ও ধিক্কার জানাচ্ছে, তখন বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কাছে এটি কোনো ব্যাপারই নয়। তার ভাষায়, 'সীমান্তে যা কিছু ঘটছে তার সঙ্গে বহু বিষয় জড়িত। এগুলো রাষ্ট্রীয় বিচারযোগ্য কোনো বিষয় নয়। দুই দেশের পক্ষ থেকেই চোরাকারবারি, মাদক পাচার ও গরু চুরি হচ্ছে। প্রতিনিয়ত ঘটনা ঘটছে। এসব অতীতেও ঘটেছে, এখনও ঘটছে এবং ভবিষ্যতেও ঘটবে। এগুলো নিয়ে রাষ্ট্র খুব বেশি চিন্তিত নয়।' এর মানে কি এই যে, এভাবেই বাংলাদেশের নাগরিকরা লাঞ্ছিত হবে, আর রাষ্ট্র মুখ বুজে রইবে? আমাদের নেতৃত্বকে বুঝতে হবে, অন্যায়ের প্রতিবাদ জানানো কিংবা বোঝাপড়া করা শত্রুতা নয়, বরং স্থায়ী বন্ধুত্বের জন্য তা অপরিহার্য।

আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com

No comments

Powered by Blogger.