জননী সাহসিকা-বাবা হারানোর শোক বুঝতে দেননি মা

ধ্যাপক আনোয়ার পাশা ও অধ্যাপক রাশীদুল হাসান ছিলেন ছোটবেলার বন্ধু। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় একই মাদ্রাসায় পড়তেন। কলেজের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও একসঙ্গে পড়তেন তাঁরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে আনোয়ার পাশা ও রাশীদুল হাসান পাবনা অ্যাডওয়ার্ড কলেজে অধ্যাপক হিসেবে পেশাজীবন শুরু করেন।


পরবর্তী সময়ে কিছুদিনের ব্যবধানে রাশীদুল হাসান ইংরেজি বিভাগে ও আনোয়ার পাশা বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। থাকতেনও একই সঙ্গে ঈশা খান রোডে। একসঙ্গে থাকার সুবাদে উভয়ের বাড়িতে দুই পরিবারের অবাধ যাতায়াত ছিল, ছিল নিবিড় এক সম্পর্ক। ১৯৭১ সালের পরিস্থিতি নিয়ে দুই বন্ধু আলোচনা করতেন। আর এই আলোচনা হতো রাতের আঁধারে, যখন স্ত্রী-ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়তেন।
যুদ্ধ চলাকালীন দেশের স্বাধীনতা যখন সময়ের ব্যাপার মাত্র, তখন একই সঙ্গে দুই বন্ধুকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসররা।
১৪ ডিসেম্বর আমাদের পরিবারের সবাই সকালে চলে গেলাম আনোয়ার চাচার বাসায়, খিচুড়ি রান্না হবে। মা আর চাচি (আনোয়ার পাশার স্ত্রী) একসঙ্গে লেগে গেলেন খিচুড়ি রান্না করতে। রান্না শেষে আমরা একসঙ্গে বসে খিচুড়ি খেয়ে বের হওয়ার জন্য দরজার কাছে দাঁড়িয়েছি মাত্র। এমন সময় দরজায় এসে দাঁড়াল অপরিচিত কয়েকজন। ওরা সংখ্যায় সাত-আটজন হবে। কারও মুখে কাপড় বাঁধা, কারও মুখ খোলা। জানতে চাইল, আনোয়ার পাশা কে? আনোয়ার চাচা নিজেকে দেখিয়ে বললেন, আমি আনোয়ার পাশা। এই দৃশ্য দেখে বাবা জানতে চাইলেন, আপনারা ওনাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? অস্ত্রধারীরা তেমন কোনো উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে বসলেন রাশীদুল হাসান কোথায় থাকেন? বাবা তখন বললেন, আমি রাশীদুল হাসান। আমাদের বলা হলো অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ওনাদের ছেড়ে দেওয়া হবে।
রাশীদুল হাসান ও আনোয়ার পাশাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতে বলতে রাশীদুল হাসানের মেয়ে রোকাইয়া হাসিনা নীলি ফিরে গেলেন একাত্তরের সেই কাল দিনে।
রাশীদুল হাসানকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ২২ দিন পর তাঁর মৃতদেহের খোঁজ পাওয়া গেল মিরপুরের বধ্যভূমিতে।
বাবা চলে যাওয়ার পর আমাদের সবাইকে নিয়ে মা বেগম রোকাইয়া রাশীদ বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। আমার ছোট বোন সুরাইয়া আমিনার বয়স তখন মাত্র দুই বছর আর ভাইয়া মাহমুদ হাসানের বয়স ১৪ বছর। আমি ছিলাম ভাইয়ার চেয়ে দুই বছরের ছোট, বলছিলেন রোকাইয়া।
ছেলেমেয়েদের নিয়ে চিন্তিত হওয়ার পেছনে যথেষ্ট কারণও ছিল বেগম রোকাইয়ার। কেননা এই দেশে তাঁদের নিকটাত্মীয় বলতে তেমন কেউই ছিল না।
পশ্চিম বাংলা থেকে মামা-চাচারা এলেন মাকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাঁরা বলতেন, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে কীভাবে এখানে থাকবি? মা তাঁদের সাফ জানিয়ে দিলেন, এই দেশের স্বাধীনতার জন্য ওদের বাবা প্রাণ দিলেন, এই দেশ তো আমারই দেশ। এখান থেকে কোথাও যাব না, যত কষ্টই হোক এই দেশই আমার শেষ ঠিকানা। মায়ের সেদিনের কথাগুলো বললেন রোকাইয়া হাসিনা।
বেগম রোকাইয়া মাটি কামড়ে এই দেশেই পড়ে থাকলেন সন্তানদের নিয়ে। শত কষ্টের মধ্য দিয়ে হলেও সন্তানদের বাবার আদর্শে মানুষ করতে লাগলেন।
দস্বাধীনতা যুদ্ধের পর আমাদের নিয়ে যেন মায়ের আরেকটা যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। বাবা হারানোর যে এত বড় শোক, সেটা তিনি আমাদের বুঝতেই দিতেন না। কখনো বাবাকে নিয়ে মা আমাদের সামনে কান্নাকাটি পর্যন্ত করতেন না। আমরা মাঝেমধ্যে গভীর রাতে টের পেতাম মা আমাদের পাশে নেই। খেয়াল করতাম, মা বাবার পড়ার টেবিলে বসে বাবার বইপত্র, ডায়েরি ধরে দেখতেন আর নীরবে কাঁদতেন।’ কথাগুলো বলতে বলতে মাকে নিয়ে সেই সময়ের কথাগুলো মনে করলেন রোকাইয়া হাসিনা।
বেগম রোকাইয়া সব সময় তাঁর সন্তানদের বলতেন, তোমার বাবা চাইতেন তোমরা এটা হও, ওটা হও। তিনি সন্তানদের বলতেন, তোমরা ঠিক ঠিকমতো বাবার স্বপ্ন পূরণ করো। তিনি কিন্তু তোমাদের দেখছেন! তোমরা বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে না পারলে তিনি কষ্ট পাবেন।
বাসায় একটা মুরগি রান্না হতো, আমরা সেই মুরগির মাংস দুপুরে খেতাম, রাতে খেতাম আবার সকালে নাশতার পাতেও তার কিছুটা পেতাম। এখন বুঝি, আসলে মা সেদিন না খেয়েই আমাদের খাওয়াতেন—রোকাইয়া হাসিনার কণ্ঠে আবেগের সঙ্গে শোনা যায় এই কথাগুলো।
তাঁর কথায় বেশ বোঝা যায়, কত কষ্টে সন্তানদের বড় করেছেন তিনি। বড় ছেলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে পাস করে বর্তমানে আমেরিকান দূতাবাসের প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। মেজ মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন পাশাপাশি সংগীতেও নিয়েছেন দীক্ষা। বর্তমানে তিনি প্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও ছোট মেয়েও স্নাতকোত্তর শেষ করে আমেরিকায় থাকছেন।
‘মা ছাড়া আমাদের কেউই এই পর্যায়ে আসতে পরতাম না। আমাদের এই পর্যায়ে দেখে মা সন্তুষ্ট’— বললেন রোকাইয়া হাসিনা।
তারপরও দুঃখ থেকে যায়। এখনো যুদ্ধাপরাধীদের কথা মনে হলে বেগম রোকাইয়া সেই অমানুষদের বিচার চান। তিনি মাঝেমধ্যে শঙ্কিত হন তাদের বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে। ত্যাগী মায়ের এই শঙ্কা ঘুচবে তো?
মোছাব্বের হোসেন

No comments

Powered by Blogger.