অর্থনীতি-সামাজিক ব্যবসায়ের প্রেক্ষাপট ও চ্যালেঞ্জ by বেলায়েত হোসেন

যে কোনো ব্যবসায়ের সঙ্গে সাফল্য ও ব্যর্থতা জড়িত রয়েছে। নতুন ধারণা হওয়ার কারণে প্রাথমিকভাবে এরূপ ব্যবসায় প্রত্যাশিত ফল অর্জনে ব্যর্থ হলে উদ্যোক্তারা পূর্ণোদ্যমে ব্যবসায় কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কলাকৌশল ও নীতিমালা প্রণয়নে বিভ্রান্তির সম্মুখীন হতে পারেন সামাজিক ব্যবসায় হচ্ছে মানুষের স্বার্থপরতার বিপরীত রূপ, যেখানে বিনিয়োগকারী বা উদ্যোক্তারা ব্যবসায় পরিচালনার মাধ্যমে অর্জিত মুনাফা নিজেদের স্বার্থে গ্রহণ করবেন না।


নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. ইউনূস, যিনি সামাজিক ব্যবসায়ের অন্যতম প্রবক্তা, তার মতে, দু'ভাবে সামাজিক ব্যবসায়ের কাঠামোকে সাজানো যায়। প্রথম ধারণাটি হচ্ছে, ব্যবসায়টি হবে লোকসানবিহীন, লভ্যাংশহীন উদ্যোগ, যা সামাজিক সমস্যা সমাধানের উদ্দেশে নিবেদিত থাকবে। তবে মালিকানা থাকবে বিনিয়োগকারীদের হাতে, যারা প্রতিষ্ঠানের অর্জিত মুনাফা নিজেরা ভোগ না করে নতুন কোনো সমস্যা সমাধানে আবার বিনিয়োগ করবেন। দ্বিতীয় ধারণাটি হচ্ছে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মালিকানায় পরিচালিত মুনাফাভোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করবে। তবে লক্ষ্য থাকে সামাজিক সমস্যা সমাধান।
প্রচলিত সব ব্যবসায়িক কার্যক্রম সবসময়ই মুনাফা সর্বোচ্চকরণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়ে থাকে। সুফল থাকে কেন্দ্রীভূত। কিন্তু সামাজিক ব্যবসায়ের মাধ্যমে এর সুফলকে অবহেলিত জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে বিতরণ করা সম্ভব। কারণ যারা বিনিয়োগ করবেন বা উদ্যোক্তা তারা এ থেকে লভ্যাংশ ভোগ করবেন না। তবে ব্যবসায়টি হবে মুনাফাভিত্তিক। কারা এমন ধারণায় বিনিয়োগে উৎসাহিত হবে? হতে পারে বৃহৎ করপোরেট হাউস, শিল্প প্রতিষ্ঠান, বিদেশি সাহায্য সংস্থা, দানশীল ব্যক্তি, এমনকি সরকার নিজেও।
সামাজিক ব্যবসায়ের মাধ্যমে সমাজের অবহেলিত শ্রেণীর মানুষের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে তাদের মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি করা ও বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করাও এরূপ ব্যবসায়ের অন্যতম লক্ষ্য। কেননা সমাজের অবহেলিত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে যদি প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও কর্মসূচি দেওয়া সম্ভব হয় তাহলে তারা দেশের দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত হবে। এতে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবে দেশের বেকার সমাজ। এ প্রক্রিয়ায় সমাজের অশিক্ষিত ও অল্পশিক্ষিত বেকার যুবক খুব সহজেই সম্পদে পরিণত হবেন। সমাজের যে কোনো ব্যক্তিই সামাজিক সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে পারেন। এ জন্য দরকার সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং এ সমস্যা সমাধানের একটি গ্রহণযোগ্য ব্যবসায়িক সমাধান বের করা, যার জন্য দরকার ব্যতিক্রমধর্মী ব্যবসায়িক পদ্ধতি। সুতরাং সমাজের যে কোনো ব্যক্তি, করপোরেট হাউস, বিদেশি উদ্যোক্তা, দেশীয় প্রতিষ্ঠান, ট্রাস্ট, প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপ এমনকি সরকার এবং এনজিও এ উদ্যোগে এগিয়ে আসতে পারে।
যেহেতু সামাজিক কল্যাণ সাধনই হলো সামাজিক ব্যবসায়ের মূল লক্ষ্য, তাই সমাজের কোন স্তরে কোন ধরনের সমস্যা রয়েছে তা উদ্যোক্তাদের জানতে এবং সামাজিক ব্যবসয়ের ক্ষেত্র হিসেবে সে সমস্যাগুলোকে সমাধানের জন্য সামাজিক ব্যবসায়ের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। সামাজিক ব্যবসায়ের সম্ভাব্য ক্ষেত্র হিসেবে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা যায়_
ক্ষুদ্রঋণ, শিক্ষা, খাদ্য, চিকিৎসা, স্বাস্থ্য, গৃহায়ন, প্রযুক্তি, নবায়নযোগ্য শক্তি এবং সামাজিক মঙ্গলের জন্য যে কোনো ধরনের ব্যবসায়।
যে কোনো উদ্যোগ প্রয়োগের ক্ষেত্রে উপস্থিত হয় নানা জটিল সিদ্ধান্ত। আলোচ্য ক্ষেত্রে যে চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবেলা করতে হবে তা হচ্ছে :
১. সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা উদ্যোক্তাদের একত্রীকরণ ও সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগের সঠিক ক্ষেত্র নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম সম্পাদন করতে হয়। যেমন_ জনমত জরিপ ও গবেষণা। সামাজিক ব্যবসায় নতুন ধারণা হওয়ার কারণে উদ্যোক্তাদের কোন কার্যক্রম কীভাবে সম্পাদন করতে হবে এ সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণার অভাব থাকতে পারে, যা এ ব্যবসায় গঠন ও সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে অন্তরায় হতে পারে।
২. যে কোনো ব্যবসায়ের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন সংস্থানের প্রয়োজন। যেহেতু সামাজিক ব্যবসায় একটি নতুন ধারণা, তাই যে কোনো উদ্যোক্তা এ ধরনের ব্যবসায়ে মূলধন বিনিয়োগে অনাগ্রহী হতে পারেন। সুতরাং এ ব্যবসায়ে মূলধনের জোগান নিশ্চিতকরণ ও বিনিয়োগকারীদের শনাক্তকরণ একটি চ্যালেঞ্জ।
৩. সামাজিক ব্যবসায় অর্থনীতির একটি নতুন ধারণা। তাই এ ব্যবসায়ে গৃহীত মূলধন সঠিক নীতিমালার মাধ্যমে যথাযথভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কি-না এবং এর পরিচালনা, হিসাব-নিকাশ পদ্ধতি নতুন বিনিয়োগকারী ও জনমনে অস্পষ্টতা সৃষ্টি করতে পারে।
৪. এরূপ ব্যবসায়ে মূলধন সরবরাহকারীরা যদি নিজেরাই ব্যবসায়ের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে অংশগ্রহণ করেন তবে তাদের সংশ্লিষ্ট স্বার্থ ব্যবসায়ের জন্য কতটুকু উপকারী হবে কিংবা তারা যদি ব্যবস্থাপনায় অংশ না নেন, তবে কতটুকু স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হবে, তা জনমনে প্রশ্ন তুলতে পারে।
৫. যে কোনো ব্যবসায়ের সঙ্গে সাফল্য ও ব্যর্থতা জড়িত রয়েছে। নতুন ধারণা হওয়ার কারণে প্রাথমিকভাবে এরূপ ব্যবসায় প্রত্যাশিত ফল অর্জনে ব্যর্থ হলে উদ্যোক্তারা পূর্ণোদ্যমে ব্যবসায় কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কলাকৌশল ও নীতিমালা প্রণয়নে বিভ্রান্তির সম্মুখীন হতে পারেন।
৬. একই উদ্যোক্তার অধীনে পরিচালিত সামাজিক এবং প্রচলিত ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা প্রচলিত ব্যবসাকেই বেশি গুরুত্ব দেবেন। কারণ প্রচলিত ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে তার মুনাফার স্বার্থ জড়িত থাকে, যা সামাজিক ব্যবসায়ের সম্প্রসারণ ও সাফল্যের অন্তরায় হতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, যে কোনো কনসেপ্টেরই ভালো-মন্দ উভয় দিক থাকবে। তবে দেখতে হবে ওই কনসেপ্টের প্রয়োগ দ্বারা মন্দের চেয়ে উপকার বেশি হচ্ছে কি-না। যদি উপকারের হার বেশি হয় তবে তা স্থায়ী এবং গ্রহণযোগ্য হবে।

ড. বেলায়েত হোসেন : অধ্যাপক মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
 

No comments

Powered by Blogger.