জন্মদিনের শুভেচ্ছা : আতিউর রহমান-কৃষকের বন্ধু শাইখ সিরাজ

মানুষের কর্মশক্তির বাহনযন্ত্রকে যে জাতি আয়ত্ত করতে পারেনি, সংসারে তার পরাভব অনিবার্য, যেমন অনিবার্য মানুষের কাছে পশুর পরাভব।' (রবীন্দ্রনাথ, 'সমবায়নীতি, রবীন্দ্র রচনাবলি, চতুর্দশ খণ্ড, পৃষ্ঠা : ৩২৭) বাংলাদেশের গ্রাম দ্রুতই বদলে যাচ্ছে। আজ থেকে ৩০ বছর আগে আমি কয়েকটি গ্রামে সমীক্ষা করেছিলাম। আমার পিএইচডি থিসিসের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করার লক্ষ্যে ওই সমীক্ষা চালিয়েছিলাম।


সমীক্ষার তথ্যগুলো পরবর্তী সময়ে আমার একটি বইয়েও ছাপা হয়েছিল। আশির দশকের শুরুর সেই গ্রামবাংলাকে এখন আর মনে হয় চেনাই যায় না। পুরো গ্রামে সেদিন একটিও কলের লাঙল ছিল না। থ্রেসারের তো প্রশ্নই ছিল না। সেচযন্ত্র সবে প্রাধান্য বিস্তার করতে শুরু করেছে। উচ্চ ফলনশীল ধান উৎপাদনে আগ্রহী হয়ে উঠছেন চাষিরা। বিদ্যুৎ ছিল না। আশপাশের বাজারে গাছের চারা বিক্রি হতো না। সবজির চাষ ছিল খুবই সামান্য। রপ্তানি তো দূরের কথা, স্থানীয় বাজারে বেশি পরিমাণে সবজি বিক্রি করার মতো বাণিজ্যিক বুদ্ধি কৃষকের মাথায় তখনো সেভাবে আসেনি। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে হাঁস-মুরগি ও মাছের চাষও আমার সমীক্ষায় দেখিনি। মানুষ তার দুটি হাত, পুরনো লাঙল, জোড়া বলদ নিয়েই ব্যস্ত। চাষবাসের নয়া প্রযুক্তি, নয়া ভাবনা থেকে তখনো বহুদূরে।
কিন্তু আমার গবেষণার সেই নিশ্চল গ্রাম আজ আর খুঁজে পাই না। নানা ধরনের পরিবর্তন এসেছে গ্রামে। কলের লাঙল ডজনখানেক। থ্রেসার অনেক। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে মাছ ও মুরগির চাষ করছেন অনেকেই। বিদ্যুৎ আসার কারণে অনেকের ঘরেই টেলিভিশন। বর্ষাকালে অনেক মানুষ হাট থেকে চারা কিনে বপন করে থাকেন। ক্ষুদ্রঋণের প্রসার ঘটেছে। পাশের হাটে শত শত ট্রাক আসে ধান, চাল, সবজি নেওয়ার জন্য। গ্রামের অনেক ছেলেমেয়ে এখন বিদেশে। কেউ পড়ছে, কেউ কাজ করছে। অবশ্য সবার ঘরেই আধুনিক প্রযুক্তির সাফল্য পেঁৗছেনি। দারিদ্র্য এখনো অনেকের জীবনকে বিপর্যস্ত করে রেখেছে। গ্রামীণ ক্ষমতায় নয়া বিন্যাস ঘটেছে। দুর্নীতি গ্রামেও পেঁৗছে গেছে।
একই সঙ্গে সম্ভাবনাময় ও সমস্যাসংকুল গ্রামবাংলার এই বদলে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি দারুণ সাফল্যের সঙ্গে তুলে ধরেছেন যিনি, তাঁর নাম 'শাইখ সিরাজ'। বাংলাদেশ টেলিভিশনে 'মাটি ও মানুষ' অনুষ্ঠান দিয়ে যাঁর যাত্রা শুরু। শুরুতে তিনি যে আগ্রহ, নিষ্ঠা ও উদ্যম নিয়ে অনুষ্ঠানটির সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিয়েছিলেন, পরবর্তী সময়েও এই ধারা তিনি অব্যাহত রেখেছেন। প্রাইভেট টেলিভিশন 'চ্যানেল আই'র তিনি মাত্র একজন উদ্যোক্তা পরিচালক নন; এই চ্যানেলের 'হৃদয়ে মাটি ও মানুষ' নামের অনুষ্ঠানে গ্রামবাংলার কৃষিভিত্তিক নানা উদ্যোগ ও সৃজনশীলতাকেও সক্রিয় মদদ দিয়ে চলেছেন। আমি তাঁর দুই পর্বের দুই অনুষ্ঠানেই অংশগ্রহণ করেছি। এ ছাড়া আরো অনেক অনুষ্ঠান তাঁর সঙ্গে করার সুযোগ আমার হয়েছে। সর্বশেষ 'কৃষির বাজেট কৃষকের বাজেট' বিষয়ে অনুষ্ঠান করতে কুমিল্লার এক গ্রামেও গিয়েছিলাম। আরো গিয়েছিলাম রাজবাড়ীর একটি গ্রামে। বাজেট নিয়ে সমুন্নয়ের অনুষ্ঠান ছাড়া আরো কয়েকটি অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি। গভর্নর হিসেবেও তাঁর সঙ্গে বেশ কয়টি এলাকা সফর করেছি কৃষিঋণের প্রসার ঘটানোর জন্য। সর্বত্রই তাঁর আন্তরিক সহযোগিতায় আমি মুগ্ধ।
এসব অনুষ্ঠান ছাড়াও ব্যক্তিগত যে যোগাযোগ তাঁর সঙ্গে আমার গড়ে উঠেছে, তাতে আমার দৃঢ় আস্থা জন্মেছে যে তিনি বাংলাদেশের মূল শক্তিটি কোথায়, তা ধরতে পেরেছেন। গার্মেন্টের পর কৃষিই যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি খাত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে, সে সম্ভাবনার সূত্রটি ঠিকই ধরতে পেরেছেন। একই সঙ্গে দেশের ভেতরের সবচেয়ে বেশি মূল্য সংযোজন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষমতা এই খাতেই রয়েছে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। যে কারণে কৃষি খাতের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো খুবই জরুরি। আর তাই কৃষির উন্নয়নে বেশি গবেষণা করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। আর প্রয়োজন নয়া প্রযুক্তির কৃষির কারণে জনস্বাস্থ্য যাতে বিঘি্নত না হয়, সে রকম আইনি রক্ষাকবচ। জৈবনিরাপত্তা আইনটির গুরুত্ব অসীম। পাশাপাশি প্রয়োজন কৃষির বহুমুখীকরণ। এ জন্য চাই প্রয়োজনীয় গবেষণা, সম্প্রসারণ, বাজারজাতকরণ এবং পুঁজি সমর্থন। প্রয়োজন শস্য গুদাম, বিদ্যুৎ এবং পরিবহনের। এসব কিছু করতে হলে চাই প্রয়োজনীয় নীতির সংস্কার। কৃষিতে পাশের দেশ ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম কী করছে তাও আমাদের জানতে সাহায্য করছেন শাইখ। আর সে কারণেই শাইখ সিরাজ তাঁর নতুন পর্যায়ের টেলিভিশন অনুষ্ঠান 'হৃদয়ে মাটি ও মানুষ'কে এমনভাবে সাজাচ্ছেন, যাতে নীতিনির্ধারকরা অন্য দেশের সাফল্যের ধারাটা বুঝতে পারেন। সে কারণেই তিনি ছুটে যান বিদেশের কৃষকদের কাছে। চীন, ভিয়েতনাম কী করে কৃষির উৎপাদনশীলতা এত দ্রুত বাড়াল, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন কিভাবে করল_সে সব স্বচক্ষে দেখেছেন এবং তা ক্যামেরাবন্দি করেছেন। তাঁর অনুষ্ঠানের কল্যাণে আমরাও এসব সাফল্যের কাহিনী জানতে পেরেছি। তিনি নিজে উদ্যোগ নিয়ে পরিকল্পিত উপায়ে বীজ বপনের জন্য 'ড্রাম সিডার' ভিয়েতনাম থেকে সংগ্রহ করেছেন এবং তার ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য জনমত গড়ে তুলেছেন। লিফ কালার চার্ট ব্যবহার করে জমিতে ইউরিয়া সারের ব্যবহার কী করে কমানো যায়, সে বিষয়ে জনমত গড়ে তুলেছেন।
শুধু বিদেশের সাফল্য কেন, দেশের ভেতরেও যেসব প্রযুক্তিগত সাফল্য লক্ষ করা যাচ্ছে, সেগুলোর কথাও তিনি তাঁর অনুষ্ঠানে তুলে ধরেছেন। যেমন_হরি ধানের উদ্ভাবনে এ দেশের সফল উদ্যোক্তা হরিবাবুকে শুধু টেলিভিশনের পর্দায় তুলে আনেননি, তাঁকে পুরস্কৃত করারও উদ্যোগ নিয়েছেন। এ দেশের সাধারণ মানুষ যেন কৃষি ও কৃষককে ভালোবাসেন সে জন্য রচনা প্রতিযোগিতা, কৃষকের বিশ্বকাপ নামের অনুষ্ঠানসহ নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। শাইখের বয়স বাড়ছে; কিন্তু 'হৃদয়ে মাটি ও মানুষ'-এর টানে তিনি সর্বক্ষণ গ্রামবাংলা চষে বেড়াচ্ছেন। সারা রাত গাড়িতে ভ্রমণ করে দূরে চলে যাচ্ছেন, অনুষ্ঠান রেকর্ড করে পরের রাতে ঘরে আপনজনদের কাছে ফিরছেন। সংসারের আপনজনদের বঞ্চিত করে তিনি এ দেশের কৃষকদের আপন করে নিয়েছেন। প্রতিবারই প্রাক-বাজেট পর্বে তিনি সারা দেশ ঘুরে কৃষকদের সঙ্গে বাজেট বিষয়ে আলাপ করেন, তাঁদের মতামত নেন, আমাদের এর সঙ্গে যুক্ত করেন। পুরো উদ্যোগটিই প্রশংসনীয়। একধরনের অঙ্গীকার ছাড়া এমন করে নিজেকে প্রান্তীয় মানুষের পক্ষে যে দাঁড় করানো যায় না, শাইখ সিরাজ তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। এমন নিবেদিতপ্রাণ একজন মানুষের জন্য আমরা এ দেশে ঘরে ঘরে গাছ লাগানো, ছাদে বাগান করা, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মৎস্য ও হাঁস-মুরগির খামার গড়ার আন্দোলন প্রত্যক্ষ করছি। উন্নয়ন আসলে মনের পরিবর্তন। নানা সংস্কারে আচ্ছন্ন মানুষের মনকে বদলে দিতে পারলে, মানুষকে আরেকটু আশাবাদী ও উদ্যোগী করা গেলে দেশে যে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে বাধ্য, তার প্রমাণ শাইখ সিরাজ রেখে যাচ্ছেন।
উদ্যমী এই মানুষটির পথচলাকে আরেকটু স্বস্তিময় করার জন্য তাঁকে আরেকটু নৈতিক সমর্থন ও সাহসের জোগান আমরা নিশ্চয় দিতে পারি। দীর্ঘদিন ধরে তিনি সক্রিয় থাকুন_তাঁর জন্মদিনে সেই প্রত্যাশাই করছি।

লেখক : গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক

No comments

Powered by Blogger.