হুডিনির কান্না ও বাংলাদেশ by আবু এনএম ওয়াহিদ

যারা জাদু বা ম্যাজিক জগতের খোঁজখবর রাখেন তাদের মধ্যে হ্যারি হুডিনির নাম শোনেননি এমন লোক পাওয়া দুষ্কর বৈকি। হুডিনি যখন ক্যারিয়ারের তুঙ্গে, তখন লন্ডনে এক ম্যাজিক শোতে তিনি তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হন।


ওই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ক্লান্ত হুডিনি যখন 'গোস্ট হাউস' (ঘন পর্দা দিয়ে ঘেরা ছোট্ট বুথ যেখানে হুডিনি গোপন কসরত ও কলাকৌশলের মাধ্যমে শিকল খুলতে সক্ষম হন) থেকে বেরিয়ে মঞ্চে আসেন, তখন হাজার হাজার দর্শক-শ্রোতার সামনে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। হুডিনি ম্যাজিক দেখিয়ে দর্শক-শ্রোতাদের সামনে মঞ্চে কেঁদেছেন, আর বাংলাদেশের কোটি কোটি জনগণ দেশের রাজনীতিবিদদের ম্যাজিক দেখে দর্শক গ্যলারিতে বসে হরহামেশাই কাঁদছেন। এই দুই কান্নার দুই সুর। একটি আনন্দের, আরেকটি বেদনার। বেদনার কান্নার সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ ভালোভাবেই পরিচিত। হুডিনির আনন্দের কান্নার সুর নিয়ে আজকের এই লেখা। আশা করি, পাঠক-পাঠিকারা উপভোগ করবেন।
হুডিনির ম্যাজিকের বিশেষত্ব ছিল তার সফল এবং কঠিন কঠিন 'এস্কেপ ট্রিক্স'। তাকে হাতে-পায়ে দড়ি, শিকল, ডাণ্ডাবেড়ি, চেইন দিয়ে তালাবদ্ধ করেও বন্দি রাখা যেত না। তিনি নানা জাতের কসরত ও কৌশলের সঙ্গে বন্দিদশা থেকে সহজেই মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসতেন। হাতে-পায়ে তালা দিয়ে বাক্সের ভেতর পুরে তালাবন্দি করে পানিতে ফেলেও তাকে কাবু করা যেত না। হুডিনিকে একবার হাতে-পায়ে লোহার বেড়ি পরিয়ে তালা দিয়ে সানফ্রান্সিসকো বে'তে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। তিনি ঠিকই নিজেকে মুক্ত করে সাঁতরে উঠে এসেছিলেন তীরে। যতভাবেই তাকে হ্যান্ডকাফ পরানো হোক না কেন, কোনোভাবেই তাকে আটকানোর কোনো উপায় ছিল না। তাই হুডিনিকে বলা হয় 'হ্যান্ডকাফ কিং'। এ ধরনের 'এস্কেপ ট্রিকের ম্যাজিক' দেখিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই হুডিনি ইউরোপ এবং আমেরিকার 'ম্যাজিক সম্রাটে' পরিণত হন।
১৯০৪ সালে লন্ডনের এক ম্যাজিক শোতে হুডিনি এক মারাত্মক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হন। ওই বছর ইংল্যান্ডের বার্মিংহামের এক তালাবিশারদ দীর্ঘ ৭ বছর পরিশ্রমের পর তালাসহ এক কঠিন লোহার হ্যান্ডকাফ আবিষ্কার করেন। লন্ডনের বিখ্যাত সংবাদপত্র 'দি ডেইলি মিরর' হুডিনিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় এই কঠিন হ্যান্ডকাফ থেকে মুক্ত হয়ে আসার। হুডিনি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। মার্চের ১৭ তারিখ তালাসহ হুডিনির হাতে ওই শিকল পরিয়ে দেওয়া হয় লন্ডনের হিপোড্রোম থিয়েটার হলে। সামনে উপস্থিত ছিলেন ৪ হাজার দর্শক-শ্রোতা এবং ১শ' সাংবাদিক। শিকল পরে হুডিনি তার 'গোস্ট হাউসে' গিয়ে ঢোকেন। এক ঘণ্টা পর ক্লান্ত হুডিনি হতাশ হয়ে 'গোস্ট হাউসের' বাইরে এসে বলেন, তিনি তার গায়ের জ্যাকেট খুলতে চান। তালাটা খুললে তিনি জ্যাকেট খুলবেন। তারপর আবার তালাসহ শিকল পরে নেবেন। চ্যালেঞ্জের মাঝখানে তালা খুলতে গেলে হুডিনি অযাচিত সুবিধা পেয়ে যেতে পারেন_ এই শঙ্কায় ম্যাজিক কর্তৃপক্ষ তালা খুলতে রাজি হয়নি। এমন সময় হুডিনি একটি ছোট্ট ছুরি দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে গায়ের জ্যাকেট কেটে ছিঁড়ে খুলে ফেলে দেন। তার ৫৬ মিনিট পর তার স্ত্রী বেস্ নাটকীয়ভাবে মঞ্চে উঠে হুডিনির ঠোঁটে চুমু খান। স্ত্রীর ভালোবাসা আর আশীর্বাদ নিয়ে হুডিনি আবার 'গোস্ট হাউসের' ভেতরে ঢোকেন। তারপর দীর্ঘ ১ ঘণ্টা ১০ মিনিটের কসরতের পর মুক্ত হুডিনি স্টেজে আবির্ভূত হন। দর্শক_শ্রোতাদের উচ্ছ্বাস, উল্লাস, আনন্দ আর করতালির মাঝে হুডিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। যদিও কান্নাটি ছিল আনন্দের, তথাপি ওই দিন হুডিনি দর্শক-শ্রোতাদের উদ্দেশে পরিষ্কার ভাষায় বলেছিলেন, এটা ছিল তার ম্যাজিক জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা।
তিনি ১৯২৬ সালের ৩১ অক্টোবর মাত্র ৫২ বছর বয়সে ডেট্রোয়েটের গ্রেইস হাসপাতালে মারা যান।
পৃথিবীজুড়ে আজও রয়ে গেছে হুডিনির হাজার হাজার ভক্ত। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এতই অন্ধভাবে হুডিনির বিস্ময়ে বিশ্বাসী যে, তারা মনে করেন, ফাঁকফোকর পেলে গভীর কবরের কফিন থেকে মৃত হুডিনি যে কোনো দিন জীবিত হয়ে লোকালয়ে উঠে আসবেন।
হুডিনির বিশেষত্ব ছিল তিনি কোনোদিন তার ম্যাজিকের কারিগরি কৌশল কিংবা কসরতের ওপর গুরুত্ব দিতেন না। তার সার্বক্ষণিক দৃষ্টি থাকত দর্শক-শ্রোতাদের মনস্তাত্তি্বক প্রতিক্রিয়ার ওপর। জাদুর ক্রিয়াকলাপ হুডিনির কৃতিত্ব ছিল না। বরং তার কৃতিত্ব ছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা দর্শক-শ্রোতাদের দেহ-মন এবং দৃষ্টিকে নিজের প্রতি মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকৃষ্ট করে আঠার মতো ধরে রাখা। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরাও কোনো অংশেই হুডিনির চেয়ে কম নন। তারাও বারবার দেশের লক্ষ-কোটি মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকৃষ্ট করছেন অদৃশ্য জাদুর বলেই।

আবু এনএম ওয়াহিদ : অধ্যাপক টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি
 

No comments

Powered by Blogger.