রম্য রচনা-শিশু অধিকার! by সাইফুল আলম

মার কথাটা পরিপূর্ণ জন্ম নেওয়ার আগেই কিসমিস তার বয়স্ক ঠোঁট দুটোকে প্রসারিত করে মুখের হাঁ-টাকে একটা পিংপং বলের রূপ দিল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে আমার ডান হাতটাকে ধরে তুলতে তুলতে বলল, 'চলো সামনের লেকটার ধারে যাই, তোমার মগজে খানিকটা মুক্ত হাওয়া চালান দিতে হবে।'


আমি যেন একটা রোবটের মতো তার সঙ্গে সঙ্গে অগ্রসর হতে লাগলাম। সে বলল, 'দেখো দোস্ত, এ পৃথিবীতে আমাদের চেয়েও অনেক গরিব আর অনুন্নত দেশ ছিল। যারা আজ নিজেদের কর্মে আর আন্তরিকতায় শীর্ষস্থানে জায়গা করে নিয়েছে


আমার প্রাচীন বন্ধু কিসমিস আলীকে হঠাৎ মিটিমিটি ভঙ্গিতে হাসতে দেখে আমিও যেন হঠাৎই আশ্চর্য হলাম। ধানমণ্ডি লেকের ধারে একটা বেঞ্চিতে পত্রিকা হাতে নিয়ে কিসমিস জমিদারি ভঙ্গিতে বসেছিল। আমাকে দেখেই যেন তার ওই হাসির প্রসব বেদনাটা শুরু হলো। আমি তার পাশে অবস্থান নিতে নিতে শুধালাম, 'কী বিষয় দোস্ত, তোমার এ অর্থপূর্ণ হাসির মূল অর্থটাইবা কী?' আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে সে তার হাতের পত্রিকাটা আমার পানে এগিয়ে দিল। বললাম, 'সঙ্গে তো চশমা আনিনি। পড়ব কীভাবে? তা বলোই না কী এমন তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় লিপিবদ্ধ আছে এ পত্রিকায়?'
_ 'শিশু অধিকার' কিসমিসের নিরুত্তাপ উত্তর।
_ 'ও, তাই বুঝি!'
_ 'হ্যাঁ, শিশু অধিকার নিয়ে একটা জমজমাট সেমিনারের সংবাদ প্রতিবেদন।'
_ 'ভালোই তো! শিশুদের তো তাদের পাওনা অধিকার দিতেই হবে।'
_ 'কিন্তু আমরা কি তা দিচ্ছি?' কিসমিসের চোখের তারায় যেন জিজ্ঞাসার সরীসৃপ দেখতে পেলাম। শঙ্কিত স্বরে বললাম, 'সব ক্ষেত্রে হয়তো পারছি না।'
_ 'অথচ সভা-সেমিনার, পত্রিকার প্রতিবেদন আর তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের বাণীতে আমরা তাদের জন্য চোখের জলের সাগরে আমাদের শরীরের নিম্নাঙ্গ ধুয়ে-মুছে ফেলছি।'
_ 'কিন্তু কোনো সমস্যার জন্মবৃত্তান্ত আর তার সমাধান নিয়ে সভা-সমিতি ও আলোচনা না করলে কি সঠিক পথ পাওয়া যাবে?'
_ 'তোমার যুক্তিটা আমার হৃদয়ে পথ কাটলেও সেখানে তার পদচারণার তেমন চিহ্ন পড়ল না দোস্ত।'
_ 'কেন? কেন?' আমি ত্বরিতগতিতে জানতে চাইলাম। কিসমিস এবার তার কাঁচাপাকা ভ্রু দুটোকে এক জোড়া ফড়িং দম্পতির মতো নাচিয়ে বলল, 'হ্যাঁ, আমরা তো সভা-সমিতি আর রসালো বুলি আওড়াতে মহাওস্তাদ। বাস্তবে তা প্রায়ই অশ্বডিম্ব প্রসবের মতোই হয়ে যায়।' আমি তার কথাটাকে প্রতিবাদের ঝড়ে একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার সাহস না পেয়ে নীরব রইলাম। ইতিমধ্যে আমাদের সামনে দিয়ে দু'চারজন হকার বালক ভাজা বাদাম আর মসলা-মুড়ির ব্যবসা করতে করতে চলে গেল। দু'জন রুগ্ণ পথশিশুও সাহায্যের লোভে তাদের শীর্ণ হাতের পাতা আমাদের বুকের সামনে পেতে ধরল।
আমার মনে হলো, তাদের ময়লামাখা হস্তরেখার সব চিহ্ন যেন জন্মগতভাবেই নিশ্চিহ্ন হয়ে আছে। চারদিকটা তখন আসন্ন সন্ধ্যার আমেজে ভরপুর। আমার মোহগ্রস্ত নীরবতাকে সজাগ করে কিসমিস বলল, 'দেশে শিশু অধিকারের আইন আছে জানি! কিন্তু চারপাশের অবস্থা দেখেছ?'
_ 'তা দেখেছি! কিন্তু আমাদের মতো গরিব দেশে তো আমরা পরিস্থিতির শিকার।' আমার কথাটা পরিপূর্ণ জন্ম নেওয়ার আগেই কিসমিস তার বয়স্ক ঠোঁট দুটোকে প্রসারিত করে মুখের হাঁ-টাকে একটা পিংপং বলের রূপ দিল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে আমার ডান হাতটাকে ধরে তুলতে তুলতে বলল, 'চলো সামনের লেকটার ধারে যাই, তোমার মগজে খানিকটা মুক্ত হাওয়া চালান দিতে হবে।' আমি যেন একটা রোবটের মতো তার সঙ্গে সঙ্গে অগ্রসর হতে লাগলাম। সে বলল, 'দেখো দোস্ত, এ পৃথিবীতে আমাদের চেয়েও অনেক গরিব আর অনুন্নত দেশ ছিল। যারা আজ নিজেদের কর্মে আর আন্তরিকতায় শীর্ষস্থানে জায়গা করে নিয়েছে।' আমি তাকে সমর্থন জানিয়ে ছোট্ট উত্তরে বললাম, 'তা তুমি যথার্থ বলেছ।' কিসমিস এবার সত্যি সত্যিই লেকটার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল। আমিও তার ডানপাশের সঙ্গী হলাম। সামনের আধা পরিচ্ছন্ন ধীরগামী পানির স্রোতের পানে কিঞ্চিৎ তাকিয়ে থেকে সে বলল, 'দোস্ত, দেশজুড়ে আমরা শিশু-কিশোরদের নিয়ে যেন তুমুল ব্যবসা শুরু করেছি।'
_ 'যেমন?' আমি যেন সবিস্তারে জানতে চাই।
_ 'কেন? লক্ষ্য করনি, ভিখারিনীর কোলে ভাড়া করা শিশু, কলকারখানায় অল্পমূল্যে কিশোরশ্রমিক, গৃহপালিত শিশু-কিশোর ভৃত্য, অফিসে-দোকানে কিশোর সহকারী, গ্রামের ক্ষেত-খামার আর হাটবাজারে অপ্রাপ্তবয়স্ক বাচ্চাদের নানামুখী শারীরিক ও ঝুঁকিময় পরিশ্রম। ভাবতেই যেন নিজেদের বর্বর মনে হয়।' কিসমিস কথাগুলো মুখ দিয়ে বর্ণনা করলেও মনে হলো তা যেন তার কঙ্কালসর্বস্ব বুকের খাঁচা থেকে উদ্গিরণ হচ্ছে। স্ত্রীহারা নিঃসন্তান অথচ শিশুপ্রেমী আমার এ বন্ধুটির মুখমণ্ডলের ভূগোলে আমি যেন সারাদেশের মানচিত্র দেখতে পেলাম। কিছুক্ষণ পর বললাম, 'সমস্যাটা সত্যি উদ্বেগজনক।'
_ 'হ্যাঁ, এ সমস্যাটাকে পুঁজি করে আর দরিদ্র এ বিরাট শিশুশক্তিতে কাজে লাগিয়ে দেশের কিছু অসাধু সংগঠন আন্তর্জাতিক ব্যবসা লুটে নেওয়ার চেষ্টা করছে।'
_ 'সুযোগের অসৎ ব্যবহার আর কী।' আমার কথা শেষ হতেই সে বলল, 'দেশের শিশুদের নিরাপত্তা আর অধিকার নিয়ে আমাদের মাথাওয়ালারা জমকালো সেমিনারে বক্তৃতার স্রোতে সাঁতার কাটতে কাটতে মুরগির রোস্টের ঠ্যাং চিবান। অথচ লক্ষ্য করেন না সামনের রাস্তার ধারেই অর্ধ-উলঙ্গ, ক্ষুধার্ত পথশিশুরা ওই উচ্ছিষ্ট খাবারগুলোকে চোষার জন্য আকুল আগ্রহে অপেক্ষা করছে।' কিসমিসের অন্তর্দৃষ্টি যে প্রশংসাধন্য তা আমার ভাবনায় খেলা করতে লাগল। উপযুক্ত উত্তর খোঁজার সময় না দিয়ে সে আবার বলল, 'দোস্ত একটা কথা বলি, যদিও তা আমার কল্পনাপ্রসূত।' কিসমিসের কথা রসের পেয়ালা থেকে উঁকি দিলেও তা যে তাৎপর্যপূর্ণ হবে তা আমার অজানা নয়। তাই সাগ্রহে বললাম, 'বলোই না দোস্ত, কী বলবে।' কিসমিস এবার লেকের ধার থেকে কিছুটা পশ্চাতে সরে এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, 'দোস্ত হয়তো দেখা গেল কোনো শিশুপ্রেমী কোনো শিশু সেমিনার শেষ করে বাসায় গিয়ে দেখেন, তার স্ত্রী হয়তো ঈষৎ কোনো অপরাধে তার কিশোর ভৃত্যটিকে উত্তমমধ্যম দিচ্ছেন, তখন তিনিও না জেনেই ওই ভৃত্যটির পিঠে আরও দু'চার ঘা বসিয়ে দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসার ঢালাইয়ে কিছুটা কিউরিং করলেন।' আমি কিসমিসের রসালো বর্ণনায় কিঞ্চিৎ প্রিজারভেটিভ ঢেলে বললাম, 'দোস্ত উদাহরণটা দীর্ঘদিন অন্তরে পুষে রাখার মতো। কিন্তু এ বিষয় নিয়ে তোমার আর কী মন্তব্য?'
_ 'দেখো, শিশু-কিশোরদের নিরাপত্তা আর অধিকারের সঙ্গে তাদের নৈমিত্তিক জীবনযাত্রা আর পেশা যেন যমজ দুটি সন্তানের মতোই নাড়ির বাঁধনে বাঁধা।'
_ 'তা সত্য।'
'তুমি হয়তো লক্ষ্য করেছ আমাদের দেশের অনেক কিশোর-কিশোরী আবার স্বাধীন পেশার হাত ধরে এ বয়স থেকেই জীবনের পথে পা রেখেছে।'
_'যেমন?'
_ 'যেমন, টোকাইগিরি, হকারি, রিকশা-ভ্যান চালানো, টেম্পো-বাসের হেলপার, চুরি ইত্যাদি। আর অকালেই তারা নগদ দু'দশ টাকার স্বাদ পাচ্ছে।' আমি এবার বললাম, 'হ্যাঁ, এটা শিশুদের মনোজগৎকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। জীবনের অঙ্কুরেই এসব শিশুর মনের ক্যানভাসে লোভ-লালসা আর দুর্নীতির জলরঙ চিত্রিত হচ্ছে।' আমার কথা শেষ হতেই কিসমিস তার নয়নতারা দুটোকে যেন অসীম নীলিমার কক্ষপথে ভাসিয়ে দিয়ে বলল, 'দোস্ত তোমার চিন্তাশক্তি বেশ এগিয়েছে দেখে সত্যি আমার মনে পুলক জাগছে।' আমি তার কথায় বন্ধুত্বের গাঢ় বাঁধন অনুভব করলাম। তবে মুখে প্রকাশ করলাম না। সে আবার বলল, 'গবেষকরা বলেছেন প্রাথমিক শৈশবের সামাজিক অভিজ্ঞতা শিশুর জীবনের ভিত্তিমূল গড়ে তোলে। পথশিশুদের মনে নিরাপত্তাহীনতা আর আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি দেখা যায়।'
_ 'অথচ আমরা জানি, শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ।
_ 'হ্যাঁ, উন্নত দেশে তো তা-ই ভাবা হয়।' কিসমিসের কথার শিকড় যেন অনেক গভীরে। আমি এবার বললাম, 'দোস্ত অনেক্ষণ তো দু'পায়ে ভর করে দাঁড়িয়ে আছি। এবার চলো না সামনের কোনো বেঞ্চে বসা যাক।' সে আমার প্রস্তাবটাকে ভালোবেসেই যেন সামনে এগিয়ে গিয়ে একটা বেঞ্চে আশ্রয় নিল। আমিও তাকে অনুসরণ করলাম। আমাদের আলাপচারিতাকে অগ্রগামী করার প্রয়াসে বললাম, 'দোস্ত, মানুষের শৈশব হচ্ছে আনন্দ আর আবেগের।'
_ 'হ্যাঁ, তাই তো একালটায় প্রয়োজন পর্যাপ্ত নিরাপত্তা, খেলাধুলা আর লেখাপড়ার সুযোগ, পুষ্টিকর খাদ্য আর শৃঙ্খলা। পশ্চিমা দেশগুলোতে এ বিষয়ে সরকারি মনোযোগ ছাড়াও চাইল্ড অ্যাবিউজের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা আছে।' আমি বললাম, 'তাছাড়া এসব পথকিশোর অসৎ সঙ্গীর সাহচর্যে ছোটকাল থেকেই অসামাজিক আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।'
_ 'দোস্ত, তুমি একটা বাস্তব দিককে ইঙ্গিত করেছ। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীদের মতে, এরা অকালেই নানা প্রাণঘাতী রোগের শিকার হচ্ছে। অনেক অপ্রস্ফুটিত প্রতিভা আমরা হারাচ্ছি। অথচ আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কাছিমের মতো কল্লা বের করে এদিক-ওদিক খানিকটা অবলোকন করে আবার খোলসের মধ্যে নিরাপদ আশ্রয় নিচ্ছেন।' আমি যেন বাক্যহারা হয়ে কিসমিসের মুখের পানে তাকিয়ে রইলাম। কিছুটা সময় ক্ষয় করে কিসমিস বলল, 'কী বিষয় দোস্ত, কোনো উত্তর প্রসব করছ না যে, নীরবতার ধর্মঘট পালন করছ নাকি?' আমি কিঞ্চিত লজ্জিত হয়ে বললাম, 'দোস্ত, উত্তরের ঠিকানাটা সত্যি বড্ড দূরে। তা কোনো পথের পরামর্শ কী তোমার জানা আছে?
_ 'দোস্ত, আমার পরামর্শে কার কী আসে। সবই যেন ইথারেই হাবুডুবু খাবে।' কিসমিসের কণ্ঠে যেন হতাশার ধস নামল।
_ 'তবুও তো কিছু ভাবনা থাকতে পারে।'
_ 'তা পারে।'
_ 'তবে বলোই না তোমার ভাবনার রূপরেখা'।
_ 'দেখো দোস্ত, এ সমস্যা কোনো একক সমস্যা নয়। বরং সমষ্টিগত সমস্যা। এর সঙ্গে জড়াজড়ি করে আছে জনসংখ্যা, অর্থনীতি, আইন প্রয়োগের সমস্যা আর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা।' কিসমিসের কণ্ঠে যেন এবার উত্তেজনার ধোঁয়া। আমি আমার এ বন্ধুটির উত্তেজিত বডি ল্যাঙ্গুয়েজের সঙ্গে আগেই পরিচিত। তাই ওর কথামালার সুতায় টান দিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম, 'দোস্ত, আমাকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে। বউটাকে নিয়ে ছোট শ্যালকটার কলাবাগানের বাসায় খানিকটা ভ্রমণের বাসনা আছে।'
_ 'বেশ তো। তবে আর সময় ক্ষয় না করে গৃহমুখী হও দোস্ত। আমি আরও কিছুক্ষণ এখানে কাটাব।'
_ 'বেশ, বলেই আমি উঠে দাঁড়ালাম।'

ডা. সাইফুল আলম :ডেন্টাল সার্জন, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
 

No comments

Powered by Blogger.