রংপুর এক্সপ্রেস : সান্ত্বনায় শান্ত থাকা যায় না by ড. তুহিন ওয়াদুদ

বাংলাদেশ রেল যোগাযোগের জন্য যথেষ্ট সম্ভাবনাময় একটি দেশ হলেও রেল যোগাযোগ আমাদের এখানে সব সময়ই থেকেছে অবহেলিত। বর্তমান সরকার রেলের দুর্দিনে এগিয়ে এসেছে। তার প্রমাণ মিলছে রংপুর এঙ্প্রেস চালু করার মাধ্যমে। রংপুর অঞ্চলের রেল যোগাযোগ নিয়ে দুটি গল্প প্রচলিত আছে।


একটি হচ্ছে_'এক দিন এক বৃদ্ধ মহিলা বড় একটি ঝাঁকা মাথায় নিয়ে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছিল, পাশ দিয়ে একটি ট্রেন যাচ্ছিল। ট্রেন থেকে এক তরুণ বৃদ্ধাকে লক্ষ্য করে বলছিল, দাদিমা ট্রেনে উঠে আস। দাদিমা তখন প্রতিউত্তরে বলেছিলেন, না দাদাভাই, আজ আমার একটু তাড়া আছে। ট্রেনে গেলে দেরি হবে।' রংপুরের স্থানীয় পর্যায়ের ট্রেনগুলোর করুণ অবস্থা হচ্ছে এই। দূরপাল্লার ট্রেন সম্পর্কে অন্য গল্পটি হচ্ছে_'এক দিন সকাল ১০টায় স্টেশনে গিয়ে এক যাত্রী দেখলেন যে ঠিক ১০টায় ঢাকার ট্রেন চলে এসেছে। তিনি ভীষণ অবাক হয়ে বললেন, আজ ঠিক সময়ে ট্রেনটি এসেছে! আর এক যাত্রী ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, ২৪ ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছি এই ট্রেনের জন্য। আর উনি বলছেন ঠিক সময়ে ট্রেন এসেছে! গতকালের ১০টার ট্রেন আজ ১০টায় এসেছে। আপনি টিকিট করে থাকলে আগামীকাল আসবেন।'
রংপুর থেকে একসময় তিস্তা এঙ্প্রেস এবং একতা এঙ্প্রেস ঢাকায় চলত। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে ট্রেন দুটো বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থার বেহাল অবস্থা নিরসনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ২১ আগস্ট রংপুর এঙ্প্রেস নামে একটি ট্রেন যাতায়াত শুরু করে। দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর মাধ্যমে দেশবাসী অবগত হলো, রংপুরে কোরিয়া থেকে আসা একটি ট্রেন চালু হতে যাচ্ছে। যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন উপস্থিত থেকে সেদিন যে রংপুর এঙ্প্রেসের শুভ উদ্বোধন করে গেছেন, সেই ট্রেনের ইঞ্জিনটাই শুধু কোরিয়া থেকে আসা। রংপুর অঞ্চলের মানুষ সেদিন ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে স্টেশনে গিয়ে পুরনো ট্রেনের ওপর নতুন রং করা রংপুর এঙ্প্রেস দেখে ভীষণ আশাহত হয়েছে। চালু হওয়ার পর এ পর্যন্ত এক দিনও যথাসময়ে ট্রেনটি রংপুর স্টেশন ছেড়ে যায়নি। দ্বিতীয় দিন ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়। এরপর যোগাযোগমন্ত্রীর উদ্বোধনকালে প্রাপ্ত কোরিয়ান ইঞ্জিনটির বদলে একটি লক্কড়-ঝক্কড় ইঞ্জিন দেওয়া হয়। তৃতীয় কি চতুর্থ দিন সেই ইঞ্জিন কাউনিয়া স্টেশনে গিয়ে নষ্ট হয়। রংপুর এঙ্প্রেসের সূচনালগ্নে এত সমস্যা সৃষ্টি হবে_এমনটি কেউ আশা করেনি। উলি্লখিত ঘটনাগুলো কিছু প্রত্যক্ষদর্শী আর কিছু সংবাদমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত। গত ২৭ আগস্ট রংপুর থেকে ট্রেনযোগে ঢাকা আসতে গিয়ে ব্যক্তিগত যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, সে কথা বলি। সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে ট্রেন রংপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়ার কথা। সে কারণে ৭টা ৪০ মিনিটের আগেই স্টেশনে পেঁৗছালাম। পেঁৗছেই শুনি, ট্রেন আজ তিন-চার ঘণ্টা বিলম্বে আসবে। জানতে চাইলাম, পথে কোনো সমস্যা হয়েছে কি না। কর্তৃপক্ষ বলছে, সমস্যা ছাড়াই বিলম্ব। টিকিট করতে গেলাম, এ সময় বিদ্যুৎ চলে গেল। বিদ্যুৎ না থাকলে তাঁরা টিকিট বিক্রি করতে পারেন না। কম্পিউটার চালানোর বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেই। প্লাটফর্মে ঘুটঘুটে অন্ধকার। একজন সতর্ক করে বললেন, দূরে কোথাও যেন না যাই, ছিনতাই হতে পারে। জিআরপি আছে কি না খোঁজ নিয়ে জানলাম, মাত্র দুজন করে জিআরপি ডিউটিতে থাকেন। অন্ধকারে তাঁদের খুব বেশি কিছু করার থাকে না। ওয়েটিংরুমের খোঁজ করে জানলাম, ওয়েটিংরুম থাকলেও জনবলের অভাবে তা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। অবশেষে রাত ১১টা ২০ মিনিটে রংপুর এঙ্প্রেস রংপুর ছেড়ে সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে ঢাকায় বিমানবন্দর স্টেশনে পেঁৗছায়।
আমাদের যোগাযোগব্যবস্থায় সড়কপথের পরিবর্তে রেলনির্ভর হওয়া খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। স্বল্পব্যয়ে নিরাপদ ভ্রমণের জন্য রেলের বিকল্প নেই। বর্তমানে ঢাকা-রংপুর যে রেল যোগাযোগ আছে, তার অবস্থা খুবই খারাপ। সড়কপথে ঢাকা-রংপুরের দূরত্ব প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার। আর রেলপথে এর দূরত্ব ৫৩৯ কিলোমিটার। প্রায় ২০০ কিলোমিটার বেশি। এই দূরত্বের কারণে সময় এবং অর্থ দুটোই বেশি প্রয়োজন হচ্ছে। রেল যোগাযোগের উন্নতি করতে হলে বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত রেল যোগাযোগ স্থাপন করা জরুরি। ট্রেনের সময়সূচি শক্তভাবে পালন করাও দরকার। রংপুর স্টেশনে অবিলম্বে জেনারেটর চালু করা এবং জনবল সমস্যা দূর করা প্রয়োজন। ঢাকা যাতায়াতে প্রায় ১০ থেকে ১১ ঘণ্টা সময় লাগছে। এই সময় কমানোর জন্য যে স্টেশনগুলোতে লালমণি এঙ্প্রেস এবং নীলসাগর এঙ্প্রেস দাঁড়ায় সেগুলোতে রংপুর এঙ্প্রেসের স্টপেজ বন্ধ করা প্রয়োজন। এতে সময় কিছুটা সাশ্রয় হবে। এসি-ননএসি মিলে প্রথম শ্রেণীর জন্য মাত্র ২৮টি আসন রাখা হয়েছে। এই সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। শুধু যাত্রীবাহী ট্রেন নয়, মালবাহী ট্রেনও প্রয়োজন। দেশের সব রেলপথকে মিটার গেজ অথবা ব্রডগেজ করা প্রয়োজন। যাতে রংপুরের ট্রেন অনায়াসে চট্টগ্রাম কিংবা খুলনা যাওয়া-আসা করতে পারে।
রংপুরে নতুন ট্রেন দেওয়া আবশ্যক। রংপুরের বধূ হচ্ছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রংপুরবাসী নিজেদের এলাকায় কোনো বড় নেতা কিংবা মন্ত্রী নেই বলে প্রধানমন্ত্রীর ওপর ভরসা রাখতে চান। এখন তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা মহাজোট সরকার যদি রংপুরবাসীর সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করে, তাহলে এর জবাব রংপুরবাসী ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমেই দেবে। মহজোট সরকারের অংশ জাতীয় পার্টি রংপুরের উন্নয়নে একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারত; কিন্তু সেই চেষ্টাও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টি একই সঙ্গে ক্ষমতায় থাকার পরও যদি রংপুর অঞ্চল অবহেলিত থাকে, তাহলে আর কোন সরকারের সময় রংপুরের উন্নতি হবে_সে প্রশ্নের কোনো উত্তর মেলে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং জাতীয় পার্টির কর্ণধার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যদি শুঁটকিও মাছ, চিতলও মাছ_এই যুক্তি দেখিয়ে ঘরজামাইকে শুঁটকি মাছ আর বাইরের জামাইকে চিতল মাছ খাওয়ানোর মতো পুরনো ট্রেন দিয়ে রংপুরবাসীকে সান্ত্বনা দিতে চান, তবে তার পরিণতি কখনোই শুভ ফল বয়ে
আনবে না।
লেখক : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
wadudtuhin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.