জয়, রানীর জয়! by আসিফ আহমেদ

ব্রিটিশরা শিক্ষায় এগিয়ে; অর্থনীতিতেও প্রতাপশালী। অন্য দেশকে পদানত করতে যে কূটবুদ্ধি দরকার_ সেটাও তাদের যথেষ্ট ছিল। নইলে কি আর ভারতবর্ষকে ১৯০ বছর পরাধীন রাখা যায়? তাদের একটি সহজ বিষয় বুঝতে কেন তিনশ' বছর লাগল_ সে প্রশ্ন করাই যায়। তাদের যে সিদ্ধান্তকে ঐতিহাসিক বলা হচ্ছে, সেটাই এ আলোচনার প্রসঙ্গ। ইউনাইটেড কিংডমে শিগগির পুরুষের অগ্রাধিকার সংক্রান্ত আইনটি রদ হতে চলেছে।


এর ফলে সিংহাসনে রাজার 'বড় মেয়ের চেয়ে ছোট ছেলের অগ্রাধিকারের' ধারা বদলে যাবে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন এ প্রসঙ্গে এমন একটি উদাহরণ দিয়েছেন, যাতে বিষয়টি সহজেই বোধগম্য হয়। অস্ট্রেলিয়ায় কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে তিনি বলেন, ধরা যাক, প্রিন্স উইলিয়াম এবং তার স্ত্রী কেটের একটি কন্যাসন্তান হলো। এরপর যদি পুত্রসন্তান হয়, তাহলে কন্যাটিই সিংহাসনের প্রথম দাবিদার হিসেবে ব্রিটেনের রানী হতে পারবেন। এ নিয়ম চালু হলে রানী এলিজাবেথের কন্যা প্রিন্সেস অ্যানেরও সিংহাসনে আরোহণের সম্ভাবনা যথেষ্ট উন্নত হবে। তার অবস্থান দশ থেকে উন্নীত হয়ে দাঁড়াবে চারে।
কমনওয়েলথ সম্মেলনে কেন এ প্রসঙ্গ উঠল সেটা প্রশ্ন বটে। সেখানে রানী নারীদের পূর্ণ ক্ষমতা ও সম্ভাবনা বিকাশের সুযোগ করে দেওয়ার আহ্বান জানান। কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াসহ কমনওয়েলথভুক্ত ১৬টি দেশের রানীর দায়িত্ব পালন করছেন এলিজাবেথ। ব্রিটেনের এ পরিবর্তনের কারণে তাদের দেশেও সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হবে। এ উদ্যোগের বিষয়টি কমনওয়েলথ সম্মেলনে ওঠার এটাই কারণ। অনেকে বলছেন, রানীর নাতি সদ্য বিবাহিত প্রিন্স উইলিয়াম সন্তানের পিতা হওয়ার আগেই বিধানটি বলবৎ হয়ে যাবে। ভাগ্যবান বটে এ দম্পতি!
তবে ভিন্ন প্রশ্নও তুলছেন কেউ কেউ। তাদের কথা, রাজার ছেলেকেই রাজা কিংবা মেয়েকে রানী হিসেবে সিংহাসনে বসতে হবে কেন? ব্রিটেনের রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার জন্য সর্বদাই অনেক অনেক যোগ্য নারী ও পুরুষ থাকেন। কিন্তু রাজার ছেলেমেয়েদের জন্য রাষ্ট্রপ্রধানের পদটি সংরক্ষিত রাখার মাধ্যমে তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। আরও অনেক দেশে রয়েছে এমন বিধান। সর্বত্রই এর পরিবর্তন প্রয়োজন।
তবে রাজতন্ত্র না থাকলেও অনেক দেশের রাজনীতিতে উত্তরাধিকার ব্যবস্থা জাঁকিয়ে আছে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশেই এ ব্যবস্থা যেন নিয়তির লিখন। দেশ এবং দলে দেখা যায় জনপ্রিয় নেতার পরিবারের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব। কেউ মন্ত্রী-এমপি হলে তার পরিবারের সদস্যরাও সমানে দাপট দেখাতে থাকেন। জাতীয় রাজনীতির পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়েও এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে কেউ একবার কোনো আসনে সংসদ সদস্য হলে তার সন্তানরাই সাধারণত সে আসনটির দাবিদার হয়ে থাকেন। পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদেও দেখা যায় একই চিত্র। ব্রিটিশদের মতো শিক্ষিতরা উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশে এ ধরনের ব্যবস্থাকে গণতন্ত্রের বিকাশের পথে মস্ত বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত করে। তবে তারা নীরব থাকেন যখন ব্রিটেনে রাজার ছেলে বা মেয়ের জন্য রাষ্ট্রপ্রধানের পদটি সংরক্ষিত রাখা হয়। অস্ট্রেলিয়া বা কানাডার মতো উন্নত দেশে কেন ঔপনিবেশিক শাসনের জেরের কারণে ব্রিটেনের রাজা বা রানীই রাষ্ট্রপ্রধান_ সে প্রশ্নেও তারা নীরব। যুক্তরাষ্ট্রে জর্জ বুশের ছেলে জুনিয়র বুশ রাষ্ট্রপতি হলেও তারা সে বিষয়কে রাজনীতিতে পারিবারিক উত্তরাধিকার হিসেবে দেখতে রাজি নয়। তাদের যত মাথাব্যথা শুধু একসময়ের তাদের উপনিবেশ দেশগুলোকে নিয়ে। এসব দেশের পিছিয়ে থাকার জন্য যে তাদের শোষণ-বঞ্চনা-নির্যাতনই মূলত দায়ী_ সেটাও তারা আলোচনায় নিয়ে আসতে রাজি নয়।
তারপরও বলব, বেটার লেট দ্যান নেভার। ব্রিটিশদের উপলব্ধিকে আমরা স্বাগত জানাই। তাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিশ্বব্যাপী ধন্য ধন্য পড়ে যাবে। নারী স্বাধীনতার প্রসারে রানী এলিজাবেথের অনন্য অবদান প্রশংসিত হতে থাকবে। 'উইমেন অ্যাজ এজেন্টস অব চেঞ্জের' বছরে এটা যে মস্ত পাওনা!
 

No comments

Powered by Blogger.