সংসদ বর্জনের ধারা-বিরোধী দলকে সংসদে চাই

স্বাধীনতার পর বহুবার, বহুভাবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পথযাত্রা ব্যাহত হয়েছে। অগণতান্ত্রিক ও অনির্বাচিত শাসনের বিষবাষ্প দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে থমকে দিয়েছে বারবার। গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধের সকল পদক্ষেপের বিরুদ্ধে জনগণকে পথে নেমে সহস্রকণ্ঠে প্রতিবাদ জানাতে হয়েছে সহস্রবার। এ কারণে অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করে এ দেশের ইতিহাসকে গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ইতিহাস বলেও চিহ্নিত করেন অনেকে।


গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ফসল হিসেবে দেশে সংসদীয় পদ্ধতির শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির প্রত্যাবর্তন ঘটেছে_ এ সত্যও কেউ অস্বীকার করেন না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সংসদীয় পদ্ধতির রাজনীতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর যে ভূমিকা থাকা উচিত সে ভূমিকা অধিকাংশ সময়েই পালিত হয় না। এ ক্ষেত্রে সরকার ও বিরোধী দলের ভূমিকায় পার্থক্য করার সুযোগ খুব কম। প্রধান দুটি দলের মধ্যে যারা যখন ক্ষমতায় থাকে সংসদে সরব ভূমিকা তাদেরই থাকে। সংসদ কার্যকর করার চেষ্টাও থাকে ক্ষমতাসীনদের তরফেই। অন্যদিকে বিরোধী দল নানা অজুহাতে সংসদ বর্জনকেই তাদের কর্তব্য বলে বিচার করে। বিরোধী দলের বর্জনের কারণে শাসনকার্যে সংসদের ভূমিকা খুবই সীমিত থাকে। নিয়মিত সংসদে অনুপস্থিতির মধ্য দিয়ে সরকারের কর্মকাণ্ডের গঠনমূলক সমালোচনার সুযোগ যেমন বিরোধীদলীয় সাংসদরা হারান, তেমনি জনগণকেও বঞ্চিত করেন। জনগণ সাংসদদের নির্বাচিত করেন যাতে তারা জাতীয় সংসদে গিয়ে নির্বাচনী এলাকার মানুষের কথা বলেন, তাদের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু সাংসদরা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন না করে ভোটারদের বঞ্চিত করেন। বিরোধী দলের উপস্থিতি ছাড়া সংসদ হয়ে পড়ে বিতর্কহীন, পানসে। গণতন্ত্রের জন্য সংসদের এই চেহারা কোনো অর্থেই ইতিবাচক নয়। এক-এগারোর অনির্বাচিত সরকারের শাসনকালে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কিছু উপলব্ধি এসেছিল। তারা বুঝেছিল, সংসদবিমুখ অগণতান্ত্রিক রাজনীতি, দুর্নীতি-অস্বচ্ছতা, দলের ভেতরে গণতন্ত্রহীনতার মতো কারণগুলো দেশ ও রাজনৈতিক দলগুলোর বিপর্যয়ের কারণ। এ উপলব্ধি থেকে সে সময় প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সংসদীয় ব্যবস্থা শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিল। নির্বাচনী ইশতেহারেও সংসদকেই সকল কাজের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছিল। প্রত্যাশা ছিল, নির্বাচনের পর নতুনভাবে গণতন্ত্রের পথচলা শুরু হবে। কিন্তু নবম সংসদ নির্বাচনের পর পুরনো চিত্রেরই পুনরাবৃত্তি শুরু হলো। ঠুনকো যুক্তি দেখিয়ে বিরোধী দল সংসদ বর্জন করল, সরকারও প্রত্যাশিত উদ্যোগ নিয়ে তাদের সংসদে ফেরাতে পারল না। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, জাতির নেতৃত্ব আসনে থেকে অনেক নেতাই তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করছেন না বটে, দায়িত্ব পালনের জন্য প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা ঠিকই ভোগ করছেন। কেউ-ই হয়তো বলবেন না যে সংসদ বর্জনের সঙ্গে সঙ্গে প্রাপ্য সুবিধাও বর্জন করুন। কিন্তু সকলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির সংসদে দেখতে চায়। সমাজে যেসব আলোচনা হচ্ছে, যে তর্ক-বিতর্কে চায়ের আসর উষ্ণ হয়ে উঠছে, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ যেসব বিষয়ে ঐকমত্যের প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে সেসব বিষয় সংসদে উঠবে না কেন? বিরোধী দলের দাবি-দাওয়া আদায়ের পথ সংসদে থাকবে না কেন? সংসদ সদস্যরা কেন মানুষের কথার প্রতিধ্বনি করবেন না? এ কথা সত্য, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ভিত এখনও এ দেশে পোক্ত নয়। সমাজের সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক রীতিপদ্ধতি অনুসারে কাজ হয় না। রাষ্ট্রের গণতন্ত্রের সঙ্গে দরকার গণমাধ্যমের স্বাধীন ও সাহসী ভূমিকা, নাগরিক প্রতিষ্ঠান, স্বাধীন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। সর্বোপরি সমাজের সর্বস্তরে গণতন্ত্রায়ন দরকার। সে পথে আমাদের অভিযাত্রা চলছে। কিন্তু গণতন্ত্রের মূলশক্তি যে রাজনৈতিক দল, তারা গণতন্ত্র ও সংসদবিমুখ থাকলে দ্রুত সাফল্য আসবে না। তাই বিরোধী দলকে সংসদে দেখতে চাই আমরা। সরকারের ইতিবাচক ভূমিকাও চাই। নবম সংসদের বিগত সময়টা ভালো যায়নি, কিন্তু সামনের সময়টা ভালো যাবে, সেটিই প্রত্যাশিত।

No comments

Powered by Blogger.