ছোট ছোট বেতার এবং পূর্ণাঙ্গ বেতার বাংলা-ব্রিটেন by ফারুক যোশী

বাংলা পত্রিকাগুলোও আগের চেয়ে অনেক বেশি কমিউনিটি সম্পর্কিত খবর শিরোনাম হিসেবে তুলে আনছে তাদের রিপোর্টিংয়ে। যেহেতু বাঙালি কমিউনিটি এখানে সুদৃঢ় ভিত্তি গেড়েছে, সেহেতু সব গণমাধ্যমেই বাঙালিদের একটা পূর্ণাঙ্গিক অবস্থান অনেকটা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে, এটা বলতেই হয়\' বাংলা টিভি চ্যানেলগুলো যখন বাঙালি কমিউনিটিতে ছিল না, তখন আজকের মতোই ছিল বাংলা পত্রিকাগুলো।


পত্রিকাগুলোর খুব ভালো অবস্থান না থাকলেও দু'একটি পত্রিকা তবুও ছিল ব্যবসাসফল। অন্তত এই কাগজগুলো থেকে দেশের খবর, কমিউনিটির খবর উঠে আসত, সপ্তাহ শেষে হলেও যেন তাজা খবর পেত কমিউনিটির পাঠক। অন্তত বাংলায় তো তারা তাদের দেশ পেতেন, পেতেন কমিউনিটিকে।
ঠিক এভাবেই আরেকটি মাধ্যম নব্বইয়ের দশকের শুরুতে মোটামুটি বাঙালি কমিউনিটিতে প্রচার পেয়েছিল, তা হলো রেডিও। এক সময় স্পেকট্রাম রেডিও থেকে সাংবাদিক শফিক রেহমান বাংলা প্রোগ্রাম করতেন। তার রেডিও প্রোগ্রাম বাঙালি কমিউনিটিতে একটি প্রভাবও ফেলে, কিন্তু তা বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। প্রায় একই সময়ে লন্ডনকেন্দ্রিক আরেকটি রেডিও প্রচার শুরু করে, সানরাইজ রেডিও। সপ্তাহে দু'রাত দু'ঘণ্টার অনুষ্ঠান বিভিন্নভাবে সাজানোর চেষ্টা করেছেন আয়োজকরা সে সময়। লন্ডনে একটি জনপ্রিয় রেডিও মাধ্যম হিসেবে সানরাইজ রেডিও বাঙালি কমিউনিটিতে সাড়া জাগায়। সেই সময় থেকেই লন্ডনে একটি পূর্ণাঙ্গিক রেডিও অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টার রেডিওর প্রয়োজনীয়তা অনেককেই ভাবিয়েছে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই এত বড় বিনিয়োগের দিকে কেউই এগিয়ে আসতে সাহস করেনি। তারপরও রেডিওর প্রচার কিন্তু থেমে থাকেনি। সারা ইংল্যান্ডেরই কোনো না কোনো শহরে বাংলাভাষী রেডিও ছোট্ট পরিসরে হলেও প্রচারিত হয়েছে। সে হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে বার্মিংহাম বিবিসি রেডিওর কথা। দীর্ঘদিন থেকে বাংলা ভাষায় প্রচারিত হচ্ছে এ রেডিও। মূলত মাত্র দু'ঘণ্টার স্লট নিয়ে চালাচ্ছেন তারা তাদের কার্যক্রম। যদিও মাত্র ৩০ মিনিটের স্লট নিয়ে বিবিসির এ প্রোগ্রাম শুরু হয়েছিল আজ থেকে ২১ বছর আগে বার্মিংহামে ১৯৮৯ সালের ২ নভেম্বর ফরিদা বেগের উপস্থাপনায়। ধারণা করা হয়, ছোট্ট পরিসরে হলেও এটিই কমিউনিটির জন্য প্রথম বাংলা প্রোগ্রাম। এ ছাড়া লন্ডনের বুশ হাউস থেকে প্রচারিত বিবিসি বাংলা বিভাগ যদিও মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান প্রচার করে এবং তা যুগ যুগ থেকে। খুব স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বের ৩২টি ভাষায় প্রচারিত হওয়া বিভিন্ন প্রোগ্রামের একটি অনুষ্ঠান বিবিসি বাংলা। তারা বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে, বিশেষত সাউথ ইস্ট এশিয়ার বাঙালি শ্রোতাদের জন্য প্রচার করে তাদের বাংলা অনুষ্ঠান। নিঃসন্দেহে বিশাল বাজেটের এ অনুষ্ঠানগুলো ভালোই হয়। স্বাভাবিকভাবেই বলতে হয়, বাংলাদেশে কিংবা অন্যান্য দেশের প্রতি ব্রিটেনের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও এ অনুষ্ঠানগুলোতে ফুটে উঠতে সাহায্য করে। এতে ব্রিটেনের বাঙালি কমিউনিটি প্রতিফলিত কিংবা বিম্বিত হয় না। কারণ এটা মূলত বাংলাদেশের জাতীয় ইস্যুকেই গুরুত্ব দিয়ে থাকে। খুব স্বাভাবিকভাবেই বিশাল বাজেটের বিবিসি বাংলা ব্রিটেনের বাঙালি কমিউনিটির জন্য মূলত কিছুই করতে পারছে না।
এখন সময় বদলে গেছে। ব্রিটেনের বাঙালি কমিউনিটিতে এসেছে এক ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সর্বক্ষেত্রেই। মেধাবী তারুণ্য জায়গা করে নিচ্ছে চাকরির উচ্চাসনে, রাজনীতির মূলধারায়। কমিউনিটি এমন অবস্থানে দাঁড়িয়ে গেছে যে, কমিউনিটিকে কেন্দ্র করে প্রচারিত হয় ছয়টি টিভি চ্যানেল, লন্ডন থেকে প্রকাশিত হচ্ছে ১৪টি বাংলা পত্রিকা, বার্মিংহাম থেকে প্রকাশিত হয় একটি এবং গ্রেটার ম্যানচেস্টার থেকে প্রকাশিত হয় নিয়মিত আরও দুটি পত্রিকা। টিভি চ্যানেলগুলোর মাঝে দুটি সরাসরি লন্ডন থেকেই বাঙালি কমিউনিটির জন্য ইংল্যান্ডে ও ইউরোপে তাদের অনুষ্ঠান প্রচার করে। অন্যদিকে চারটি চ্যানেলের সবক'টিতেই বাংলাদেশের সরাসরি অনুষ্ঠান দেখানো হলেও বাঙালি কমিউনিটির জন্য কিছু কিছু অনুষ্ঠান তারা নিজেরাই তৈরি করছেন। যেমন তারা টক শো করে কমিউনিটির বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে, কমিউনিটির খবর প্রচার করেন। অর্থাৎ কমিউনিটিকে মূলত ফোকাস করার একটা দায়িত্ববোধ থেকেই ব্রিটেন কিংবা ইউরোপের বাঙালিদের জন্য চ্যানেলগুলো স্লট তৈরি করেছে। বাংলা পত্রিকাগুলোও আগের চেয়ে অনেক বেশি কমিউনিটি সম্পর্কিত খবর শিরোনাম হিসেবে তুলে আনছে তাদের রিপোর্টিংয়ে। যেহেতু বাঙালি কমিউনিটি এখানে সুদৃঢ় ভিত্তি গেড়েছে, সেহেতু সব গণমাধ্যমেই বাঙালিদের একটা পূর্ণাঙ্গিক অবস্থান অনেকটা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে, এটা বলতেই হয়।
সে হিসেবে রেডিওটা এখনও পিছিয়ে। কারণ একমাত্র বেতার বাংলা গত বছর থেকে শুরু করেছে ২৪ ঘণ্টার অনুষ্ঠান। একটা বড় ধরনের সাহস, এটা বলতেই হয়। প্রত্যেকটি গণমাধ্যমই টিকে থাকে মূলত শ্রোতা-দর্শক-সমর্থক-পাঠক সর্বোপরি বিজ্ঞাপনদাতাদের ওপর। সে হিসেবে গণমাধ্যমকে সময়োপযোগী করার দায়িত্বও থাকে আয়োজক-প্রযোজক কিংবা পরিচালকদের। বেতার বাংলায় অসংখ্য কলাকুশলী-প্রেজেন্টার এখন আছেন, বলতে গেলে প্রায় সবাই ভলান্টারি কাজ করেন। মূলত সমাজ-সংস্কৃতি তথা বাঙালিত্বের প্রতি একটা দায়বোধ থেকেই তারা তাদের প্রাত্যহিক জীবনের একটা নির্ধারিত মূল্যবান সময় ব্যয় করেন বেতার বাংলার বিভিন্ন অনুষ্ঠান সাজানোর কাজে। তবে এন্টারটেইন কিংবা লাইভ ফোন-ইন প্রোগ্রাম করতে গিয়ে তাদের কিছু বাজে অভিজ্ঞতার কথাও বলেছেন দু'একজন উপস্থাপক। মজা করতে গিয়ে কিছু শ্রোতা লাগাম হারিয়ে ফেলে। অবশ্য এ রকম নাজুক অবস্থায় পড়তে হয় বিভিন্ন জায়গায়। দেখা গেছে বাংলাদেশেরও রেডিও-টিভি অনুষ্ঠানে এ রকম হয়ে থাকে। কারণ রুচিহীন কিছু মানুষ সবসময়ই সুস্থ ধারার বিপরীতে অবস্থান করে। যদিও তাদের সংখ্যা বেশি নয়। এরপরও একজন উপস্থাপক বলেছেন_ কষ্ট হয়, তবু অধিকাংশ মানুষের ভালোবাসাটাই তারা দেখেন এসব অনুষ্ঠানে।
সব মিলিয়ে লন্ডনের বাঙালিদের জন্য বেতার বাংলার ২৪ ঘণ্টার একটি নতুন মাধ্যম হিসেবে আত্মপ্রকাশ নিঃসন্দেহে একটা বড় ব্যাপার। টিভি দেখার জন্য ঘরে বসে থাকতে হয়। কিন্তু রেডিওর সুবিধাটা অন্য জায়গায়। একটা বিশাল জনগোষ্ঠী, যারা গাড়ি চালান, সরাসরি রেডিওর সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা। সে জন্যই হয়তো বেতার বাংলার শ্রোতাদেরও একটা বড় অংশ আছে গাড়ির চালক কিংবা আরোহীরা। রেডিও ফাইভ লাইভ শোনেন ব্রিটেনের অগণিত মানুষ। আমরা ধরে নিতে পারি বেতার বাংলা লন্ডনে বাঙালিদের সে রকমেরই একটা গণমাধ্যম হবে। এ মাধ্যম হবে বাঙালিদের জীবনধারার একটি অংশ, হতে পারে এন্টারটেইনমেন্টের একটি অংশ। আমাদের প্রত্যাশা, গত এক বছরের ধারাবাহিকতায় বেতার বাংলায় উঠে আসবে বাঙালি জীবনপ্রবাহ। নতুন প্রজন্মের প্রতিদিনের পথচলায় বেতার বাংলা প্রেরণা জোগাবে তাদের অভিভাবকদের। বেতার বাংলায় আরও বেশি করে উঠে আসবে মূলধারার রাজনীতিতে আরও নতুন মুখ যোগ হওয়ার উদাত্ত আহ্বান নিয়ে। বিভিন্ন সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়ে বেতার বাংলা চালিয়ে যাবে তার ধারাবাহিকতা, এ আশাবাদ আমরা রাখতেই পারি। রাত-দিনের বিভিন্ন সময়ে, সারাদিনের ক্লান্তি শেষে বেতার বাংলা হতে পারে লন্ডনের বাঙালিদের একটি মাধ্যম। হতে পারে মৌলবাদের বিরুদ্ধে একটি সম্মিলিত দৃঢ়কণ্ঠ। একাত্তরের চেতনা নিয়ে এভাবেই বেতার বাংলা হয়ে উঠুক লন্ডনের বাঙালি জনগোষ্ঠীর অন্যতম গণমাধ্যম, এ প্রত্যাশার প্রতিধ্বনি বাজুক আমার মতো সব বাঙালির মাঝে।

ফারুক যোশী : লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক
faruk.joshi@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.