কল্পকথার গল্প-উথলি টু পাটুরিয়া ।। ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ... by আলী হাবিব

ময় বদলে গেছে। মানুষ এখন অনেক আধুনিক। পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে মানুষ। সময়কে বদলে দিয়েছে গতি। সভ্যতাকে বদলে দিয়েছে বাহন। সেই কবে পায়ে ঠেলা বাইক এসেছিল। এর পর থেকে দুই চাকার বাইক বা বাইসাইকেল এখনো আমাদের সভ্যতায় টিকে আছে। একটা সময় ছিল, যখন এই দুই চাকার বাহনটিই ছিল একটি পরিবারের আভিজাত্যের নিদর্শন। এখন হয়তো একটি বাইসাইকেল কোনো ব্যক্তি বা পরিবারের দারিদ্র্যের নিদর্শন হিসেবেই বিবেচিত হয়।

মোটরগাড়িই এখন আভিজাত্যের নিদর্শন হিসেবে পরিচিত। লেটেস্ট মডেলের গাড়ি বা গাড়ির দামের ওপরই এখন নির্ভর করে আভিজাত্যের ব্যারোমিটার। এই মোটরগাড়ির ইতিহাসও বেশ পুরনো। আজকের দিনে আধুনিক যে মোটরগাড়ি আমরা দেখতে পাই, সে মোটরগাড়িও আজকের মডেল পেয়েছে অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। তবে মানুষের জীবনে গতি এনে দেয় বাইসাইকেল। আগের দিনে মানুষকে ঘোড়ায় চড়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে হতো। সেই আমলে রাজারা ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধে বা মৃগয়ায় যেতেন।
দুই চাকার সাইকেল যখন মানুষের জীবনে গতি এনে দিল, তখন আর থেমে থাকা কেন? দুই চাকাতেই বা আটকে থাকা কেন? দুই চাকার জায়গায় এল চার চাকা ও তিন চাকার বাহন। এই বাহন এখন মানুষের জীবনে একেবারে অপরিহার্য। যানবাহনের সঙ্গে সঙ্গে আজকের দিনে মানুষ আরেকটা বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। যানজট। বিশেষ করে ঢাকা শহরে যাঁদের বাস, তাঁরা জানেন যানজট কত প্রকার ও কী কী। পৌরাণিক আমলে যানজটের বালাই ছিল না। সে আমলটা ছিল রথের আমল। পৌরাণিক আমলের বাহন রথে চড়ে এখান থেকে সেখানে যাওয়া যেত। এ রকম এক রথ ছিল কুবেরের। পুষ্পক রথ। তপস্যা করে ব্রহ্মাকে তুষ্ট করেছিলেন কুবের। ব্রহ্মা তাঁকে অপূর্ব এই পুষ্পক রথ দান করেছিলেন। আজকের দিনে আমরা যে সুপারসনিক গতির বাহন বা উড়োজাহাজের কথা শুনি, ধারণা করা যায়, পুষ্পক রথ তার চেয়েও গতিশীল ছিল। বলা যেতে পারে, এটাই ছিল সেই পৌরাণিক আমলের বিমান। তবে তাতে পাইলট, রাডার ইত্যাদি কোনো কিছুরই প্রয়োজন হতো না। রথের আরোহীদের ইচ্ছা অনুযায়ী চলত রথ। আজকের দিনে মোটরগাড়ির ডিজাইন করা হয়। এই পুষ্পক রথের ডিজাইনার ছিলেন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা। এই পুষ্পক রথ দখল করে নিয়েছিলেন রাবণ। রাম-রাবণের যুদ্ধে রাবণ পরাজিত হলে পুষ্পক রথ ফেরত পান কুবের। আধুনিক যুগে আমরা সুপারসনিক গতি অর্জন করতে পেরেছি। সুপারসনিক গতির একটি গাড়ি নিয়ে ওয়ার্ল্ড মোটর স্পোর্টস কাউন্সিল জানিয়েছে, রিচার্ড নোবেল ও তাঁর দলের সদস্যদের ডিজাইন করা থ্রাস্ট এসএসসি নামের গাড়িটি সুপারসনিক গতির। গাড়িটি চালিয়েছিলেন অ্যান্ডি গ্রিন, যিনি ছিলেন রাজকীয় ব্রিটিশ এয়ারফোর্সের একজন স্কোয়াড্রন লিডার। ১৯৯৭ সালের ১৫ অক্টোবর চালানো হয় গাড়িটি। গাড়িটির গতি ছিল ঘণ্টায় প্রায় ৭৬৩ মাইল। এ ছাড়াও আছে সুপারসনিক বিমান। রকেটের কথা না হয় বাদই দিলাম। এই সুপারসনিক গাড়ির কথা নিয়ে ভাবনা একটিমাত্র কারণে। সেটা হচ্ছে, ফি-বছর ঈদে বাড়িতে যাওয়া। ঈদের ছুটিতে বাড়িতে যাওয়ার মতো বিড়ম্বনা আর দ্বিতীয়টি নেই। পথে যানজটে পড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকা। ফেরিঘাটে জ্যাম। মহাসড়কে জ্যাম। জ্যাম শব্দটি যেন আমাদের জীবনের সঙ্গে বেশ চমৎকারভাবে জড়িয়ে গেছে। এমনিতেই রাজধানী ঢাকা মহানগরীতে যানজটে পড়ে আমাদের প্রতিদিনের কত কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে তার হিসাব নেই। কত সময়ের পথ আমরা কত সময়ে পেরোচ্ছি, সে হিসাব আমাদের কারো কাছে নেই। যানজটের পাশাপাশি মহাসড়কে চলতে গিয়েও যেন জ্যামের বিষয়টা আমাদের মাথায় থাকে।
এবারের ঈদের ছুটিতে বাড়িতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা পাঠকদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়া যাক। সপরিবারে ঈদের ছুটিতে বাড়িতে রওনা হলাম ঈদের আগের দিন সকালে। সকাল ১০টায় গাবতলী থেকে বাস ছাড়ল। চমৎকার রাস্তা। ঢাকা ছেড়ে সাভার ঢোকার আগেই বাসযাত্রীরা মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে নিলেন একটি জ্যামের। ঈদের সময় সাভারের জ্যাম নৈমিত্তিক ব্যাপার। না, জ্যামে আটকে থাকতে হলো না। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, নবীনগরেও বাস আটকে থাকল না। অথচ প্রতিবছর এখানে জ্যামে আটকে ঘণ্টাখানেক সময় নষ্ট হয়। ঈদযাত্রীদের এবার আর সে অভিজ্ঞতা হলো না। সবাই উৎফুল্ল। ঈদের আগে শেষ কবে এভাবে নির্বিঘ্নে সাভার ও নবীনগর পার হয়েছেন, সেটাই তখন বাসযাত্রীদের আলোচনার বিষয়। ধন্য ধন্য পড়ে গেল। না, মানিকগঞ্জেও কোনো জ্যাম ছিল না। মানিকগঞ্জ, ত্বরা ঘাট পেরিয়ে যেতে কোনো অসুবিধাই হলো না। অনেকে মোবাইল ফোনে প্রিয়জনদের জানিয়ে দিলেন, ইফতারের অনেক আগেই তাঁরা বাড়িতে পেঁৗছে যাবেন। প্রিয়জনদের সঙ্গে ইফতার করবেন। কিন্তু বিধি বাম। ঢাকা-আরিচা বা ঢাকা-পাটুরিয়া সড়কে উথলি নামে একটি জায়গা আছে। উথলির মোড় সবারই চেনা। এখান থেকে রাস্তাটা বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে পাটুরিয়া ঘাটের দিকে গেছে। এই উথলির মোড় পেরিয়ে পাটুরিয়ার সংযোগ-সড়কে ঢুকতেই থেমে গেল গাড়ির চাকা। না, ভাঙা রাস্তায় গাড়ি আটকে যায়নি। চমৎকার মসৃণ রাস্তা। কিন্তু গাড়ি আর এগোচ্ছে না। গাড়ি সামনের দিকে একটুও যাচ্ছে না। কেন? জ্যাম। উথলির মোড় থেকে পাটুরিয়ার দূরত্ব মাত্র ছয় কিলোমিটার। সকাল ১০টায় ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া বাস দুপুর পৌনে ১২টায় উথলি মোড় পেরিয়ে সেই যে থামল, এরপর আর তার এগোনোর নাম নেই। ভুল বলা হলো। ওই যে সুকুমার রায়ের ছড়ায় আছে, 'তিন পা যেতে দুবার থামে'_অনেকটা সে রকমই ব্যাপারটা দাঁড়াল। বাস একটু একটু করে এগোয়, থেমে যায়। বাংলায় শম্বুকগতি বলে একটা ব্যাপার আছে। না, সেটা বললে সবটুকু বলা হবে না। শামুকের গতিও বোধ হয় এর চেয়ে অনেক বেশি। তবে কি পিঁপড়ার গতি? না, তা-ও নয়। একটা কালো পিঁপড়া ঘণ্টায় দুই মাইল বা প্রায় তিন কিলোমিটার পথ চলতে পারে। সে হিসাবে উথলির মোড় থেকে পাটুরিয়া ফেরিঘাট পর্যন্ত যেতে একটি পিঁপড়ার ঘণ্টাতিনেক লাগার কথা। কোচটি যখন পাটুরিয়া ফেরিঘাটে গিয়ে ফেরির অপেক্ষায় সিরিয়ালে কিউ দিল, আমাদের ঘড়িতে তখন বিকেল ৫টা। সাড়ে ৫টায় ফেরিতে ওঠার পর মনে হলো, এবার বাড়িতে যাওয়া যাবে।
সোয়া পাঁচ ঘণ্টায় উথলির মোড় থেকে পাটুরিয়া ঘাটে পেঁৗছানোর পর মনে পড়ে গেল পুরনো এক পুঁথির কথা। সে আমলে অনেকটা আসর জমিয়ে পুঁথিপাঠ হতো, নিরক্ষর পুঁথি পাঠকরা অন্যের পাঠ শুনে নিজেদের মতো করে সুরে সুরে পুঁথি পাঠ করতেন। ফলে অনেক সময় পুঁথির মূল বিষয় পাল্টে যেত। কেমন করে? উদাহরণ দেওয়া যাক। পুঁথিতে হয়তো লেখা আছে, '...ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁকিয়া চলিল/ছয় মাসের পথ মর্দ ছয় দিনে গেল...।' কিন্তু শুনে মুখস্থ করা পুঁথি পাঠক হয়তো পড়ছেন এভাবে, '... ঘোড়ায়ও চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল/ছয়ও দিনের পথও মর্দ ছয়ও মাসে গেল...।' ঈদের আগের দিন উথলি থেকে পাটুরিয়া যেতে যখন সোয়া পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগল, তখন ওই নিরক্ষর পাঠকের পুঁথিই যেন সত্য হয়ে গেল। অন্তত ওই দিনের বাসযাত্রীদের জন্য যেন এটাই সত্য। অথচ আগের দিন পর্যন্ত টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকার খবরে আমরা দেখেছি, ঘাটে কোনো জ্যাম নেই। জ্যাম নেই রাস্তায়, পরিচিতজন, যাঁরা এক দিন বা দুদিন আগে বাড়িতে গেছেন, তাঁরাও শুকরিয়া আদায় করেছেন। উৎফুল্লচিত্তে জানিয়েছেন, অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে তাঁরা নির্দিষ্ট সময়েই বাড়িতে পেঁৗছে যেতে পেরেছেন। কিন্তু ঈদের আগের দিন আবার সেই পুরনো চেহারায় ফিরে যাওয়া কেন? এক রাতে কেমন করে আবার সেই আগের চেহারা ফিরে পেল পাটুরিয়া সড়ক?
একটা নির্মল গল্প বলা যাক। ফরিদপুর শহরের ঐতিহ্যবাহী ও একসময়ের অভিজাত সিনেমা হল অরোরা টকিজ। আজকের নাম ছায়াবাণী। এই ছায়াবাণী সিনেমা হলের ম্যানেজার ছিলেন ভুলু বাবু। তাঁর আসল নাম কারো জানা নেই। তিনি ভুলু বাবু নামেই পরিচিত ছিলেন। সেই আমলে যখন জেনারেটরের প্রচলন এতটা ছিল না, তখন বিদ্যুৎ চলে গেলেই সিনেমা বন্ধ হয়ে যেত। আর পর্দায় ভেসে উঠত একটা লাইন, 'বিদ্যুৎ বিভ্রাটের জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নহে।' কিন্তু দর্শকদের রুখবে কে। বেরসিক বিদ্যুতেরও কোনো সময়জ্ঞান ছিল না। হয়তো নায়ক-নায়িকার কোনো প্রেমঘন রোমান্টিক দৃশ্যের সময় কিংবা নায়ক যখন ভিলেনকে বেধড়ক পেটাচ্ছে, তেমন উত্তেজনার সময় বিদ্যুৎ চলে যেত। ওই উত্তেজনা ছড়িয়ে যেত দর্শকদের মধ্যে। দর্শকরা ভুলু বাবুর চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে গালাগাল করতেন। কেউ কেউ ভুলু বাবুর কক্ষে পায়ের জুতো নিক্ষেপ করতেও দ্বিধা করতেন না। ব্যাপারটা এমন যেন বিদ্যুৎ যাওয়ার জন্য ভুলু বাবু দায়ী। যেন তাঁর নির্দেশেই লোডশেডিং হয়। ব্যাপারটা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল। কয়েক দিন পর লোডশেডিংয়ের সময় সিনেমা হলের পর্দায় দেখা গেল, 'বিদ্যুৎ বিভ্রাটের জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নহে' লেখাটির বদলে ফুটে উঠেছে নতুন একটি বাক্য_'বিদ্যুৎ বিভ্রাটের জন্য ভুলু বাবু দায়ী নহে।'
ঈদের আগের দিন উথলি টু পাটুরিয়া, ছয় কিলোমিটার পথে সোয়া পাঁচ ঘণ্টার জ্যামের নেপথ্যে কোনো বাবু কি দায়ী, নাকি দায়ী আমাদের ললাট লিখন_সেটা যদি জানা যেত!
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.