দাহকালের কথা-দীর্ঘশ্বাসের গল্প অথবা আইসিইউ by মাহমুদুজ্জামান বাবু

রিশালের এ ওয়াহেদ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের সামনের সড়কটি ঢাকা-বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক। অনবরত দ্রুতগামী দূরপাল্লার বাস-ট্রাক ছুটে চলে এই পথে। খুব যে প্রশস্ত পথটি, তা নয়। তবুও এটি মহাসড়ক। এই মহাসড়কের পাশেই বাস-ট্রাক চলাচলের প্রবল বাতাসি ঝাপটা উপেক্ষা করে এ ওয়াহেদ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রায় সাড়ে ছয় শ ছাত্রী আর স্কুলের সব শিক্ষক-শিক্ষিকা দাঁড়িয়েছেন প্রতিবাদী মানববন্ধনে। দিনটি ২৯ নভেম্বর।


চার দিন আগে এই স্কুলের শিক্ষক, যিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধা, যিনি বীর, যিনি ছাত্রীদের প্রিয় ‘গণিত স্যার’, যিনি ছাত্রীদের ডাকতেন ‘মা’ বলে, যিনি পরিচিত ছিলেন ‘বাবা স্যার’ নামে...তাঁকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে ঠিক এই জায়গাতেই। কারণ, তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন ইভ টিজিংয়ের। তাঁর নিজের কলেজপড়ুয়া মেয়ের নিরাপত্তার জন্য থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন। ঘটনার দিন বাড়ি ফিরছিলেন সন্ধ্যায়, হাতে গৃহস্থালি জিনিসপত্র, বাড়িতে অপেক্ষমাণ স্ত্রী ও মেয়ে, কিন্তু ‘বাবা স্যার’ আর ফিরতে পারলেন না। নিরাপত্তাহীনতার রাষ্ট্র এই সময়ের বাংলাদেশ, একজন মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষক মো. জিন্নাত আলীকে বাড়ি ফিরতে দিল না আর।
২৯ নভেম্বর বেলা ১১টার ওই মানববন্ধনের কাছে গিয়ে দাঁড়ানো ছিল অসম্ভব একটি কাজ। ইউনিফর্ম পরা শত শত ছাত্রী ক্রোধে ও বিক্ষোভে চিৎকার করছে। শিক্ষকদের চোখ-মুখ গনগনে আগুনের তাপে ঝলসানো যেন। আমরা কয়েকজন সংহতি জানাতে কাছে গিয়ে দাঁড়াই। ছাত্রীদের একটি দল মানববন্ধনের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত মিছিল-স্লোগানে হাঁটছিল। আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল দশম শ্রেণীর ছাত্রী আঁখি। তার দুই চোখে ক্ষোভ আর কান্নার মিশেল। আঁখি বলছিল, ‘আমাদের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলেই স্পোর্টস শুরু হওয়ার কথা ছিল। স্যার সবকিছু করতেন। সবকিছু সাজাতেন। এখন কী হবে?’...হঠাৎ আঁখির কথা অসংলগ্ন হয়ে পড়ে। আঁখির পাশে চলে আসে ফারিয়া ও শায়লাসহ কয়েকজন এসএসসি পরীক্ষার্থী। আঁখি চিৎকার করে ওঠে, ‘ফাঁসি চাই। ফাঁসি দিতে হবে রূপমকে। এখনি দিতে হবে।’ তারপর আঁখিরা কিশোরী কণ্ঠে চিৎকার করতে থাকে। তারপর জিন্নাত আলী স্যারের প্রিয় ছাত্রীরা মহাসড়কের পাশে দাঁড়িয়ে গলা জড়াজড়ি করে কাঁদতে থাকে।
দুপুর ১২টায় অশ্বিনী কুমার টাউন হলের সামনে প্রথম আলো বন্ধুসভা মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষক জিন্নাত আলীর হত্যার প্রতিবাদে মানববন্ধন আহ্বান করেছিল। আমরা স্কুলের সামনে থেকে সরে আসি। টাউন হলের সামনে তখন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি বরিশাল আঞ্চলিক শাখার প্রতিবাদী অবস্থান শুরু হয়েছে। আমরা সেখানেও দাঁড়াই। শিক্ষক সমিতির সভাপতি দাশগুপ্ত আশীষ কুমার সব শিক্ষকের পক্ষ থেকে গ্রেপ্তার হওয়া দুই আসামিকে দ্রুত বিচার আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছিলেন। বরিশাল শহরের সব স্কুলের সামনে ওই দিন পূর্বঘোষিত কর্মসূচি হিসেবে মানববন্ধন আয়োজিত হচ্ছিল। একটু পরে টাউন হলের সামনে শত শত ছাত্রছাত্রী এসে প্রতিবাদের কাতারে দাঁড়াল। দাঁড়ালেন শিক্ষকেরা। সংস্কৃতিকর্মী, উন্নয়নকর্মী ও পেশাজীবীরাও দাঁড়ালেন। পৌর মেয়র এলেন শোকার্ত মুখে।
আমরা বিস্মিত হতে থাকি চারপাশ দেখে। কী প্রবল জনপ্রিয়তা ছুঁয়ে বেঁচে ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষক জিন্নাত আলী। স্বাধীনতাযুদ্ধে জয়ী একজন বীর, রণাঙ্গনের পিছু না হটার শিক্ষায় উদ্ভাসিত একজন মানুষ, স্বাধীন দেশে নারীত্বের অসম্মান প্রতিরোধে যথার্থ ভূমিকায় নেমেছিলেন মমতায়। একজন গণিত শিক্ষক, যিনি অবলীলায় পড়াতেন ভূগোল, ক্লাসে পড়ানো শুরুর আগে পাঁচ-দশ মিনিট বলে নিতেন মুক্তিযুদ্ধের গল্প, যিনি একই সঙ্গে শরীরচর্চা শিক্ষকও, যিনি বলতেন শরীরচর্চা অনেক জরুরি একটি কাজ। বিশেষ করে মেয়েদের জন্য তো বটেই! তা না হলে মেয়েরা শক্ত, দৃঢ় হবে কীভাবে? যে মাঠে তিনি শরীরচর্চার বাঁশিতে ফুঁ দিতেন, আমরা সেই এ ওয়াহেদ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের মাঠে গিয়ে দাঁড়াই। শূন্যতা আমাদের চারপাশে হাহাকার করে ওঠে। স্কুল ভবনটি কোলাহলহীন। পতাকাদণ্ডে শোকের কালো পতাকা। আমরা নত মাথায় প্রধান শিক্ষিকার কক্ষে গিয়ে বসি।
কক্ষজুড়ে সাজানো অসংখ্য ঝকঝকে ট্রফি-ক্রেস্ট দেখিয়ে প্রধান শিক্ষিকা রোকেয়া বেগম জানালেন, ‘এর সবগুলোই জিন্নাত আলী স্যারের কারণে পাওয়া। তিনি প্রশিক্ষণ দিতেন নিখুঁত, তাই ছাত্রীরা সব খেলায় জয়ী হতো। স্কুলের শুরু থেকেই তিনি ছিলেন, ২৫ বছর আগে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন এ ওয়াহেদ বালিকা বিদ্যালয়ের সঙ্গে। তারপর নিরলস পথচলা সহকর্মীদের সঙ্গে। বিষণ্নতা অবসাদ তাঁকে ছুঁতে পারত না। একাই দায়িত্ব নিতেন দশজনের। তাঁর মন ছিল অনেক বড়। তিনি সবার দুঃখের দায়িত্ব নিতেন অথচ তাঁর মেয়েকে উত্ত্যক্ত করছে কেউ, এই কথা আমাদের কাউকে জানাননি। হয়তো আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলতে চাননি।’ রোকেয়া বেগম সজল স্বরে বলেন, ‘অসম্ভব ভালোবাসত তাঁকে ছাত্রীরা। ২৫ বছর আগে এআরএস নামের একটি স্কুলে ছিলেন, সেখানেও ছিলেন তুমুল জনপ্রিয়। এ রকম একজন মানুষের খুন হওয়ার পর আমি মনে করি, আমাদের চুপ করে থাকাটাই অন্যায়, অপরাধ। আমাদের কথা বলতে হবে।’
জিন্নাত আলী স্যারের শোকাহত স্ত্রী কাজী শিরিন আখতার অবিশ্বাস্য এক সহিষ্ণুতা নিয়ে বসে ছিলেন আমাদের সামনে। ছুরিকাহত এবং ক্ষতবিক্ষত মুক্তিযোদ্ধা জিন্নাত আলী চিৎকার করে শিরিনকে ডেকেছিলেন। তারপর ছুটে যাওয়া, রক্তাপ্লুত মানুষটিকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া, হাসপাতাল থেকে রক্ত সংগ্রহের কথা বলা...। ছয় ব্যাগ রক্ত লাগবে শুনে জিন্নাত আলী বলেছিলেন, তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, দুই ব্যাগ রক্ত হলেই চলবে। তারপর রক্ত সংগ্রহ হলো কিন্তু বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যে আইসিইউ সাপোর্ট নেই। কী কাণ্ড! অবাক হলেও সত্যি। যন্ত্রপাতি কিছু কিছু থাকলেও দক্ষ জনবল নেই। এসব নিয়ে নাকি প্রথম আলোতে লেখাও হয়েছিল। হায় জীবন! রক্তক্ষরণে নিস্তেজ হয়ে পড়া শিক্ষক জিন্নাত আলীকে বরিশাল-ঢাকার এবড়োথেবড়ো মহাসড়ক দিয়ে ঢাকায় আনার পথযাত্রা শুরু হয়েছিল। সেই যাত্রা থেমেছে মৃত্যুতে। যে মৃত্যুকে এড়াতে চেয়ে জিন্নাত আলী স্যার থানায় জিডি করেছিলেন। তাতে তাঁর নিরাপত্তা বাড়েনি, মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়েছে। কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহিদুজ্জামান নিজেও মানছিলেন যে কাউনিয়া থানার জিডি অনায়াসেই কোতোয়ালি থানায় স্থানান্তর করা যেত। আর জিন্নাত আলীর স্ত্রী শিরিন আখতার কোতোয়ালি থানার কালাম দারোগা টাকা চেয়েছিল বলে যে অভিযোগ করেছেন, তা যদি সত্যি হয়, তবে এটা খুব অনৈতিক কাজ হয়েছে বলেও মেনেছেন কর্মকর্তা শাহিদুজ্জামান। ১৩০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালিয়ে বরিশাল থেকে চার ঘণ্টায় যশোর পৌঁছে ঘাতক রূপমকে গ্রেপ্তার করে কোতোয়ালি থানা পুলিশ যথার্থ কাজটি করেছে ঠিকই, তবু রাষ্ট্রের এসব উঁচু উঁচু নাগরিক ভবনের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরছে এখনো আঁখি, ফারিয়া ও শায়লাদের তীব্র চিৎকার তাদের ‘বাবা স্যার’-এর অকালমৃত্যুতে। আর ওই যে মেয়েটি, জিন্নাত আলী স্যারের প্রিয়তমা কন্যা, যাকে উত্ত্যক্ত করেছিল মিঠু এবং প্রকারান্তরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, সেই মেয়েটি একলা হলে নিশ্চয়ই কাঁদে এখনো, কাঁদবে সারা জীবন এই ভেবে যে, তারই জন্য কেবল তার মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষক বাবাকে খুন করা হয়েছিল।
আমরা এসব দেখে মুখ লুকিয়ে থাকব এখনো? আমরা এখনো দায় নেব না? কিছুই বলব না?
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
che21c@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.